সুন্দর ভবিষ্যের জন্য কয়েকজন ছাত্রকে মানুষ করে দিন স্যার



 

সুন্দর  ভবিষ্যের জন্য কয়েকজন ছাত্রকে মানুষ করে দিন স্যার । 


আরিফুল ইসলাম সাহাজি 



শিক্ষক মহাশয় , শব্দবন্ধটি উচ্চারণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সংগোপনে এক ঐশ্বরিক শান্তি । বাবা মায়ের পরে অতি কাছের আপনজন শিক্ষক মহোদয়গণ । একজন মানুষ ভালো মানুষ হয় সাধারণত ভালো পরিবারিক আবহ এবং বিদ্যালয়ের সুস্থ পরিবেশে অভিযোজিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ।  বিদ্যালয়ের সুস্থ স্বাস্থ্যকর পরিকাঠামোর সিংহভাগটাই নির্ভর করে শিক্ষকদের কর্মোদ্দম , জনহিতকর কর্মপ্রবাহের সামুদ্রিক সদিচ্ছার উপর । অর্থাৎ সমাজ ও দেশগঠনের নেপথ্যে অত্যন্ত কার্যকরী এবং সদর্থক অবদান রাখছেন শিক্ষক সমাজ । বিষয়টি নতুন নয় , বরং সেই তপোবন আশ্রমিক শিক্ষাব্যবস্থার সময়পর্ব থেকেই শিক্ষক মহাশয় সমাজ ও দেশের মুখ , ভালো করে বললে সঠিক দিশা দেখানোর কাজটিই করতেন । আজও যার কোনরুপ রুপান্তর ঘটেনি । যদিও গুরু শিষ্যর সম্পর্ক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার যে অপার্থিব আস্বাদ সেই সময়কাল পর্বে আজও কথিত হয়ে আছে , সেই জায়গাতে কোথাও যেন একটা হিমশীতল পরিআবহ তৈরি হয়েছে । বিষয়টি অস্বীকার করবার উপায় নেই । 

আজকে যে শিশু , আগামীতে সে পিতা । শুধু সন্তানের নয় সমাজেরও , দেশের আগামীর মানবসম্পদ । মানব সম্পদ শব্দটি যখন আলোচনায় এসে পড়ল , তখন একটা বিষয় পরিষ্কার করবার প্রয়োজন রয়েছে । সব গণমানুষই মানব সম্পদ , এমন কোন বাক্যের প্রতিষ্ঠা দেওয়া আদৈও সম্ভব ? অবশ্যই নয় । সব মানুষ মানব সম্পদ নয় ! মানব সম্পদ এমনিই তৈরি হয় , এমন ভাবলে ভুল হবে । আসলে মানব সম্পদ তৈরি করতে হয় । এই কাজটিই করেন শিক্ষক মহোদয়গণ । একটি শিশুকে সঠিক শিক্ষা , আদর্শ দেওয়ার মধ্য দিয়ে একজন ভালো মানুষ করে তুলতেই তাঁরা সচেষ্ট হন । এজন্য বলা হয় , রাষ্ট্রের ভিত্তি নির্ভর করে ক্লাসরুমের ভিতর । নির্ভেজাল খাঁটি প্রণিধান । আগামী দিনের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সঠিক দিশা তৈরি হয় আজকের শিক্ষার্থীরা কেমন শিক্ষা পাচ্ছেন , শিক্ষকরা তাদের কেমন শিক্ষা দিচ্ছেন তার উপর । বিষয়টি ব্যাখ্যাপূর্ণ করা দরকার , এখন বিদ্যালয় থেকেও অনেক কুশিক্ষা শিশুদের মজ্জাকে কুলুষিত করছে । সংবাদপত্রগুলোতে আমরা প্রায়শঃ পাশ্ববর্তী রাজ্যগুলোর বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরের খবরে বিচলিত হয়ে উঠছি । কোথাও উঁচু নিচু শিক্ষার্থী চিহ্নিতকরণে দুধের শিশুদের বিভিন্ন রকম ব্যাজ পড়ানো হচ্ছে , কোথাও ধর্মগত কারণে শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষ পৃথক করা হচ্ছে , কোন কোন জায়গায় সমাজিক দৃষ্টিকোন থেকে নিচু (পড়ুন দলিত )কলার পাতায় ভাত দেওয়ার মত ঘটনাও কিন্তু ঘটছে । বিষয়টি কিন্তু সামান্য নয় , ফল সুদূরপ্রসারী হবে , এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । বিভেদের যে শিক্ষা নিয়ে ওই শিশুগুলো বেড়ে উঠছে , তাদের ছোট ছোট হৃদয়ে বিভেদের অন্ধঘর চিরদিনের মত আবাস জমালো , আগামী দিনে এই সকল শিশুগণই হবেন দেশের পিতা । ভাবলেই , শিহরিত হতে হয় , অনাদি ভবিষ্যে আদৈও থাকবে তো ধর্মবর্ণ নিরপেক্ষতার পরিআবহ ? 


একটা সমাজিক অবক্ষয় তৈরি হয়েছে , এই বিষয়ে সন্দিহান হওয়ার কোন যৌক্তিকতা আছে বলে মনে হয় না । গুরু শিষ্যের সম্পর্কের যে গ্রাফ ভারতীয় সভ্যতার ঐতিহ্য , সেই জায়গাতেও বন্ধন হালকা হওয়ার ইঙ্গিত বেশ কিছু বছর আগে থেকেই পাওয়া গেছে । যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাফি সহ অনেক শিক্ষক মহোদয় ছাত্রের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন । বিষয়গুলোকে ব্যতিক্রমী ভাবলে সত্যকে অস্বীকার করতে হয় । গুরু শিষ্যর সম্পর্কের কোথাও যেন একটা আদলগত পরিবর্তন এসেছে । সেজন্যই ছাত্রনেতাদের উস্কানিতে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতেই ঘণ্টার পর ঘন্টা বন্দি থাকতে হয় শিক্ষকদের । হঠাৎ করে গুরু শিষ্যর সম্পর্ক যে বাঁকটি নিল , সেজন্য ছাত্রদের অবাধ্যতা কিম্বা শিক্ষকদের অগোছালো অহিতকর মানসিকতাকে এককভাবে দায়ী করলে ঠিক হবে না । এই হিমশীতল আবহ তৈরি হওয়ার জন্য উভয় তরফেরই দায় রয়েছে । আমার শিক্ষক বন্ধু একটি সুন্দর কথা বলেছিল , কথাটি এরকম , ' পরের ছেলে নিত্যানন্দ , যত যাবে গোল্লায় ততই আনন্দ । ' শুধু আমার সেই বন্ধুবর নয় , এমন আরো অনেক শিক্ষক আছেন , যাঁরা এই ধরনের আপ্তবাক্যে বিশ্বাসী হন । এমন নীচ মানসিকতার কোন মানুষ যদি শিক্ষকতার মহান পেশায় নিয়োজিত হন , তাহলে সে শিক্ষা কখনই দিশা দেখানোর কাজ করতে পারবে বলে তো মনে হয় না । গুরুকে সন্মান এবং আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করার জায়গাতে ছাত্রদের তরফ থেকে বিশেষ নিস্ক্রিয়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে । অনেকেই গুরুকে প্রতিদ্বন্দী ভেবে ভুল করে বসছে ।  তার ধারণা জন্মে গেছে গুরুকে অপমান করা যায় , তালাবন্ধ করা যায় , এমনকি গুরুর গায়ে হাত পর্যন্ত তোলা যায় ! এ আস্ফালন সমাজকে সমাজিক অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে , সে বিষয়ে অংশমাত্র সন্দেহ থাকবার কথা নয় । 


ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের এই যে অপ পরিআবহ , তার স্বাস্থ্যকর উন্নয়ন না ঘটলে , সমাজ ও দেশের আগামী ভবিষ্য ক্ষতির মুখোমুখি হতে বাধ্য । এই যে সমাজিক অবক্ষয় তার কিছুটা কালগত এবং কিছুটা কৃত্তিম উপায়ে তৈরি করা হচ্ছে , বিষয়টি সচেতন মাত্রই বুঝবেন । যে শিক্ষালয় থেকে পূর্বজগণ মানুষ হওয়ার শিক্ষা পেতেন , সেই শিক্ষালয় এখন অনেক ক্ষেত্রেই শিশু শিক্ষার্থীরা শিখছে দলিতের পাশে বসে খেতে নেই , অন্য ধর্মের মানুষের থেকে দূরে থাকবার রকমফের ফন্দিফিকির । সার্বিক এই অপসময়ে , একজন শিক্ষককে (একজন বলতে এক অর্থে নয় , সকলকার ) সত্যকার আদর্শগত মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে তার ছাত্রদেরকে । কান্ডারীর ভূমিকা পালন করতে হবে শিক্ষকদের , সেটা সম্ভব না হলে এ অধম জাতির মুক্তি নেই । শিক্ষার্থীরা খালি সাদা কাগজের মত , শিক্ষক নিজের মত প্রতিমা অঙ্কন করে নিতে পারেন । তিনি ইচ্ছে করলেই একজন সত্যকার ভালো নাগরিক দেশ উপহার দিতে পারেন , যাঁরা আগামী দিন দেশ ও জাতিকে পথ দেখাবে । আসলে , পুঁথিগত বিদ্যা থাকলেই তো  কেউ ভালো মানুষটি হয়ে যান না । প্রথাগত বিদ্যার সাথে মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেওয়াও প্রয়োজন । সত্যকার আদর্শ শিক্ষকগণ শ্রেণীকক্ষে কখনই অ্যাকাডেমিক্যাল ক্যারিকুলম শেষ করবার উদ্দেশ্যে যান না , তাঁরা ছাত্রদেরকে মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেন । বড্ড প্রয়োজন আজ এমন সব গুণী শিক্ষক মহোদয়ের । যিনি মুক্তচিন্তা করতে শেখাবেন ছাত্রদের , ভালো মন্দের পাঠ দেবেন । মানবতার ঘানিতে ঘুরিয়ে শিক্ষার্থীদের মানুষ হওয়ার পাঠ দেবেন । 
বড্ড খারাপ সময় পার করছি আমরা । আপনারা যাঁরা শিক্ষকতার মহান পেশায় নিজেদের সংযুক্ত করেছেন , দয়া করে নিজেদের সঠিক কাজটি করুন । 
পুরো দেশ আজ শিক্ষক সমাজের মুখাপেক্ষী । একটা অনুচ্চারিত শব্দ দেশমায়ের কণ্ঠে , আগামী সুস্থ ভবিষ্যের জন্য  কয়েকজন ছাত্রকে মানুষ করে দিন স্যার । 



লেখক 
আরিফুল ইসলাম সাহাজি 

আলাপন : ৭৯০৮১১৮৬০০

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।