নেতাজী এবং নজরুল দুই মনীষীর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন শিবরাম । অভিজ্ঞতাও ছিল দুই রকমের । ।

আরিফুল ইসলাম সাহাজি 
Netaji and Nojrul


শিবরাম চক্রবর্তী বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি এক স্রষ্টা । প্রসিদ্ধ তাঁর  কৌতুক বোধ ,  শিবরামের জীবনটাই যেন বিরাট এক  গল্পের প্লট । তাঁর জন্ম মালদহের চাঁচল রাজ পরিবারে । জন্মের পর অল্প কিছুদিন কলকাতাতে থাকলেও , পরে চাঁচল রাজবাড়িতে সপরিবারে চলে আসেন শিবরামরা । এস্টেটের চিকিৎসকও সপরিবারে থাকতেন রাজবাড়িতে  , রিনি সেই ডাক্তারবাবুর মেয়ে । তাঁর সাথে প্রগাঢ় বন্ধুত্বে মাতেন শিবরাম । পরে অবশ্য রিনিরা কলকাতাতে চলে আসেন । কিছুদিন পর কিশোর শিবরাম এন্ট্রান্স পরীক্ষাই পাশ করেন  । সে সময়টা তো অগ্নিগর্ব , ইংরেজরা মজবুত শিকড়ে দাঁড়ানো । স্বদেশী আন্দোলন , স্বশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ঝুঁকছে তরুণ প্রজন্ম । বিষয়টা শিবরামের ক্ষেত্রেও একই । দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তখন সর্বভারতীয় স্বদেশী আন্দোলনের গ্রহনযোগ্য মুখ । ওই সময় মালদহে আসেন দেশবন্ধু , সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী বাসন্তী দেবী । উদ্দেশ্য ছিল অসহযোগ আন্দোলনের প্রচার ।  উদীপ্ত হলেন শিবরাম , যোগ দিলেন ভলান্টিয়ার হিসাবে । পরদিনই দেশের কাজ করবেন বলে দেশবন্ধুর  সাথে ফিরতি ট্রেনে চেপে বসেন শিবরাম ।  যদিও লেখক সুরজিৎ দাশগুপ্ত তাঁর গ্রন্থ ' শিবরাম চক্রবর্তী ' তে উল্লেখ করেছেন , রিনিকে খোঁজা ছিল তাঁর অন্য একটি উদ্দেশ্য , যাঁকে শিবরাম একদিন বলেছিলেন , ' ' আমার জীবনে তুই একমাত্র মেয়ে , তুই প্রথম আর তুই-ই শেষ ' ' । 

কলকাতায় এসে শিবরাম অসহযোগিদের স্বেচ্ছাসেবক রুপে যোগ দেন । দেশবন্ধুর পছন্দ হলো কিশোর শিবরামকে , প্রিয়পাত্র  হয়ে উঠলেন অল্প সময়েই । দেশবন্ধু শিবরামকে ভর্তি করে দিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র পরিচালিত গৌড়ীয় সর্ববিদ্যায়তনে । সেখান থেকেই মেধাবী শিবরাম কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পাশ করলেন । কলকাতাতে তেমন পরিচিত কেউ নেই , বাঁচার জন্য প্রয়োজন একটি কাজ । দৈনিক পত্রিকা ফেরি করতে থাকেন শিবরাম । বিষয়টি মহাত্মা দেশবন্ধুর নজর এড়ালো না । ফরবেস ম্যানসনে বিনে পয়সায় শিবরামের থাকা খাওয়া ও একটা অল্প মাহিনার চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন তিনি।  শিবরাম যোগ দিলেন আত্মশক্তি পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলীর সদস্যরুপে । পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন সেসময়কার বিখ্যাত বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় , যিনি দীর্ঘদিন আন্দামানে নির্বাসিত ছিলেন । আর ম্যনেজার ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু । 

নেতাজী ছিলেন ভয়ঙ্কররকম শৃঙ্খলপরায়ন । কোনরুপ বিশৃংখলা তিনি পছন্দ করতেন না । শিবরাম  ঠিক তার উল্টো । শিবরাম আবার বাঁধাধরা নিয়ম শৃঙ্খলাকে তুচ্ছজ্ঞান করতেন । এককথায় শিবরাম বেপরোয়া । স্বাভাবিকভাবে সুভাষচন্দ্র রুষ্ট হন শিবরামের কার্যকলাপে । সুভাষচন্দ্র একদিন ডাকলেন শিবরামকে , বললেন হিসাব নিকেশ বুঝে নাও , কাল থেকে তোমার আসবার দরকার নেই । আবার কর্মহারা হলেন  , অনেক ভেবে ঠিক করলেন , নিজেই একটা কাগজ করবেন । শুরুও করলেন , তবে এবারও বিধি বাম । সমস্যা দেখা দিলো নামকরণ নিয়ে । শিবরাম তাঁর কাগজের নাম দিলেন , যুগান্তর । একই নামে বিপ্লবীদের আগে একটি প্রসিদ্ধ কাগজ ছিল । শিবরামের তেজস্বি লেখনী দেখে ইংরেজ সরকার ভাবলো , বিপ্লবীরা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন । কারারুদ্ধ হলেন শিবরাম । প্রথমে তাঁকে প্রেসিডেন্সি জেলে কারারুদ্ধ করা হয় । অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাকে বহরমপুর জেলে বদলি করার আদেশ আসে । কিছুটা ভয় পেলেন শিবরাম । বহরমপুর জেলের ভারি দুর্নাম । আস্ত একটা পাগলা গরাদ বলে শুনেছিলেন তিনি । পরে জানতে পারেন , সে জেলে বন্দি আছেন বিদ্রোহী কবি নজরুল । শিবরামের সব ভয় উবে গেল নিমেষে । বহরমপুর জেল শিবরামকে আপন করে নিলো । নজরুলের স্বভাবভঙ্গিমায় কয়েদখানা হয়ে উঠল আস্ত এক সাহিত্যের মজলিশ । নাচ গান তো আছেই আর ছিল নজরুলের হাতের রান্না । যা ভীষণই পছন্দ ছিল শিবরামের । পরবর্তীতে তিনি লিখেছিলেন , 
' ' মনে পড়লে এখনও জিভে জল সরে । নিজেকে সজীব বোধ করি ! আর জেলখানার সেই খানা । আহা ! আমি তো বহরমপুর জেলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত টিঙটিঙে রোগা ছিলাম । তারপর দুইবেলা কাজীর খানা খেয়ে এমন মোগলাই  চেহারা নিয়ে বের হলাম যে আর রোগা হলাম না । ' ' 

কবির সঙ্গ থাকতে থাকতে সাহিত্যের প্রতি আকর্ষন অনুভব করেন শিবরাম । জেলে  থাকাকালীন বেশ কিছু কবিতা লেখেন । চুম্বন বলে একটি কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন ঋষি অরবিন্দ ঘোষের ভাই প্রখ্যাত বিপ্লবী বারীন্দ্রনাথ ঘোষের বিজলী পত্রিকায় । বিজলী ছাপেনি লেখাটি , সে বিষয়ে কথা বলতে দফতরে গেলে তাঁকে একটু অপমানিত হতে হয় । পরে কবিতাটি ছাপা হয় বিখ্যাত ' ভারতবর্ষ' পত্রিকায় । কবিতাটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলা সাহিত্য অন্যান্য বিখ্যাত লেখকদের মতই শনিবারের চিঠির সম্পাদক সজনীকান্ত দাশ বেনজিরভাবে শিবরামকে আক্রমণ করেন , রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন শিবরাম চক্রবর্তী । তারপর শুধু লিখতেই থাকলেন তিনি । রেখে গেলেন   অমর সব কৃতিত্ব  । 


আরিফুল ইসলাম সাহাজি 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।