হুজুর তুষ্টি ও নজরানা সংস্কৃতি বাইরে এসে ইসলামি সমাজ নিজেদের শিক্ষিত করে তুলুক । এই বিষয়ে কলম ধরেছেন প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
ছোটবেলা থেকে একটা ভুল কথা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি । কথাটি এইরকম , বিদ্যা বড় , না বুদ্ধি বড় ? সমাজের সাধারণত যেসকল মানুষ একটু কম শিক্ষিত কিম্বা এক্কেবারেই ' ব অক্ষর গোমাংস ' তাঁরা জোর দিয়েই বলতেন , কেন বিদ্যা বড় হবে ! বড় বুদ্ধি । তখন বিষয়টা না বুঝতে পারলেও এখন বুঝি । কথাটি যে ভীষণরকম মিথ্যা , সে বিষয়ের আলোচনায় পরে আসছি । আসলে সকলেই অতৃপ্তির যন্ত্রণা ভুলতে একটা অজুহাত খোঁজে । সেই মানুষটি অল্পশিক্ষিত হওয়ার কারণেই কিন্তু ওই কথাটির সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করছে , আর কোন উপায়ও থাকছে না তাঁর কাছে । বিষয়টি মনস্তাত্বিক । কথাটি মিথ্যা এক মিথ কথন , সেই বিষয়ে বলি - বিদ্যা এবং বুদ্ধি একে অপরের পরিপূরক । একটির অভাব , অপরটিকে প্রভাবিত করবেই । পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন , তাহলে অশিক্ষিত গণমানবের বুদ্ধির জাগরণ কী ঘটবে না ? অবশ্যই ঘটবে । তবে যথার্থ মানব সম্পদ রুপে যাঁদেরকে আমরা সাধারণত চিহ্নিত করি , সেই পরিআবহিক মাপদন্ডে অল্পশিক্ষিত কিম্বা অশিক্ষিত গণমানুষগণ নিজেদেরকে উন্নীত করতে ব্যর্থ হন । যথার্থ মানব সম্পদের সংখ্যাধিক্যর উপরই নির্ভর করে একটি জাতি দেশ রাষ্ট্র কিম্বা ধর্মের উন্নয়নের পরিমিত আবহ । যে জাতি কিম্বা ধর্ম বা রাষ্ট্র নিজ জনমানবকে যথার্থই মানব সম্পদ হিসাবে গড়ে তুলতে পারবেন , তাঁরা কিন্তু অন্যদেরকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলবেন , এই বিষয়টি বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই ।
মুসলিম গণসমাজে শিক্ষার হার বেশ খারাপ । এখন তবুও নারী শিক্ষার কিছুটা উন্নয়নের লক্ষণ দেখা যায় । তবে পুরুষ শিক্ষার হার আশঙ্কাজনক ভাবে কমছে , অবস্থার উন্নয়ন না হলে ইসলামি সমাজের মাথাব্যথার যথেষ্ট কারণ আছে । একটি কথা দৃপ্তবাক্যে বলা যায় , সংখ্যা দিয়ে কিচ্ছু হয় না । অশিক্ষিত কিম্বা অল্পশিক্ষিত জনমানব একটি জাতির উন্নয়নের প্রধান বাধা , এই কথাটি ইসলামি সমাজের কর্তাব্যক্তিদের অনুধাবন করা উচিৎ ছিল । এক্কেবারেই গ্রামীণ মুসলিম সমাজে বেড়ে উঠবার অভিজ্ঞান থেকেই বলতে পারি , অল্পশিক্ষিত মুসলিম গণসমাজের অধিকাংশ মানুষই অবৈজ্ঞানিক উদ্ভট মুন্ডুহীন চিন্তাভাবনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা রাখতে ভালবাসেন । বিষয়টিতে পাঠক আপত্তি করতে পারেন , যাঁরা আপত্তি করছেন , তাঁদেরকে কিছু সময় চায়ের মজলিশ কিম্বা কাকিমাদের আড্ডায় বসবার অনুরোধ করি । দেশ ও বিশ্ব কোনদিকে বাঁক নিচ্ছে এ বিষয়ে তাঁদের কোন মাথা ব্যথা নেই । বিরাট কোহলি ও তাঁর প্রেমিকার রসঘন প্রেমের কাহিনী , নায়ক নায়িকাদের জীবনের অলীক চর্চায় তাঁরা ব্যস্ত । রাজনীতিক দলগুলো এই অজ্ঞতার সুযোগ নেন । খুব সহজেই এঁদেরকে বশীভূত করা সম্ভব । দেশবিভাগের পর ইসলামি গণসমাজ মেধাশূন্য , নেতা শূন্য হন , সেই অবস্থার আজও কোন পরিবর্তন হয়নি । রাজনীতিক দলগুলি তাঁদেরকে প্রয়োজন মত ব্যবহার করে , দরকার মিটলে আবার ছুঁড়ে ফেলতেও দ্বিধা করে না । দরকার শিক্ষার , ওই যে বিদ্যা বড় না , বুদ্ধি বড় ? বিদ্যার থেকে বুদ্ধি কখনও বড় হতে পারে ! যাঁর মধ্যে শিক্ষা নেই , তাঁর বুদ্ধি উৎপাদনের ঘানি থেকে বুদ্ধির জন্মটাকে হবে কিভাবে ? শত্রু মিত্র চিনতে না পারলে রাজনীতিক যাঁতাকলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পিষ্টই হতে হবে বৈকী !
দেশভাগের পর নেতা শূন্য হওয়ার সুযোগে ইসলামি সমাজের মুখ হয়ে উঠেছেন মৌলভীগণ । তাঁরা অনেকেই ধর্মটিকে হুজুর তুষ্টি এবং নজরানা সংস্কৃতি পরকাষ্টা হিসাবে তুলে ধরতে চেয়েছেন । বিষয়টি দৃষ্টান্ত সহযোগে ঋজুভাবে পরিবেশন করলে পাঠক বুঝবেন । প্রায় প্রতিটা গ্রামে খুব কম হলেও চার পাঁচটি জলসা হয় এখন । জলসাকে কেন্দ্র করেই আসর জমিয়ে বসে দোকানদাররা । আমন্ত্রিত মৌলানারা উচ্চনদে ডাক ছাড়েন বেহেস্তের ( স্বর্গ )বাগানে এসে বসুন , দোকান পাঠে ঘোরাঘুরি করবেন না । প্রায় সর্বত্রই তাঁর আহ্বান বিফল হয় । জলসার মাহফিলে গুটিকয়েক সত্যিকারের ধর্মভীরু মানুষ থাকেন , বাজারে থাকেন কয়েক হাজার । সুতরাং অমৃত ধর্মবাণী শুনবার অভিলাষে ধর্মীয় জলসার উপস্থাপন করা হলেও অনেকাংশে তা মেলায় পরিণত হয় । আক্ষেপের বিষয় , কোন আমন্ত্রিত মৌলানা বলেন না , ধর্মীয় জলসা এবং মেলা প্রতিশব্দ নয় , যেকোন একটি বেছে নিন । এমন করলে আমাকে আর আমন্ত্রণ করবেন না । বলেন না , হয় ধর্মীয় জলসা দিন , নয়তো মেলা । কেন বলেন না জানেন ! বললে তাঁর নিমন্ত্রণের ডায়েরি কয়েকটি পাতা খালি রয়ে যাবে যে । আরও তো অনেক মৌলানা আছে , তাঁরা বলুক না । আসলে তিনি স্বঘোষিত ধর্মের ধারক হলেও সত্যকার ধর্মপ্রীতির লক্ষণখানি প্রহেলিকার চাদরে জড়িয়ে রইল । অর্থ , লোভ , যশকেই তিনি প্রধান্য দিলেন । সত্যই তো লোক ধর্মীয় জলসা না শুনলে তিনি করবেন টা কী ?
আগেই উল্লেখ করেছি , একটি গ্রামে কম করে হলেও এখন চার থেকে পাঁচটি ধর্মীয় জলসা হয় । একটি ধর্মীয় জলসার খরচ প্রায় লক্ষাধিক । খরচের বিষয়টা খোলসা করা নিই , না তো উপস্থাপিত বিষয়ের খেই হারিয়ে যেতে পারে । একটি জলসাতে এখন কম করে চারজন হুজুর থাকেন । সবাইই আল্লাহ , আল্লাহের রসুল নিয়ে আলোকপাত করবেন । তবুও , হুজুরদের মর্যদার উপর নিচ ভেদ আছে , পারিশ্রমিকের তারতম্য আছে । কেউ উচ্চ মর্যদাবান হুজুর , কেউ বা মাঝারি মাপের , বাকিরা সব জেনারেল কাস্টের । উচ্চ মর্যদাবান হুজুরদের কদর সবচেয়ে বেশি । তারপর মাঝারি মাপের হুজুরদের কদর আর জেনারেল হুজুরদের কদর তেমন নেই বললেই চলে । যাদের বাজেট কম তারা উচ্চমর্যদাবান ও মাঝারি মাপের হুজুরদের পাশাপাশি জেনারেল হুজুরদের আনেন ধর্মীয় জলসাই বৈচিত্র আনতে । ভাবস্রোতে আরও একটু গতি দেওয়ার পূর্বে নিজের অবস্থান আর একটু পরিস্কার করে নিই , ধর্মীয় জলসার বিপক্ষে আমার অবস্থান নয় । অর্থলোভী কিছু মৌলানার বিরুদ্ধে আমার লেখ্যভূমির কষাঘাত । যাঁরা ধর্মটাকে ব্যবসার জায়গাতে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন । মাত্র একঘন্টা ধর্মীয় জলসা করবেন , অনেকে আবার তাও করেন না , তারপরও জলসা কমিটিকে দিতে হয় ১৫/২০ হাজার টাকা । তিনি আবার একই সঙ্গে তিন তিনটে জলসায় আমন্ত্রিত । অর্থাৎ এক রাত্রে তিনটে জলসা , সব মিলিয়ে ১৫ হাজার করে ধরলে ৪৫ হাজার । আপনি বলতে পারেন তাতে আপনার কিসের ক্ষতি ! আমার কোন সমস্যা নেই , একদল দিচ্ছে , আর একদল নিচ্ছে এটা তাদের ব্যপার । কিন্তু সমস্যা বাধে তখন যখন ২০ হাজারী হুজুর একটি বিতর্কিত কথা বলে বসেন ,ভক্তদের মাঝে দল বিভক্ত হয়ে রক্তক্ষয়ী অবস্থা তৈরি হয় সেই সময় । যদিও ইসলাম ধর্মের ভিতরের বিষয়গুলো সম্পর্কে খুব বেশি জ্ঞান অর্জন করতে পারেনি , তবুও যতটুকু জানি তাতেই গলা ছেড়ে বলতে পারি , ইসলাম ধর্মের সঙ্গে অর্থের এমন হ্যাংলাপোনা একেবারেই বেমানান , অসামঞ্জস্যপূর্ণ । ইসলামী ইতিহাসের ঘটনা পরস্পরার যে শিক্ষা পেয়েছি সেগুলোতে দেখেছি ধর্মের সত্যকারের সাধকগন রাজপ্রাসাদ , অট্টালিকা ছেড়ে গেছেন সত্য সন্ধানে । নবী মুহাম্মদ স. এর যে জীবনকথা আমরা পড়েছি , সেখানে দেখা যায় তাঁর জীবদ্দশায়ই ইসলামী সম্রাজ্য অর্ধপৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল । মুহাম্মদ স. অর্ধপৃথিবীর অধিশ্বর , অথচ তাঁর জীবনচক্রের দিকে অভিনিবেশ করলে দেখতে পাই এক নির্মোহ ঋষির জীবনাচরণ । দিনের পর দিন অর্ধপেটে , কোন কোন দিন না খেয়েও কাটিয়েছেন । কিসের অভাব ছিল তাঁর ? বায়তুল মাল (ইসলামী সম্রাজ্যের রাজকোষ )তখন সম্পদের পাহাড় । তিনি চাইলে কী তা গ্রহন করতে পারতেন না । কিন্তু তিনি দুনিয়া চাননি , তিনি চেয়েছিলেন আখেরাত (মৃত্যুর পরবর্তী কাল )।খুব বেশি ইসলামী শাস্ত্রে জ্ঞানী না হলেও নবী মুহাম্মদ স. এর জীবনকথা থেকে এটুকু প্রমাণ হয় , অর্থই অনর্থের কারণ ।অন্ততঃ ইসলাম ধর্মের সঙ্গে অর্থের যোগ খুব বেশি নেই । বরং বলা হয় , একজন ধনী মানুষের অনেক আগেই একজন গরীব মানুষ বেহেস্ত (স্বর্গ )লাভ করবেন ।
বড় বড় যেসমস্ত হুজুর আছেন তাদের বাড়ি ঘর গুলো দেখলে মনে হবে তাজমহলের আদলে তৈরি । আপনি বলবেন , তাতে আপনার সমস্যা কী ? আমার কোন সমস্যা নেই । যার টাকা আছে তিনি তাজমহল কেন বুর্জ খলিফার থেকেও বড় বাড়ি বানাক না সেটা তাঁর একান্ত নিজস্ব ব্যপার । তবে সমস্যা বাধে তখনই , যখন সেই তিনিই ধর্মীয় জলসায় এসে বলেন , কবর তো মাটির , কী হবে ভাই ঘরবাড়ি । ভীষণই অবাক হয় , আমাদের জন্য এক আর উনার জন্য আল্লাহর নিয়ম আলাদা নাকি ? এবার আসুন মুসলিম সমাজে প্রবল প্রচলিত নজরানা সংস্কৃতির দিকে আলোকপাত করা যাক ,
হুজুরকে নজরানা দেওয়ার একটা সংস্কৃতি এখন চালু আছে মুসলিমদের মধ্যে । অর্থাৎ কিছু অর্থ , সম্পদ দিয়ে হুজুরকে খুশি করা । খুশি হলেই হুজুর আপনার মাথায় হাত বোলাবেন , ফুঁ দেবেন । আমার অনেক বন্ধুরা পরীক্ষা স্বরুপ , টাকা পয়সা ছাড়াই হুজুরের সঙ্গে মোসাফা করেছে । তাঁদের কাছে যতটুকু শুনেছি , তাতে যাঁরা টাকা দিচ্ছেন সেই ভক্তদের জন্য যেমন স্পেশাল ফুঁ , যাঁরা টাকা দিচ্ছে না , তাঁদের জন্য রেডিমেড ফুঁ । বুঝি না , বাড়ির পাশের প্রতিবেশীদের মধ্যে অনেকেই ক্যন্সার সহ অন্যন্য দুর্জ্ঞেয় ব্যধিতে আক্রান্ত , অর্থের জন্য চিকিৎসা হচ্ছে না , আবার অনেক কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা রয়েছেন যাঁরা পনের টাকা জোগাড় করতে পারেন না , অনেক দরিদ্য মানুষ আছেন যাঁদের ক্ষুধার চোটে চোখ ফেটে জল নামে তাঁদেরকে এক পয়সা সাহায্য করি না । অথচ হুজুরের হাতে গুঁজে দিই পাঁচ ' শ , হাজারের কড়কড়ে নোট । হুজুর কী ভিখারি নাকি ? হুজুরের এত টাকার কিসের দরকার ? সত্যকার দরকার আমার প্রতিবেশী ওই সমস্ত অসহায় মানুষগুলোর অর্থের অভাবে যাঁদের কাছে পূর্ণিমার চাঁদ মনে হয় ঝলসানো রুটি । আমরা কবে বুঝবো এই সত্যবাক্যখানি । কবে বুঝবো ইসলামে সঙ্গে অর্থের যোগ সমান্যই , আবার অর্থলোভী মানুষও কখনও ধর্মের ধারক নন । অন্ততঃ , ইসলাম ধর্মের পয়গম্বর , খলিফা , পীরদের দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে । তাঁরা কেউ অর্থের পিছনে পাগলের মত ছোটেন নি , বরং অর্থের মোহ থেকে ছুটে পালিয়েছেন । আপনার তো দরকার , ইসলামী শাস্ত্রজ্ঞান , সেজন্যই তো ধর্মীয় জলসার আয়োজন । সেজন্য মসজিদের ইমাম সাহেব এবং অন্যন্য অল্প কয়েকজন বক্তা আছেন স্বল্পমূল্যে ধর্মবাণী বিতরণ করেন , পারলে তাদের কাছে বসুন । কেন ২০ হাজারী বক্তার জন্য এত হাহাকার করবেন ? ওই টাকাটা দিয়ে মসজিদে ইসলামী ধর্মের শাস্ত্রের বই কিনে একটা লাইব্রেরি করুন , দেখবেন জ্ঞানচক্ষু খুলে যাবে । তখন এমনিতেই অর্থলোভী ধর্মের ঠিকেদারগণ ব্যবসা গুঁটিয়ে অন্য কাজে মন দেবে । ।
লেখকের এই প্রবন্ধটি পূর্বে দৈনিক একদিন এবং স্টেটসম্যান এ প্রকাশিত ।
লেখক
আরিফুল ইসলাম সাহাজি
৭৯০৮১১৮৬০০
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন