ইসলাম ফোবিয়া থেকেই বার বার গণহত্যার শিকার হচ্ছেন মুসলিমরা । ।
আরিফুল ইসলাম সাহাজি
টানা মিনিট সতেরো রীতিমত ফেসবুক লাইভ করে সেনার পোশাকে হাজার হাজার দর্শকের সামনে বিদ্বেষপূর্ণ কুরুচিকর মানসিকতার এক নৃশংস হত্যাকারীর বীভৎসতায় হৃদয় কেঁপে উঠল । বিশ্ববাসী স্তম্ভিত হয়ে সেই নির্মমতার সাক্ষী রইলেন , শেয়ার লাইকের মধ্যে দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের মোবাইল ল্যাপটপে পৌঁছালো চোখের নিমেষে । হাতে সেমি অটোম্যাটিক রাইফেল , মসজিদের একঘর থেকে অন্য ঘরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এক নরখাদক । নামাজরত মুসুল্লিরা হঠাৎ মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অসহায়ের মত এদিকে ওদিকে ছুটতে লাগলেন । হত্যাকারীর হৃদয় মুসলিম বিদ্বেষে ভরপুর , এত রক্ত দেখেও কাঁপলো না তার কঠিন হৃদয় , অবিশ্রান্তভাবে বুলেট তাগ করল নিরীহ মসজিদে জুম্মাহের নামাজ পড়তে আসা শান্তিপ্রিয় মানুষগুলোর উপর । সোশাল মিডিয়াও বসে থাকল ঠুঁটোজগন্নাথের মত , থামাতে পারল না , এই নিষ্টুর হত্যাযজ্ঞের লাইভ স্ট্রিম ।সমালোচনার মুখে মার্ক জুকারবার্গের ফেসবুক , সেটা স্বাভাবিকও বটে । প্রশ্ন উঠছে কিভাবে এমন নারকীয় হত্যাযজ্ঞের লাইভ ভিডিও ফেসবুকের স্ক্যানারকে ফাঁকি দিল ? নজরদারি দলের ভূমিকা মোটেও সন্তোষজনক নয় । যদিও পরবর্তীতে বীভৎস সেই ভিডিও দৃশ্য এবং হত্যাকারীর ফেসবুক আই.ডি সরিয়ে দিলেও ততক্ষণ অনেকেই ডউনলোড করে ফেলেছেন । বিশ্ব দেখলো এক নিষ্টুর হত্যাযজ্ঞ । সারি দিয়ে বাড়লো রক্তমাখা মানুষের লাশের স্তুপ । রীতিমত নজিরবিহীন ইস্তাহার এবং ফেসবুক লাইভ স্ট্রিমিং করে এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ যে ঘটালো , সেই নরখাদকের নাম ব্রেন্টন ট্যারান্ট । আদতে সে একজন অস্ট্রেলিয়ান ।
হামলার অল্পকিছুক্ষণ আগে হত্যাকারী জঙ্গি তার নিজের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে রাইফেলের ছবি এবং ইস্তেহার পোস্ট করে । ৭৪ পাতার এই ইস্তেহারের প্রতিটি অংশে , প্রতিটি শব্দের মধ্যে রয়েছে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রতি তার ঘৃণা ও বিদ্বেষ । মুসলিমদের হত্যা করা কতটা জরুরি সে বিষয়েও যুক্তি পরযুক্তি দিয়ে সে সাজিয়ে শব্দের মালা । মুসলিমদের প্রতি চরম বিদ্বেষ , উস্কানি এবং আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করার জন্যই তার এই হামলা । হামলা কার্য চালানোর জন্য সে গুরুর আশীর্বাদ চাওয়ার প্রসঙ্গও উল্লেখ করেছে , সেই গুরুও তার মত এক নৃশংস গণহত্যাকারী নরওয়ের কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী অ্যান্ডাস । হত্যাকারী জঙ্গি ব্রেন্টনের প্রতিবেশী এক মহিলার দাবি , বাবার ক্যান্সারে মৃত্যুর পর , বিশ্বভ্রমনে বার হয় সে , দীর্ঘ সাত বছরে বিশ্বের একাধিক দেশ ভ্রমন করে । ওই পর্বেই তার মুসলিম বিদ্বেষ চরম আকার নেয় ।বছর দুয়েক আগে সে নিউজিল্যান্ডে আসে । দীর্ঘদিন ধরে সে এই নির্মম হত্যাকান্ডের নীল নকশা করছিল , এবং তিনমাস আগে ক্রাইস্টচার্চ মসজিদকে সে হামলার ক্ষেত্রে হিসাবে বেছে নেয় । মসজিদকেই বা কেন বাছলো জঙ্গি , তার পিছনেও ছিল তার সুপরিকল্পিত উদ্দেশ্য , হত্যাকারীর দাবি , সে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিল মুসলিমরা কোন জায়গাতেই নিরাপদ নয় । মনের মধ্যে কতটা ঘৃণা ও বিদ্বেষ থাকলে মানুষ এমন নৃশংস হতে পারে । রক্তে ভাসল মসজিদ প্রাঙ্গণ , নামাজ আদায় করতে আসা মুসুল্লিদের আর্তনাদে কাঁপলো পুরো বিশ্ব , কিন্তু থামলো না জঙ্গি ব্রেন্টনের বুলেট । হত্যাকারীর বিবেক নিয়ে প্রশ্ন তোলা বৃথা , মানুষ্য চামড়া থাকলেও সে যে মানুষ নয় , এ বিষয়ে দ্বিমত থাকার কথা নয় । ওকে পশু বলে , তাদের অপমান করাও সমচিত নয় ।
' দ্য গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট ' নামে নিজের ইস্তেহারকে আখ্যা দিয়েছে হত্যাকারী । যার শুরুটা হয়েছে ডিলান টমাসের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে , ' ডু নট গো জেণ্টল ইনটু দ্যাট গুড নাইট ' , তবে একেবারেই জেণ্টল নয় এই নরখাদক ব্রেন্টন । সুস্থ নিউজিল্যান্ডকে রক্তের চাদরে মুড়ে দিল সে । মারা গেছেন ৪৯ জন , মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়বে বলেই মনে হয় । গুরুতর আহত আরও অনেকেই । হত্যাযজ্ঞের প্রধান হোতা ব্রেন্টন হলেও তারা ছিল মোট তিনজন । ঘটনা চক্রে মাত্র ৫০ গজ দূরেই ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বাস । সৌভাগ্য ক্রমে তাঁদের সকলের নিরাপদে থাকা নিঃসন্দেহে এক বিরাট প্রশান্তির বিষয় । শহরের ঠিক মধ্যপ্রান্তে অবস্থিত দুই মসজিদ , লিনউড ইসলামিক সেন্টার এবং আল নুর মসজিদে । লিনউড মসজিদের হত্যাকাণ্ডে মারা গেছেন কম করে ১০ জন নিরীহ মুসুল্লি এবং আল নুর মসজিদে মারা গেছেন কম করে ৩০ জন নামাজ আদায় করতে আসা মানুষ । ওই মসজিদেই নামাজ পড়তে যাওয়ার কথা ছিল গোটা বাংলাদেশী ইউনিটের । সৌভাগ্যের বিষয় , জঙ্গি হামলার সময় পুরো টিম বাসের মধ্যে থাকায় বরাদজোরে বেঁচে গেছেন ।
অনলাইনে হত্যাযজ্ঞের যে ভিডিও সন্ত্রাসবাদী আপলোড করেছে , তা প্রথম দর্শনে অনেকেরই ভিডিও গেম বলে ভ্রম হতে পারে । পুরো হত্যাযজ্ঞের সময় সে ছিল অসম্ভব সাবলীল , ক্লান্তিহীন , অবিশ্রান্ত । মৃত্যুর হাত বাঁচতে অসহায় মানুষগুলোর হুড়মুড় ছোটাছুটি চিৎকার , আর্তনাদেও সে নির্মম , কর্মে অবিচল থেকে নিজেকে নিয়ে গেছে দানবের পর্যায়ে । ভিডিওটি চাক্ষুস করেই বোঝা যায় বিষয়টি দীর্ঘদিনের পরিকল্পনাজাত এবং হত্যাযজ্ঞের বিষয়টি ধারণ করাও তাদের পরিকল্পনার অংশ । হত্যাযজ্ঞে রীতিমত ছাপ রাখতে চেয়েছিল হত্যাকারী , ' দ্য গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট ' তার যে ইস্তেহার , সেটা মূলত একটা জঘন্য সাফাই । এমনকি হামলার আগের রাতেই সে একটা হাড় হিম করা পোস্ট দিয়েছিল , পোস্টটি ছিল এই রকম , ' দখলদারদের উপর হামলা করবো এবং সেটা ফেসবুকে লাইভস্ট্রিম করবো । ' সাল ২০১১ তে নরওয়ের ইউটোয় দক্ষিণপন্থী হামলায় ৬৯ জন নিরীহ মানুষ নিহত হন । সেই গণহত্যার কলঙ্কজনক অধ্যয়ের নায়ক অ্যান্ডাস ব্রেইভিকের সঙ্গে যোগ ছিল লিনউড ইসলামিক সেন্টার এবং আল নুর মসজিদের মুসুল্লি হত্যাকারীর । ব্রেইভিককে সে তাত্ত্বিকগুরু বলে সম্বোধন করে হত্যাযজ্ঞের আগে আশীর্বাদও চেয়েছিল ।
শ্বেতাঙ্গদের পিতৃভূমি ইউরোপে অন্যরা বিশেষ করে মুসলিমরা কেন থাকবে ? এই ভয়ঙ্কর বিদ্বেষে পরিপূর্ণ ছিল হত্যাকারীর হৃদয় । সেকারণেই মসজিদে মুসলিমদের উপর এই নির্মম হত্যাকান্ড সে ঘটিয়েছে , এতে অভিবাসন কমবে একই সঙ্গে দখলদারদের উচিৎ শিক্ষা দেওয়া যাবে বলে তার বিশ্বাস । যদিও সন্ত্রাসবাদীর কোন ধর্ম হয় না , তবুও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি আরও একবার প্রমাণ করলো , সন্ত্রাস গণহত্যার বুলেটের লক্ষ্য হয়ে উঠছেন ক্রমশঃ ইসলাম ধর্মের মানুষজন । বিষয়টি অনেকেই ইসলাম ফোবিয়া পোশাকি নামে আখ্যায়িত করে থাকেন । অনেকেই ইসলাম ও সন্ত্রাসবাদকে সমান্তরাল মনে করেন । তবে নির্মম সত্য বিষয় হলো , ইসলামধর্মাবলম্বীরাই সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাসে জর্জরিত । রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হোক বা এমন কোন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় বার বার । রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞের মত সুসংগঠিত , রাষ্ট্র দ্বারা পরিচালিত হত্যাযজ্ঞের ভিডিও ক্লিপগুলো দেখলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয় । কমিউনিষ্ট চীনও উইঘুরদের উপর যে নির্মম নির্যাতন এবং হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করছে সেটাও নির্মম এবং ধিক্কার যোগ্য । কমবেশি প্রায় প্রতিটি অমুসলিম দেশে ইসলাম বিরোধী বিদ্বেষের শিকার হচ্ছেন মুসলিমরা , হত্যা , ধর্ষণ এবং সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে তাঁদের । বীতশ্রদ্ধ হয়ে শোয়েব আকতার যথার্থই প্রশ্ন তুলেছেন , ' আমরা কী মসজিদেও নিরাপদ নয় ? ' ।
আরও একটা বিষয় প্রকটিত হল এক্ষেত্রেও , যেটা প্রায় স্বাভাবিকই একটা প্রবণতা হয়ে উঠেছে , বিষয়টি এমন হামলাকারী যদি হয় মুসলিম , তাহলে সন্ত্রাসবাদী , জঙ্গি ইত্যাদি চোখা চোখা শব্দবন্ধের প্রয়োগ ঘটান বিশ্বনেতা সহ মিডিয়ার তাবড় রথী মহারথীগণ । তবে হামলাকারী যদি অন্য কোন ধর্মের প্রতিনিধি হয় , তাহলে তাকে বন্দুকবাজ বলে চিহ্নিত করার একটা প্রবণতা কয়েক দশক থেকে ব্যাপকভাবে লক্ষগোচর হয়ে উঠেছে ।চূড়ান্ত শাস্তি থেকে বাঁচানোরও চেষ্টা করা হয় অনেকক্ষেত্রেই , মানসিক অসুস্থতাই ভুগছিল এমন হাস্যকর দাবি পেশ করতেও দেখা যায় । নিউজিল্যান্ড মসজিদ হামলাতেও হয়তো ব্যতিক্রমী কিছু ঘটবে না , ইতিমধ্যেই বন্দুকবাজ বলেই তাকে চিহ্নিত করা হচ্ছে । মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের করা টুইটটি লক্ষ্য করলেই বিষয়টি পরিস্কার বোঝা যাবে , ট্রাম্প তাঁর টুইটে লিখেছেন , ' ভয়াবহ শিহরণ জাগানো হত্যাকাণ্ড ' , ঠিকই তো লিখেছেন ট্রাম্প , তাহলে বিশ্বজুড়ে তাঁকে সমালোচিত হতে হচ্ছে কেন ? অবশ্যই নেপথ্যে কারণ রয়েছে । ট্রাম্প সাধারণত কোন হামলার প্রতিক্রিয়া জানাতে ' টেরর বা টেররিস্ট ' শব্দবন্ধের প্রয়োগ করেন । আবার হামলাকারীর পরিচয় মুসলিম হলে ট্রাম্পের টুইটের ভাষাও হয় বেশ কড়া এবং হুঙ্কারযুক্ত , সেক্ষেত্রে তিনি ' ইসলামী টেরোরিজম ' , শব্দবন্ধের প্রয়োগ ঘটান । তবে যেহেতু এক্ষেত্রে হামলাকারীর পরিচয় ভিন্ন , শ্বেতাঙ্গ খ্রিষ্টান , সেকারণেই ' টেরর বা টেরোরিজম ' শব্দবন্ধের ধারে কাছেও গেলেন না তিনি ।
এত বড় একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা নিশ্চয় মাত্র তিনজনের পক্ষে ঘটনা সম্ভব নয় , এর পিছনে নির্ঘাত রয়েছে কোন অ্যান্টি মুসলিম সন্ত্রাসবাদী সংঘটন । তদন্তে সেসব উদঘাটন ঘটবে কীনা সময় জানে , তবে সন্ত্রাসবাদী , জঙ্গি এই শব্দবন্ধে যেন মুসলিমদের কপিরাইট রয়েছে , যদিও মুখে বলা হয় সন্ত্রাসবাদীর কোন ধর্ম নেই , তারপরও তদন্তের নামে সেই সন্ত্রাসবাদীর সঙ্গে নামমাত্র যোগাযোগ আছে এমন ব্যক্তিদেরকেও হেনস্তা করতে ছাড়া হয়না । সেই কালপিট যদি কোন মাদ্রাসাতে পাঠ গ্রহন করে তাহলে তো কথায় নেই , উদোরপিন্ডি বুধোরপিঠে চাপিয়ে নিরাপদ মানুষ জনকে নির্যাতন করার একটা নতুন ট্রেন্ট চালু হয়েছে । এই প্রবণতাকেই ইসলাম ফোবিয়া বলে আখ্যা দেন বিশেষজ্ঞগণ । অর্থাৎ ভয় , ইসলাম ধর্মের জনপ্রিয়তা , ইসলাম গ্রহনের প্রবণতা এবং আগামী কয়েক দশকে ইসলাম ধর্মনুসারিরাই হবেন সংখ্যাগুরু , এইসব ভয় থেকে তৈরি হচ্ছে বিদ্বেষ , জন্ম দিচ্ছে অত্যাচার করার মত অনগ্রসর মানসিকতার , সে অত্যাচার যেমন রাষ্ট্র দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে , তেমনি একাধিক অ্যান্টি মুসলিম মানসিকতার সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি সংঘটন গুলোর বুলেটের লক্ষ্যবস্তুও হয়ে উঠছেন নিরীহ মুসলিমরা । ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন