জ্বীনেদের নামাজ - আরিফুল ইসলাম সাহাজি

আমি থাকি রায়কোলা শাহী মসজিদ থেকে দুই ,তিন ক্রোশ দূরে ।মসজিদটি কয়েক শতাব্দী প্রাচীন ।ইতিহাস রহস্যবৃত ।কে বা কারা তৈরী করেছিলেন কয়েক শতাব্দীপ্রাচীন এই ঐতিহ্যবাহী উপাসনা গৃহটি ,আজও জানা যায়নি । বিষয়টি নিয়ে প্রত্নতাত্বিক গবেষণা হলে হয়ত ইতিহাস একটা জুটত ।কেউ কেউ বলেন ,মসজিদটি জ্বীনেদের তৈরী ।একরাতে তাঁরা নির্মাণ করেছিলেন ।কেউ বলেন ,আরব থেকে যে বাইশজন দরবেশ ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে বর্তমান  দেগঙ্গা ব্লকে এসেছিলেন তাঁরাই হয়ত তৈরী করে থাকবেন ।তবে ,অধিকাংশের অভিমত মোঘল বাদশা সাজাহানের নির্দেশে এ অঞ্চলের কোন প্রশাসক উপাসনা গৃহটি নির্মাণ করেন ।

জনবসতি কম ।মসজিদের পাশে কয়েক শতাব্দী প্রাচীন কবরস্থান ।কে বা কারা সেখানে শায়িত ,কেউ বলতে পারেন না ।কবরস্থানকে কেন্দ্র করে রয়েছে অবাঞ্ছিত লতা - গুল্ম।  গোটা ছয়েক বিরাটাকার বটগাছ ভয়াবহ করে তুলেছে পরিবেশ ।মসজিদের একেবারে সামনে রয়েছে আমার শৈশব কাটানো উচ্চবিদ্যালয় ।পিছনের দিকটাতে ছিল স্কুলের ছেলেদের জন্য বয়েজ হোস্টেল ।

 থমথমে পরিবেশ  ।স্কুলে গিয়ে আমরা দিনের বেলা ভয় পেতাম ।গা হিম করা গল্প শুনতাম বাবা দাদুদের কাছে ।মসজিদের সাতটি গম্বুজ ।একটা গম্বুজ কানা ।টিফিনের সময় আমরা অজু করে কানা গম্বুজটা খুঁজতাম ।প্রতিটা গম্বুজের নিচে উচ্চস্বরে চেঁচাতাম ।ছটা গম্বুজ প্রতিধ্বনিত করলেও একটা থাকতো সম্পূর্ণ নীরব ।মজার ব্যাপার ,পরের দিন কানা গম্বুজটা পাল্টে যেত ।বিষয়টা বেশ রহস্যের ।যদিও সে সময় রহস্যের  চেয়ে মজা লাগত বেশি ।

আগেই বলেছি ,মসজিদের একেবারে গা লাগোয়া ছেলেদের একটা বয়েজ হোস্টেল ছিল ।হোস্টেলে থাকা বন্ধুদের কাছে শুনতাম লোম খাঁড়া করবার মত এক একটা ঘটনা ।ঐ কানা গম্বুজের মত গল্পগুলোও রোজ পাল্টে যেত ।সন্ধ্যার পর ,দরকার না হলে ওরা বাইরে বার হতো না ।রাত একটু ভারী হতেই বটগাছ গুলোর উপর বিরাটাকার কয়েকটা আলো জ্বলত ।কিসের আলো ,কেন জ্বলছে ;কেউ বলতে পারতো না ।রাত আরও গভীর হলে পুরো পরিবেশটা নাকি মানুষের হাতের বাইরে চলে যেত ।মসজিদ সহ পুরো এলাকা তখন জ্বীনেদের কব্জায় ।রাত বারোটার পর বিষয়টা অতিমাত্রায় বেড়ে যেত ।জ্বলতে থাকা বাল্ব গুলো একসময় কর্মহীন হয়ে পড়ত ।তারপর ,পুরো অন্ধকার ।মসজিদ ,কবরস্থান ,জঙ্গল জনশূন্য ,তামাটে রঙ ।শামীম নামের এক বন্ধু হঠাৎ একদিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে ।তারপর খুব ভয় পেয়ে রুমমেটদের জাগায় ।অবর্ণনীয় পরিস্থিতি ।মসজিদের ভিতর থেকে কে বা কারা উচ্চস্বরে সূরা ফাতেহা পাঠ করছে ।সকালবেলা ,হোস্টেল ইনচার্জ ওদের নাকি বলেছিলেন ,প্রতিদিন রাত বারোটার পর তাহাজ্জুদ নামাজে জ্বীনেদের নাকি বড় জমায়েত হয় ।

এবারে বলছি ,পাঁচ - ছয় বছর পরের ঘটনা ।আমার এক পাড়াতুতো ভায়ের কাছে শোনা ।মসজিদের পাশের উন্মুক্ত ময়দানে বিরাট এক ধর্মসভার আয়োজন করা হয়েছিল ।আমার ঐ পাড়াতুতো ভাইটি ছিল শ্রোতা ।জলসা করছিলেন বাংলা খ্যাত এক আলেম ।রাত সাড়ে ১১টা বাজতেই জলসা বন্ধ করে তিনি জায়গা খালি করে দিতে বললেন ।'ওঁরা অপেক্ষা করছে ',জায়গা খালি করুন ।কিন্তু কমিটির চাপে তিনি ধর্মসভা চালিয়ে যেতে বাধ্য হন ।ঘড়ির কাঁটা রাত ১২টা ছুঁতেই এক বিকট শব্দে লাইটগুলো ভেঙে মাটিতে পড়ে গেল ।জেনারেটর গুলোও আশ্চর্যভাবে নীরব হয়ে গেল ।

সবটাই আমার কানে শোনা ,চোখে দেখা বাস্তব নয় ।সত্য মিথ্যার বিচার যুক্তি সীমার বাইরে রাখলাম ।সে ভার আপনাদের ॥

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।