হারিয়ে যাওয়া কালি কলম প্রবন্ধের সার্বিক আলোচনা ।
লিখেছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।
লেখকের অভিমত অনুযায়ী , আমরা যাঁরা লেখার জগতে রয়েছেন , তাঁরা মূলত সমান্তরাল ভাবে তিনটি বিশেষ বিষয়ের উপর নির্ভরশীল থাকেন । লেখকের ভাষ্যনুযায়ী , ' কালি কলম মন , লেখে তিনজন । ' তাঁরপরই লেখকের প্রশ্ন , ' কিন্তু কলম কোথায়? ' লেখক যেখানে কাজ করেন , সেটি লেখালিখির অফিস । সেখানে সবাই লেখক । তবে , মজার বিষয় , লেখক ব্যতীত আর কারও কাছেই নেই কলম । সকলের সামনেই রাখা রয়েছে , আয়নার মত একটা কাঁচের স্ক্রীন বা পরদা । নিচে রয়েছে টাইপ রাইটারের মত একটা একটা কিবোর্ড । লেখকগণ অনবরত তাই দিয়ে লিখে চলেন । লেখক নিজে যা লেখেন , ওইভাবে তাঁরা ছাপার অক্ষরে প্রকাশ উপযোগী করে দেন । লেখক কিছুটা বীতশ্রদ্ধ হয়ে আক্ষেপ করেন -
' 'লেখালিখির অফিস । লেখকের কারখানা । বাংলায় একটা কথা আছে , ' কালি নেই , কলম নেই , বলে আমি মুনশি । ' '
লেখক গ্রামের ছেলে , পঞ্চাশ ষাট বছর আগের পুরনো গ্রামীণ স্মৃতি তাঁকে বিজড়িত করে । কলমের সঙ্গে তখন অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল শিক্ষার্থীদের । কত হাজার রকম ভাবে তখন কলম তৈরি করতেন তাঁরা । লেখার জন্য তখন জুটত না কাগজও । কলার পাতায় চলত পাঠ আর হোমটাস্ক । কালিও তৈরি করতেন নিজেরাই । অবশ্যই বড় সাহায্য নিতে হতো । প্রাচীনেরা বলতেন -
''তিল ত্রিফলা সিমুল ছালা /ছাগ দুগ্ধে করি মেলা /লৌহপাত্রে লোহায় ঘসি / ছিঁড়ে পত্র না ছাড়ে মাসি । ' '
এটাই ছিল কালি উৎপাদনে তাঁদের নিজস্বতা ।
লেখক নিজেরা কিভাবে কালি তৈরি করতেন তাঁর একটি সুন্দর বর্ণনাও তিনি দিয়েছেন , বয়ানটি এরুপ -
' ' বাড়ির রান্না করা হতো কাঠের উনুনে । তাতে কড়াইয়ের তলায় বেশ কালি জমত । লাউপাতা দিয়ে তা ঘষে তুলে একটা পাথরের বাটিতে রাখা জলে তা গুলে নিতে হতো । আমাদের মধ্যে যাঁরা ওস্তাদ তারা ওই কালো জলে হরতকী ঘষত । কখনও কখনও মাকে দিয়ে আতপ চাল ভেজে পুড়িয়ে তা বেটে ওতে মিশাত । সবভালো করে মেশাবার পর একটা খুন্তির গোড়ার দিকটা পুড়িয়ে লাল টকটকে করে সেই জলে সেঁকা দেয়া হতো । ...তারপর ন্যাকড়ায় সেঁকে দোয়াতে ঢেলে কালি । ' '
কলমও ছিল বড় বিচিত্র ধরনের । লেখার পাঠও শুরু হতো অদ্ভুতরকম ভাবে -
''বাঁশের কলম , মাটির দোয়াত , ঘরে তৈরি কালি আর কলাপাতা , বলতে গেলে তাই নিয়ে আমাদের প্রথম লেখালিখি । ' '
তিনি ভাবুক সচেতন মানুষ , অনুমান করতে চেয়েছেন তিনি যদি মহাত্মা যীশুর আগে কিম্বা প্রাচীন মিশরে বা বাংলাভাষী না হয়ে যদি হতেন সুমেরীয় বা ফিনিসিয়ান, তাহলে নীলনদীর তীর থেকে ভেঙে নিতেন একটা নীল খাগড়া , সেটা দিয়েই বানাতেন কলম । আবার ভেবেছেন তিনি যদি স্বয়ং জুলিয়াস সিজার হতেন তাহলেও শ্রেষ্ঠ কারিগরগণ বড়জোর ব্রোঞ্জের একটা শলাকা প্রস্তত করে দিতেন , যার পোশাকি নাম স্টাইলাস । এই স্টাইলাস নিয়ে একটা গল্প আছে , সিজার যে কলমটি দিয়ে কাসকাকে আঘাত করেছিলেন , সেটা ব্রোঞ্জের তৈরি এই স্টাইলাস । লেখক চিনেদের কথাও বলেছেন , তাঁরা প্রথম থেকেই তুলি ব্যবহার করে আসছেন । এক্ষেত্রে তাঁরা অন্যদের থেকে ব্যতিক্রমী । তারা ব্যতীত সর্বত্রই বাঁশের কিম্বা নল খাড়গার বা পাখির পালক সহ অন্যান্য শলাকাই ছিল মাধ্যম ।
লেখক পরের স্তবকেই , এখনকার সময় , অর্থাৎ প্রবন্ধটির লিখবার সময়ের ছেলেমেয়েদের কলমের হরেকরকম সম্ভারের কথা বলেছেন । তাঁর ভাষ্যনুযায়ী ,
' ' হয়তো গ্রামগঞ্জেও আজ বাঁশের কঞ্চির কলম আর খুঁজে পাওয়া যাবে না । খাগের কলম দেখা যায় একমাত্র সরস্বতী পুজোর সময় । কাচের দোয়াতে কালির বদলে দুধ । ফাউন্টেন পেন বা বলপেনের বদলে খাগের কলম । পালকের কলমও আর চোখে পড়ে না । ' '
পালকের পেনের ইংরেজি নাম কূইল । লর্ড কার্জন বাংলাভাষী সাংবাদিকদের গরম গরম ইংরেজি দেখে তাঁদেরকে বলতেন ' বাবু কুইল ড্রাইভারস ' ।
হারিয়ে গেছে লেখকের বাল্যকালের সে সমস্ত স্মৃতিময় ঐতিহ্য । ছেলেবেলায় তিনি এক দারোগা বাবুকে কলম পায়ের মোজাই গুঁজতে দেখেছিলেন । এমন আরও বিচিত্র কান্ডকারখানা ছিল সেসময় ।
কলমের জগতে সত্যকার বিপ্লব সংঘটিত হয় ফাউন্টেন পেনের আবিস্কারের ফলে । আবিস্কারক ছিলেন - লুইস আ্যডসন ওয়াটারম্যান । আবিস্কারের কাহিনীটিও ভয়ঙ্কর রকম মজার , একবার তিনি গিয়েছেন একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে চুক্তিপত্রে সই করতে । দলিল কিছুটা লেখা হয়ে গেছে এমন সময় দোয়াত উপুড় হলো কাগজে । তিনি ছুটলেন কালির সন্ধানে , এসে দেখেন হাতছাড়া হয়ে গেছে সে প্রোজেক্ট । বিমর্ষ ওয়াটার মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন , এর একটা বিহিত তিনি করবেন ।
লেখক তাঁর প্রথম ফাউন্টেন পেন কেনার একটা মজার ঘটনার বর্ণনাও দিয়েছেন । একটি নামি পেনের দোকানে গিয়ে তিনি পেনের হাজার রকম সম্ভার দেখে ভ্যাবাচ্যাকা বনে যান । কত রকমের কলম সেখানে , পার্কার , শেফার্ড , ওয়াটারম্যান , সোয়ান , পাইলট । ছিল নানা জাতের ফাউন্টেন পেন । তিনি নিয়েছিলেন জাপানি পাইলট । ফাউন্টেনের মধ্যে একধরনের মাদকতা আছে বলে লেখক মনে করেন । প্রসঙ্গত , তিনি বিখ্যাত লেখক শৈলজানন্দ এবং শরৎচন্দ্রের কথা বলেছেন । দুজনেরই ফাউন্টেন পেন সংগ্রহের নেশা ছিল ।
পরবর্তী আলোচনার জন্য আমাদের পরের পোস্টের জন্য অপেক্ষা করুন । ।
লেখকের অভিমত অনুযায়ী , আমরা যাঁরা লেখার জগতে রয়েছেন , তাঁরা মূলত সমান্তরাল ভাবে তিনটি বিশেষ বিষয়ের উপর নির্ভরশীল থাকেন । লেখকের ভাষ্যনুযায়ী , ' কালি কলম মন , লেখে তিনজন । ' তাঁরপরই লেখকের প্রশ্ন , ' কিন্তু কলম কোথায়? ' লেখক যেখানে কাজ করেন , সেটি লেখালিখির অফিস । সেখানে সবাই লেখক । তবে , মজার বিষয় , লেখক ব্যতীত আর কারও কাছেই নেই কলম । সকলের সামনেই রাখা রয়েছে , আয়নার মত একটা কাঁচের স্ক্রীন বা পরদা । নিচে রয়েছে টাইপ রাইটারের মত একটা একটা কিবোর্ড । লেখকগণ অনবরত তাই দিয়ে লিখে চলেন । লেখক নিজে যা লেখেন , ওইভাবে তাঁরা ছাপার অক্ষরে প্রকাশ উপযোগী করে দেন । লেখক কিছুটা বীতশ্রদ্ধ হয়ে আক্ষেপ করেন -
' 'লেখালিখির অফিস । লেখকের কারখানা । বাংলায় একটা কথা আছে , ' কালি নেই , কলম নেই , বলে আমি মুনশি । ' '
লেখক গ্রামের ছেলে , পঞ্চাশ ষাট বছর আগের পুরনো গ্রামীণ স্মৃতি তাঁকে বিজড়িত করে । কলমের সঙ্গে তখন অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল শিক্ষার্থীদের । কত হাজার রকম ভাবে তখন কলম তৈরি করতেন তাঁরা । লেখার জন্য তখন জুটত না কাগজও । কলার পাতায় চলত পাঠ আর হোমটাস্ক । কালিও তৈরি করতেন নিজেরাই । অবশ্যই বড় সাহায্য নিতে হতো । প্রাচীনেরা বলতেন -
''তিল ত্রিফলা সিমুল ছালা /ছাগ দুগ্ধে করি মেলা /লৌহপাত্রে লোহায় ঘসি / ছিঁড়ে পত্র না ছাড়ে মাসি । ' '
এটাই ছিল কালি উৎপাদনে তাঁদের নিজস্বতা ।
লেখক নিজেরা কিভাবে কালি তৈরি করতেন তাঁর একটি সুন্দর বর্ণনাও তিনি দিয়েছেন , বয়ানটি এরুপ -
' ' বাড়ির রান্না করা হতো কাঠের উনুনে । তাতে কড়াইয়ের তলায় বেশ কালি জমত । লাউপাতা দিয়ে তা ঘষে তুলে একটা পাথরের বাটিতে রাখা জলে তা গুলে নিতে হতো । আমাদের মধ্যে যাঁরা ওস্তাদ তারা ওই কালো জলে হরতকী ঘষত । কখনও কখনও মাকে দিয়ে আতপ চাল ভেজে পুড়িয়ে তা বেটে ওতে মিশাত । সবভালো করে মেশাবার পর একটা খুন্তির গোড়ার দিকটা পুড়িয়ে লাল টকটকে করে সেই জলে সেঁকা দেয়া হতো । ...তারপর ন্যাকড়ায় সেঁকে দোয়াতে ঢেলে কালি । ' '
কলমও ছিল বড় বিচিত্র ধরনের । লেখার পাঠও শুরু হতো অদ্ভুতরকম ভাবে -
''বাঁশের কলম , মাটির দোয়াত , ঘরে তৈরি কালি আর কলাপাতা , বলতে গেলে তাই নিয়ে আমাদের প্রথম লেখালিখি । ' '
তিনি ভাবুক সচেতন মানুষ , অনুমান করতে চেয়েছেন তিনি যদি মহাত্মা যীশুর আগে কিম্বা প্রাচীন মিশরে বা বাংলাভাষী না হয়ে যদি হতেন সুমেরীয় বা ফিনিসিয়ান, তাহলে নীলনদীর তীর থেকে ভেঙে নিতেন একটা নীল খাগড়া , সেটা দিয়েই বানাতেন কলম । আবার ভেবেছেন তিনি যদি স্বয়ং জুলিয়াস সিজার হতেন তাহলেও শ্রেষ্ঠ কারিগরগণ বড়জোর ব্রোঞ্জের একটা শলাকা প্রস্তত করে দিতেন , যার পোশাকি নাম স্টাইলাস । এই স্টাইলাস নিয়ে একটা গল্প আছে , সিজার যে কলমটি দিয়ে কাসকাকে আঘাত করেছিলেন , সেটা ব্রোঞ্জের তৈরি এই স্টাইলাস । লেখক চিনেদের কথাও বলেছেন , তাঁরা প্রথম থেকেই তুলি ব্যবহার করে আসছেন । এক্ষেত্রে তাঁরা অন্যদের থেকে ব্যতিক্রমী । তারা ব্যতীত সর্বত্রই বাঁশের কিম্বা নল খাড়গার বা পাখির পালক সহ অন্যান্য শলাকাই ছিল মাধ্যম ।
লেখক পরের স্তবকেই , এখনকার সময় , অর্থাৎ প্রবন্ধটির লিখবার সময়ের ছেলেমেয়েদের কলমের হরেকরকম সম্ভারের কথা বলেছেন । তাঁর ভাষ্যনুযায়ী ,
' ' হয়তো গ্রামগঞ্জেও আজ বাঁশের কঞ্চির কলম আর খুঁজে পাওয়া যাবে না । খাগের কলম দেখা যায় একমাত্র সরস্বতী পুজোর সময় । কাচের দোয়াতে কালির বদলে দুধ । ফাউন্টেন পেন বা বলপেনের বদলে খাগের কলম । পালকের কলমও আর চোখে পড়ে না । ' '
পালকের পেনের ইংরেজি নাম কূইল । লর্ড কার্জন বাংলাভাষী সাংবাদিকদের গরম গরম ইংরেজি দেখে তাঁদেরকে বলতেন ' বাবু কুইল ড্রাইভারস ' ।
হারিয়ে গেছে লেখকের বাল্যকালের সে সমস্ত স্মৃতিময় ঐতিহ্য । ছেলেবেলায় তিনি এক দারোগা বাবুকে কলম পায়ের মোজাই গুঁজতে দেখেছিলেন । এমন আরও বিচিত্র কান্ডকারখানা ছিল সেসময় ।
কলমের জগতে সত্যকার বিপ্লব সংঘটিত হয় ফাউন্টেন পেনের আবিস্কারের ফলে । আবিস্কারক ছিলেন - লুইস আ্যডসন ওয়াটারম্যান । আবিস্কারের কাহিনীটিও ভয়ঙ্কর রকম মজার , একবার তিনি গিয়েছেন একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে চুক্তিপত্রে সই করতে । দলিল কিছুটা লেখা হয়ে গেছে এমন সময় দোয়াত উপুড় হলো কাগজে । তিনি ছুটলেন কালির সন্ধানে , এসে দেখেন হাতছাড়া হয়ে গেছে সে প্রোজেক্ট । বিমর্ষ ওয়াটার মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন , এর একটা বিহিত তিনি করবেন ।
লেখক তাঁর প্রথম ফাউন্টেন পেন কেনার একটা মজার ঘটনার বর্ণনাও দিয়েছেন । একটি নামি পেনের দোকানে গিয়ে তিনি পেনের হাজার রকম সম্ভার দেখে ভ্যাবাচ্যাকা বনে যান । কত রকমের কলম সেখানে , পার্কার , শেফার্ড , ওয়াটারম্যান , সোয়ান , পাইলট । ছিল নানা জাতের ফাউন্টেন পেন । তিনি নিয়েছিলেন জাপানি পাইলট । ফাউন্টেনের মধ্যে একধরনের মাদকতা আছে বলে লেখক মনে করেন । প্রসঙ্গত , তিনি বিখ্যাত লেখক শৈলজানন্দ এবং শরৎচন্দ্রের কথা বলেছেন । দুজনেরই ফাউন্টেন পেন সংগ্রহের নেশা ছিল ।
পরবর্তী আলোচনার জন্য আমাদের পরের পোস্টের জন্য অপেক্ষা করুন । ।
হারিয়ে যাওয়া কালি কলম
উত্তরমুছুন1:তপনের চোখ মার্বেল হয়ে গেল " কেন তপনের চোখ মার্বেল হয়ে গেল?
উত্তরমুছুনতার ছোটো মেসো লেখক জেনে
মুছুনএটা জ্ঞানচক্ষু-এর প্রশ্ন,হারিয়ে যাওয়া কালি কলম এর নয়।
মুছুনo purabo
উত্তরমুছুনby my side it's awesome ☺☺☺
উত্তরমুছুনতলোয়ারের চেয়ে শক্তিধর বলা হয়----- কলমকে
উত্তরমুছুনমুঘল দরবারে তাদের অনেক খাতির -- কাদের খাতির?
উত্তরমুছুনমুনসী দের অর্থাৎ পণ্ডিতদের,যারা মুঘল দরবারে লেখালেখি করতেন তাদের বোঝানো হয়েছে।
মুছুনলিপি কুশলি অথবা ক্যালিগ্রাফিস্ট দের
মুছুন"মনে মনে সেই ফরাসি কবির মতো বলেছি" - লেখক ফরাসি কবির মতো কি বলেছেন?তার সে-কথা বলার কারণ কি?
উত্তরমুছুনক্যালিগ্রাফিস্ট কী???
উত্তরমুছুন