অপসময়ের পঙ্কিলতার সঙ্গে দেশপ্রেম আর ব্যক্তিজীবনের অনুপম আলেখ্য , কবি অনিরুদ্ধ আলি আকতারের কবিতার বই , এক একুশ এবং এখন ।
আরিফুল ইসলাম সাহাজি
' ' মৃত্তিকালগ্ন আমি গ্যালাক্সির অপরিমেয় দূরত্বে থেকেও তোমারই অধরা উষ্ণতায় পুড়ে যাই অনুক্ষণ /অহমবিষ্ঠা গায়ে মেখে সং সেজে ভক্তি ধ্বজা উড়িয়ে যে পথে চলেছি , তার অন্তিমে অবশম্ভাবীভাবে তোমার দেখা পাবো । ' '
ঈশ্বর সম্পর্কে কবির ধারণা বেশ প্রগাঢ় । ঈশ্বরের অবস্থান শুধুই মন্দির মসজিদের চারদেওয়ালের মধ্যে , এ বদ্ধধারণাই বিশ্বাস রাখতে পারেন না কবি । ঈশ্বর সসীম এবং উন্মুক্ত , ' স্বর্ণরথ ' শিরোনামের কবিতায় কবি বলিষ্ঠভাবেই উচ্চারণ করেন ,
' ' প্রণতি জানিয়ে ছিলাম , রাজপথের স্বর্ণরথ পানে চেয়ে । হায় ! একি ভুল !
হে নাথ , তোমার আসন সেথায় নয় !
পথের ধূলায় , ঝরা পাতায় যে সঞ্চিত ধন আছে
সেথায় তোমার ঐশ্বর্য আর রত্নভান্ড সাজে ।
পাখির কণ্ঠে , ফুলের দোলায় তোমারই আনন্দ গীত বাজে ' '
ঈশ্বর সাধনা সহজসাধ্য কোন কর্ম নয় ,ধর্মবিশ্বাসেও তিনি অন্যদের থেকে পৃথক । তিনি হৃদয় ধর্মে বিশ্বাসী , কবি লিখছেন ,
' ' শোন শোন শোন ভাই
হৃদয় ব্যতীত এ মহাজীবনে আর কোন ধন নাই । ' '
ঈশ্বর প্রাপ্তির রাস্তাও তিনি পেয়ে গেছেন , পাঠককেও দিয়েছেন এক মহান মার্গদর্শন ,
কবির ভাষ্য ,
' ' হৃদয় ধর্মে একাকার সবে ব্রক্ষ্ম-খ্রিষ্ট -সাঁই
হৃদয় মাঝারে সে মহাশক্তি আপন আলয় গড়ে ' '
' একুশ ' পর্বে দেশের প্রতি ভালোবাসা , মাতৃভূমির প্রতি কবির টান অনুপম আলেখ্য হয়ে ধাক্কা দিয়েছে পাঠকের হৃদদরজায় । এক অমানুষ সময় পার করছি আমরা , দেশের মধ্যেই লালিত হচ্ছে ভন্ড দেশদ্রোহীর দল । কবি প্রতিনিয়ত অনুভব করেন , তাদের অস্তিত্ব , কবি লেখেন ,
'' রাত বাড়লেই এখন শারমেয়র দল দাপাদাপি করে , লাশকাটা ঘরে বড্ডো বেশি ভিড় জমে ,
মুক্ত শ্বাসে বেশ কষ্ট হয় আমাদের ।' '
যেহেতু সার্বিক অপসময় ,দেশপ্রেমীদেরও দেশদ্রোহী আখ্যা দেওয়া হয় । বিষয়টা বোঝাতে কবি সক্রেটিসের প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেছেন , তিনি লিখছেন ,
' ' সক্রেটিস তুমি সেতু বেধেছিলে সবুজ ও সাদায় , তবুও তুমি দেশদ্রোহী ।
তুমি স্নান করেছিলে রক্তে । ' '
নোংরা খেলায় মেতে উঠেছে দেশেরই কিছু কুলাঙ্গার ,লুণ্ঠন করছে দেশ । কবি সহ্য করতে পারেন না , তিনি আক্ষেপ করেই বলেন ,
' ' মায়ের আঁচল কাটছে ধেড়ে ইঁদুরে !
এই সোনার দেশ লুঠ হয়ে যাচ্ছে । ' '
একটা অরাজকতাপূর্ণ মুন্ডুহীন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা , হিংস্র মানুষ সব বসছে মসনদে , কবির মতে ওরা পাগল হয়ে গেছে , তিনি লিখছেন ,
' ' লোভে ওরা অন্ধ হয়ে গেছে ,
হিংসার মারণ রোগে ওদের ঘ্রাণেন্দ্রিয় অবস , তাই ওরা অমন । ' '
তবে কবি আশাবাদী একদিন ভোরের সূর্য উঠবেই , কাটবে এই ঘোর আঁধার ।তিনি লেখেন ,
' ' তবুও চাঁদ ডুবে গিয়ে ভোর হয় , পাখি ডাকে ।
অন্ধের লাঠি হতে হয় তোমাকে আমাকে । ' '
' এবং ' পর্বে কবি মরমী ভাষায় ধারণ করেছেন তাঁর ব্যক্তিজীবনের চলচিত্র । মানুষ ক্রমশ অমানুষ হয়ে উঠছেন , কলুষতায় পূর্ণ হচ্ছে হৃদয় । পৃথিবীকে শান্ত করতে কবি বেহুলার মত পাড়ি দিতে চান স্বর্গপারে , কবি লিখছেন ,
' ' বিষাক্ত নীল শরীর নিয়ে বেহুলার মতো পাড়ি দিই তবে , অমৃতলোকে ' '
সমস্তরকম অসাম্যের বিরুদ্ধেই তাঁর লড়াই , গ্রাম হচ্ছে নগর , দেশ যাচ্ছে এগিয়ে । ছেদ ঘটছে বৃক্ষগুল্মলতাদের সাথে মানব সংযোগ । এমন উন্নয়ন ও তিনি চান না , তিনি বলেন ,
' ' আমায় গাছটা পুঁততে দাও
ওটা আকাশ ছোঁবে ।
ওর গজিয়ে ওঠা সবুজ পাতার মিঠেল হাওয়ায়
পৃথিবীর সব অসুখ সেরে যাবে একদিন । ' '
এ পর্বে তিনি খুলে দিয়েছেন ব্যক্তিজীবনের সব গিঁট । তিনি প্রেমিক , তবে ব্যর্থ , প্রিয়তমাকে চিরদিনের মত ধরে রাখতে পারেননি । বিষয়টির উপস্থাপনা করেছেন কবি অত্যন্ত আবেগীভাবে । পাঠকও অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েছেন তাঁর ব্যর্থপ্রেমের আকুলতায় ,
' ' আজকে যে তুই নতুন মনের কাছে ,
সে বুঝি তোকে বড্ডো ভালবাসে !
আমার মতো তেমনি করে আদর ? ' '
তিনি ভালো , একদমই ভালো নেই , থাকবেনই বা কেমন করে , মনের মানুষ যে তাঁর দূরে থাকে অন্যের ঘরে , কবি বেদনা দেন পাঠকের অন্তরে , তিনি লিখছেন ,
' ' যেখানে প্রতিনিয়ত ধরা দিতো পালতোলা রঙিন নৌকা , একঝাঁক বুনোহাঁস যেখানে মাঝে মাঝে তাণ্ডব করতো ,
আজ সেখানে নিশুত রাতে বুড়ো পেঁচাটা মিথুন ভূলে ঝিমাচ্ছে । ' '
এই ব্যর্থতায় তাঁর অহংকার , অন্ততঃ ঘুমন্ত শরীরে হলেও তিনি একবার প্রিয়তমার স্পর্শ চান ,
' ' অনেক দিন হল , রেললাইনের পাথরের উপর আমার শরীর ঘুমন্ত ,
আয় , একবার তোর হাতের ময়ূর পুচ্ছ বুলিয়ে দে আমার বুকে ,
রক্তে প্রাণ সঞ্চার হোক আবার । । ' '
' এখন ' পর্বে কবি বর্তমান সময় পেক্ষাপটকে ধারণ করেছেন । এসেছে রাজনীতিক অস্থিরতা , ধর্মে ধর্মে বিবাদ , খুন ধর্ষণের প্রসঙ্গ । এ পর্বে কবি আপোষহীন সংগ্রামী , যেকোন ভন্ডামির বিপক্ষে তাঁর অবস্থান । সংগ্রামী মন্ত্রেই তিনি জাগাতে চান ঘুমকাতুরে মানুষকে । ধর্মান্ধদের খেলা তিনি বুঝে গেছেন , তিনি লিখছেন ,
' ' মন্দিরেতে রক্ত হোলি
মসজিদেতে লাশ ,
গির্জা এখন প্রহর গোনে
মঠের দীর্ঘশ্বাস । ' '
চারিদিকে অন্যায় আর অসাম্যের চিৎকার , ন্যায় , নীতিবোধ আজ ভন্ডদের জান্তব উল্লাসের তলে পিষ্ট । তবুও একদিন আধাঁর কেটে সকাল হবেই , এ কবির বলিষ্ট প্রত্যয় , তিনি লেখেন ,
' ' পৃথিবীটা শুয়োরের খোঁয়াড় নয় ;
শারমেয়র বাচ্ছাদের চিৎকারই শেষ সত্য নয় । শেষ সত্য তোমার - আমার ভালোবাসা । ' '
কিভাবে পৃথিবী আবার মানবিক হবে তাঁর সমধানও দিয়েছেন মানবতার কবি , তিনি সাম্যতার পক্ষে , সৌভাতৃত্বের পক্ষে ,
' ' তুমি আমি এক সারিতে
দাঁড়াই মিলে হাত ধরে ,
দুর্যোগেরই বুলেটটাকে
তাড়াই সুরে গান করে । ' '
এভাবে পুরো কাব্যগ্রন্থটি হৃদয়ের গভীরে আঘাত হানে । পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে , একগুচ্ছ প্রশ্ন জড়ো করে হৃদয়ের গভীরকোনে ।
এক একুশ এবং এখন
অনিরুদ্ধ আলি আকতার
গ্রন্থ বিকাশ
৫৯/১৩ , রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট
কলকাতা - ৭০০০০৯
মূল্য : ৬০ টাকা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন