- শিক্ষার বেহাল দশা । চালু হোক আবার পাশ ফেলের প্রথা ।

আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি । প্রবন্ধটি দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকাতে প্রকাশিত । ।
 

সরকার পোষিত প্রাথমিক এবং উচ্চ বিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষার মান অক্সিজেন মাস্ক মুখে দেওয়া রোগীর মত । বিদ্যালয় উপস্থিতি লক্ষণীয় হলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই পঠনগত দিক থেকে অকল্পনীয় দুর্বল । একটা বিরাট অংশ আই .সি .ইউ তে সংরক্ষণ যোগ্য । বিষয়টি পরিস্কার করতে একটা মজার গল্প বলি শুনুন , অল্পকিছুদিনের জন্য একটি বিদ্যালয়ে পড়ানোর সুযোগ হয়েছিল । সপ্তম শ্রেণীতে  একটি ছেলে  পড়ত , নাম গোপাল । গোপাল বিদ্যালয়ে খ্যাতনামা এক চরিত্র । শরীরী গঠনে সে বেশ স্থূলকায় । অল্পবয়সেই  ভুঁড়ি বেরিয়ে আসছে । সপ্তম শ্রেণীতে পড়লেও দ্বিতীয় শ্রেণীর শিশু বোধগম্যতায় গোপালের চেয়ে উর্বর । গোপাল একের সঙ্গে এক যোগ করলে কত হয় বলতে পারে , তবে দুই যোগ তিন কত হয় বললে ভাবতে গোপালকে অন্ততঃ দুই দিন সময় দিতে হবে । একদিন ক্লাসে গিয়েছি , ভাবলাম গোপালের ভুঁড়িতে কী আছে আজ দেখা যাক । ডাকলাম কাছে । অনিচ্ছা নিয়েই আসল । বললাম , আচ্ছা গোপাল বলতো আমাদের দেশের নাম কী ? এই প্রশ্নের উত্তর গোপাল জানবে আশা করেছিলাম । ওমা , এবারো গোপাল নিজেকে ভাবের সমুদ্রে বিলীন করল । ঘন ঘন মাথা চুলকাচ্ছে গোপাল । ক্লাসে গুঞ্জন , হাসি মস্করা ঠাট্টার মাঝেও গোপাল ভাবছে । পাশ থেকে একটি ছেলে চুপি চুপি গোপালকে বলে দিল , আমাদের দেশের নাম ভারতবর্ষ । উত্তর যাচাই না করেই গোপাল বললো , স্যার ভারতবর্ষ । ফিরলাম ওর দিকে , মাথা চুলকে বললাম , হলো না গোপাল , আবার ভাবো ।গোপাল আবার চূড়ান্ত বিপদে পড়ল । যে দুজন তাকে বলে দিয়েছিল , আমাদের দেশের নাম ভারতবর্ষ , তাদের দিকে রাগত ভাবে তাকিয়ে থাকল বেশ কিছুক্ষণ । ভাবলাম আমি গেলে ওদের খবর আছে । আবার ভাবছে গোপাল । হঠাৎ করেই বললো , স্যার আমাদের দেশের নাম আমেরিকা । উচ্চস্বরে হো হো করে হেসে উঠল ক্লাস । ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে   রইল    গোপাল । বললাম কীরে , কী হবে তোদের ! দুই বছর কেটে গেছে ওই ঘটনা থেকে । শ্রেণীকক্ষের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীর কথা ভূলে গেছি , তবে গোপালকে এখনও মনে পড়ে । ওমন হাজারো গোপাল রয়েছে সরকারি বিদ্যালয়ের অঙ্গনে ।

<script async src="//pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js"></script>
<ins class="adsbygoogle"
     style="display:block; text-align:center;"
     data-ad-layout="in-article"
     data-ad-format="fluid"
     data-ad-client="ca-pub-8859464621580427"
     data-ad-slot="8799548003"></ins>
<script>
     (adsbygoogle = window.adsbygoogle || []).push({});
</script>

শহর থেকে গ্রামগঞ্জের অলিগলিতে এখন ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠছে একাধিক  বেসরকারি স্কুল ও মিশন ।ফলস্বরূপ , সরকারি প্রাথমিক এবং উচ্চবিদ্যালয় সমূহের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন অভিভাবকগণ । বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় , একপ্রকার শিক্ষার্থীর অভাবে ধুঁকছে । বিষয়টি নিয়ে আমরা অনেকেই সোচ্চার হয় । প্রশ্ন তুলি কেন ফ্রি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকতে বেসরকারি স্কুলগুলোতে বাচ্চাদের পড়ানো হচ্ছে ? তবে নিজের বাচ্চা ভর্তির সময় আমরা বেছে নিই কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোকে । দুঃখের হলেও সত্য , প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো এখন নিন্ম মধ্যবিত্ত মানুষজনের বাচ্চাদের  আখড়া হয়ে উঠছে । মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের জনগোষ্টি কেন সরকারি স্কুলগুলোর প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন । বিষয়টা বোঝাতে একটি বিষয় উপস্থাপন করা যাক । আমাদের দেশে সরকারি হাসপাতাল আছে , সঙ্গে আছে অসংখ্য বেসরকারি হাসপাতাল । জনসংখ্যার নিরিখে আমাদের দেশের হাসপাতাল সংখ্যা নগণ্যই । অনেকক্ষেত্রেই থাকে না সুপরিকাঠামো । অথচ দেশের সিংহভাগ দরিদ্য ও মধ্যবিত্ত মানুষ সরকারি হাসপাতালগুলোর নির্ভর করে । ফলে হাসপাতালগুলোতে উপচে পড়া ভিড় , তার জন্য যতটুকু পরিকাঠামো দরকার , তা না থাকায় চিকিৎসকদের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকক্ষেত্রেই চিকিৎসার মান যথার্থ পর্যায়ে থাকে না । আউটডোরের লম্বা লাইনে দাঁড়ালেই বিষয়টি পরিস্কার বোঝা যায় । চিকিৎসার মান সামঞ্জস্যতার ঘোরটোপের বাইরে যাবার কারণেই কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালগুলো রমরমিয়ে ব্যবসা করছে । অর্থাৎ যিনি অর্থবান তিনি কেন কিডনির পাথর অপারেশনের জন্য দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করবেন । মানের হেরফেরের কারণেই তিনি বেসরকারি হাসপাতালের উপর ভরসা রাখছেন । শিক্ষার মানের রকমফেরের জন্য অভিভাবকগণও মিশন সহ বেসরকারি বিদ্যালয়ে উপর আস্থা রাখছেন । মিশনগুলোও অভিভাবকদের আস্থার পূর্ণ মর্যদা রাখছেন , মাধ্যমিক ,  উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাতে তাঁদের ঈর্ষণীয় সাফল্য তার প্রমাণ । 

অনেকেই সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষামানের করুণ দশার জন্য শিক্ষকদের পড়ানোর পদ্ধতি ও মানের উৎকর্ষতা বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন । কিছুক্ষেত্রে তাঁরা সঠিক হলেও শিক্ষার এইরুপ অপব্যবস্থার জন্য শিক্ষকদের দায়ী করা ঠিক নয় । প্রথমত , বিদ্যালয়গুলোতে শৃঙ্খলা , শাসন একপ্রকার নেই বললেই চলে । আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য শিক্ষকদের দৃঢ়চেতা মানসিকতা দরকার , তবে শাসন বিষয়টি এখন বড় বেশি স্পর্শকাতর । প্রশাসন শিক্ষার্থীর শাসনের বিপক্ষে । আবার যাঁরা অভিভাবক , তাঁরা বাচ্চার পড়াশুনার খোঁজ নিক না নিক , বিদ্যালয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থীর ভালর জন্যও একটু শাসন করলে অভিভাবক সহ্য করতে পারেন না । দলবল নিয়ে অভিভাবক হাজির হন বিদ্যালয়ে । ক্লাসরুম থেকে পরম পূজনীয় শিক্ষক মহাশয়কে টেনে বেদম পেটান তাঁরা । যিনি মার খেলেন এবং তাঁর সহকর্মী যাঁরা স্বচক্ষে এই ন্যাক্কার ঘটনা দেখলেন , তাঁরা হয়তো আর কখনও শাসন করবেন না , আপনার সন্তানের ক্ষতি হলেও । কেননা তিনি বাইরে থেকে আসেন , তাঁর নিজের একটা পরিবার আছে , তিনি কেন আপনার সন্তানকে মানুষ করতে গিয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করে তুলবেন ।'  পরের ছেলে নিত্যানন্দ , যত যাবে গোল্লাই ততই আনন্দ ' , এই আপ্তবাক্যে তিনি বিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারেন । শিক্ষার অব্যবস্থার জন্য তাই শিক্ষকদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে , অভিভাবকদের সংযত হওয়া উচিৎ । অযথা বিদ্যালয়ে হাঙ্গামা না করে সমস্যা সমাধানের জন্য আলোচনাকে মাধ্যম হিসাবে গ্রহন করুক। আর শিক্ষার কাজটি প্রণম্য মাস্টারমশায়দের উপর ছেড়ে দিন । ওই বিষয়টা তাঁরা আপনাদের থেকে ভাল জানেন এবং বোঝেন । 

পাশ ফেলের সংস্কৃতি উঠে গেছে বেশ কয়েকবছর হলো । বলতে বাধা নেই ড্রপআউট কমাতে গিয়ে শিক্ষার মান নেমে দাঁড়িয়েছে খাদে । শিক্ষার্থীরা নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসছেন । কিন্তু শিখছে কতটুকু ? অবধারিত ভাবেই উঠছে এ প্রশ্ন । সপ্তম , অষ্টম শ্রেণীর অনেক শিক্ষার্থীর অক্ষরজ্ঞানের বহর দেখলে অবাক হতে হয় । অনেকে শুধু নিজের নামটাই কোন রকমে লিখতে জানে । সঠিক উচ্চারণ সহ বাংলাপাঠও অনেকের কাছে দুরূহ ব্যাপার । নবম দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের অবস্থাও  শোচনীয় । অনেককেই আই .সি .ইউ তে সংরক্ষণ করা দরকার । দশম শ্রেণীতে পাঠরত , বয়স ষোল বছর । দুই বছর পর হবে দেশের সুনাগরিক । তাদের সাধারণ জ্ঞানের বহর দেখলে তাজ্জব হতে হয় । অনেকেই জানে না দেশের প্রধানমন্ত্রীর নাম , মুখ্যমন্ত্রীর নাম । আলাপচারিতাই এমন একটি দলের কাছে জানতে চেয়েছিলাম , বল তো আমাদের প্রধানমন্ত্রী কে ? প্রশ্নটা ওদের কাছে খুব কড়া মনে হলো , অন্ততঃ তাদের মাথা চুলকানো , একে অপরের দিকে ফালুক ফুলুক করে তাকানো দেখে সেরকম বোধহল আমার । অনেক ভাবলো ওরা , তারপর বললো , মমতা । উত্তরটি মোটেও অপ্রত্যাশিত নয় আমার কাছে । এমন উত্তর আগেও পেয়েছি । অনেকেই মমতা ব্যানার্জীকে প্রধানমন্ত্রী মনে করে , বাংলাই তাদের কাছে আস্ত একটা দেশ । আমার মুখভঙ্গি দেখে ওরা বুঝতে পারল , উত্তরখানি ভূল হয়েছে । আবার ভাবছে ওরা , তারপর একটি মেয়ে প্রশ্নের সুরে বললো , কে দাদা ? ওই মুদি । গ্রামগঞ্জে নরেন্দ্র মোদীকে অনেকেই মুদি বলেই সমধিক চেনেন । বিষয়টি কিন্তু মোটেই আশাব্যঞ্জক নয় । একটি দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মুখ্যমন্ত্রী , প্রধানমন্ত্রীর প্রভেদ জানবে না ? সঠিক উচ্চারণ করে বাংলাপাঠেও অনেকেই অকল্পনীয় দুর্বল । ইংলিশ ,অঙ্কে তাদের পারদর্শিতা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন হয় না । শিক্ষার এ কেমন করুণদশা ? এরাই আগামীর সমাজের ধারক !  ফেল তুলে দিয়ে হয়তো কিছু কাঁচা মাথার শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে ধরা রাখা সম্ভব হয়েছে , তবে শিক্ষার উৎকর্ষতার মান অনেকটাই নামিয়ে দিয়েছে খাদে । ফেল সংস্কৃতি ফিরে আসুক স্বমহিমায় , অল্প মেধার শিক্ষার্থীদের সার্বিক উৎকর্ষতা অর্জনের মধ্য দিয়েই দেওয়া হোক পরবর্তী শ্রেণীতে উঠবার সুযোগ । আয়া রাম , গয়া রাম করে কারও উপকার সাধিত হবে না - শিক্ষার্থীরও  নয় , দেশেরও নয় ।



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।