বিভেদ নয় , আসুন সকলে মিলেমিশে কাছাকাছি থাকি। এই বিষয়ে লিখছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।




ধর্মান্ধ একপ্রকার ব্যধি । অন্ধ ভক্তির যাচ্ছেতাই রকম পাগলামি । ধর্মান্ধ গোত্রভুক্তদের স্বধর্মের প্রতি যেমন চূড়ান্ত রকম আস্থা , তেমনি পর ধর্মের উপর তাদের মারাত্মক অশ্রদ্ধা লক্ষ্য করা যায় ।  হঠাৎ করেই আকাশ ফুঁড়ে এই ধর্মান্ধ ভক্তকুলের উদ্ভব , এমন ভাবার কারণ নেই । আদিম যুগ থেকেই এদের অস্তিত্ব ছিল । খুব প্রাচীন সময় নয় , আমরা যদি কিছু আগের ইতিহাস , অর্থাৎ আমাদের পরাধীন ভারতবর্ষের সংগ্রামের ইতিহাসকে পর্যালোচনা করি , তাহলেও বিষয়টি প্রাঞ্জল হয় । তখনকার সময় হিন্দু মুসলমান ক্ষয়রোগ এত ব্যাপক ছিল না । ছোট অথচ মহৎ একটা ঘটনা দিয়ে বিষয়টা বোঝা যেতে পারে । এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়ছেন রামপ্রসাদ বিসমিল - আসফাকউল্লা খানরা ।চমৎকার বন্ধুত্ব ছিল তাঁদের । ধরা পড়বার পর আসফাকউল্লা খানের উপর হিন্দু মুসলমান অব্যর্থ বিষবীজ প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন তাসাদ্দুক হোসেন, তৎকালীন পুলিস সুপার ।  তাসাদ্দুক চেয়েছিলেন রামপ্রসাদ বিসমিলের বিপক্ষে রাজসাক্ষী হয়ে নিজের জীবনখানি বাঁচিয়ে নিক আসফাক ,  হয়তো মুসলমান হওয়ায় তাসাদ্দুক আসফাকউল্লা খানের প্রতি কিছুটা মমত্ববোধ অনুভব করেছিল ।  আসফাকউল্লার  দেশপ্রেম ও বন্ধুপ্রীতির কাছে হার মানে  তাসাদ্দুক । স্বধর্মের ইংরেজ গোলামকে নয় , বিপ্লবী আসফাকউল্লা খান বিধর্মী বিসমিলের পক্ষাবলম্বন করে ফাঁসির দড়িতে চুম্বন করাটায় শ্রেয় মনে করেছিলেন ।  মহান দুই  বিপ্লব সাধকের বন্ধুপ্রীতি যেমন তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রধান বৃহৎ দুই সম্প্রদায়ের ঐক্যের চিহ্ন বহন করে , তেমনি সমান্তরাল ভাবেই আরও এক দল ইংরেজ বিরুদ্ধ সংগ্রাম থেকে নিজেদেরকে স্বযত্নে সরিয়ে রেখেছিল । সেই দলে যেমন হিন্দু ছিল , তেমনি মুসলমানও ছিল । স্বধর্মের মানুষের অধিকার রক্ষায় তাদের মুখ্য কর্তব্য বলে মনে হল ।  শুরু হল মহামানবের সাগরতীরে ধর্মান্ধদের যাত্রা । বিশ্বহিন্দুপরিষদ , মুসলিম লীগ , অভিনব ভারত , আর . এস . এস এর মত উগ্র ধর্মনির্ভর সংঘটনগুলো ভারতবর্ষের অহংকার সৌভাতৃত্ববোধের পবিত্র পিরামিডের উপর ধ্বংসের পেরেক পুঁততে সচেষ্ট হল । 


ধর্মান্ধদের বিচারবোধ , চিন্তাচেতনার উপর আলোকপাত করা যাক । ধর্মান্ধ অর্থাৎ ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস পোষণ করেন যিনি । বিষয়টি মোটেও খারাপ নয় । প্রায় সকল ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ বিশ্বাস করে থাকেন তাঁর ধর্ম নির্ভেজাল , ভগবান আল্লার কাছে পৌঁছানোর রাস্তা । এই পর্যন্ত ঠিক আছে । আপনি নিজের ধর্মের প্রতি গোঁড়া হতেই পারেন , সেটা একান্ত ব্যক্তিক বিষয় । গোলমাল বাধে তখন যখন কোন ধর্মান্ধ মানুষ গোঁড়া থেকে অতিগোঁড়া হয়ে ওঠেন । ধর্মীয় গোঁড়ামি যাদের মধ্যে আছে তারাই সাধারণত অতি গোঁড়া হয়ে ওঠেন । যেহেতু একপ্রকার পর্বান্তর , অর্থাৎ গোঁড়া থেকে অতিগোঁড়া , সেইহেতু তার বিশ্বাসবোধ আরও পোক্ত হচ্ছে এই পর্বে এসে । এখন সে বিশ্বাস করতে শুরু করছে , তার ধর্ম সত্য , শুধু সত্যই নয় , একমাত্র সত্য । নিজের ধর্ম সঠিক , অন্যেরটা ভূল এই ধারনা ধ্বংসাত্মক । গোঁড়ামি মন্দের ভালো হলেও অতি গোঁড়ামি চিন্তা বিপদজ্জনক । অতি গোঁড়া মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে নিয়েছে একমাত্র সেই সঠিক পথের পথিক , অন্যরা সব বিপদগামী । গাত্রদাহ অনুভব করে সে বা তারা , সকল নিজের পথে ভিড়াতে সচেষ্টতা দেখায় । ঠিক এই মুহুর্তই সে হিংস্র হয়ে উঠছে । অন্যের মত পথের মানুষদের জোর পূর্বক ধর্মান্তরকরণ , জুলুম করার রাস্তাতে দানবের মত হাঁটতে থাকছে তারা । 


ধর্মান্ধরা সাধারণত অশিক্ষিত অজ্ঞ হন বলে একটা প্রচলিত ধারণা রয়েছে । বিষয়টা পুরো সত্য না হলেও কিছুটা সত্যতা রয়েছে । শিক্ষিত ব্যক্তি ধর্মান্ধ হন না , এমন বিষয়ের প্রতিষ্ঠা দেওয়া সম্ভব নয় । এমন বহু মানুষ রয়েছেন , যারা ধর্মান্ধ অথচ উচ্চ শিক্ষিত । তবে এটা সত্য যে অধিকাংশ ধর্মান্ধ মানুষ সাধারণত অশিক্ষিত হন । বিষয়টা বোঝাতে বলবার ধরণ আরও একটু ঋজু করা দরকার । ধর্মান্ধও একটা মতাদর্শ এবং এতই উদ্ভট ও অবান্তর যে সাধারণত শিক্ষিতজনের পক্ষে তার উপর আস্থা রাখা একটু মুশকিল । গত পাঁচবছর শুদ্ধভাবে বললে আমাদের দেশে একপ্রকার ধর্মান্ধরাজ চলেছে বললে খুব একটা ভূল বলা হয়  না । তাদের অবৈজ্ঞানিক কথাবার্তা , চালচলনে বিদ্বজ্জনদের যেমন তিরস্কারের পাত্র হয়েছেন , তেমনি ট্রোল হয়েছে সাধারণের দরবারে । গোরু কেন্দ্রিক যে অকান্ডগুলো ঘটল , তা যেমনি হাস্যকর তেমনি নৃশংস । গো মুত্রের যে মহিমা ধর্মান্ধগণ বর্ণনা করেন , তা ভীষণই বিনোদিত বিষয়রুপেই গণ্য হওয়ার যোগ্য । সকলেরই জানা , তাও আরও একবার চর্বিত চরণ করা যাক , সম্প্রতি একজন কুখ্যাত সন্ত্রাসীকর্মকান্ড অভিযুক্ত মহিলা ঘোষণা দিয়েছেন গো মূত্র সেবনে তার বেষ্ট ক্যন্সারের সম্পূর্ণ নিরাময় ঘটেছে । বিষয়টা চাউর হতে সমাজিক মাধ্যমে হাসি ঠাট্টার হুলস্থুল অবস্থা । লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে কেন সরকারি হাসপাতাল সমূহ চালানো হচ্ছে , এমন প্রশ্নও অনেকেই রাখছেন । এমন অবৈজ্ঞানিক কথা যারা বলছেন , তারা নিশ্চিত অশিক্ষিত এ বিষয়ে দ্বিমত নেই । তবে এমন উদ্ভট কথা বলবার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহের রাশ থাকছেই । এক হয়  তারা একেবারেই অজ্ঞ  , না হলে মারাত্মক রকম চতুর । মূল বিষয় , যেমন  চাকরি , কৃষক অসন্তোষের মত ভয়ঙ্কর রকম অব্যবস্থা থেকে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে ঘোরাতে তারা এমন কথা বলে থাকতে পারেন । স্বদৃষ্টিভঙ্গি কুসংস্কারপূর্ণ হলেও নিজের কাছে থাকলে অসুবিধা নেই , তবে উদ্ভট বিষয়গুলো জোর পূর্বক অন্যের উপর চালালে মুশকিল । গত পাঁচবছরে গরুকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছে হত্যা , গণপিটুনির মত ন্যাক্কারজনক ঘটনা । 

ধর্মান্ধদের যেহেতু নিজ ধর্মের উপর মারাত্মক রকম বিশ্বাস , উক্ত কারণে অন্য ধর্মসমূহের উপর তাদের যাচ্ছেতাই রকমের অবজ্ঞা লক্ষ করা যায় । অনেকটাই হিটলারের উগ্র জাতীয়তাবাদের মত । জার্মানরাই শ্রেষ্ঠ , এই ধারণার বশেই পুরো পৃথিবীতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন হিটলার । আসলে যেকোন উগ্রত্বই , সে জাতীয়তাবাদ কিম্বা ধর্মবাদ যায়হোক , সবই প্রায় সমগোত্রীয় । উগ্র মতাদর্শে বিশ্বাসীদের চিন্তাজাত প্রজ্ঞানুযায়ি অন্য সম্প্রদায়ের  মানুষজন অপেক্ষাকৃত নীচ , অস্পৃশ্য । অন্যান্যদের ছোঁয়া এমনকি দেশে থাকার বিষয়টাও অনেকেরই শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে ওঠে । ভারতের এখনও এমন কিছু জায়গা রয়েছে যেখানে দলিতদেরকে মন্দিরে উঠতে বাধা দেওয়া হয় , বাবুদের থেকে উঁচু ঘর তোলা যেমন তাদের অপরাধ তেমনি উচ্চশিক্ষা , ঘোড়ার পিঠে চড়ার মত বিষয়েও বিধিনিষেধ থাকে । অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের উপরও চড়াও হয় , অত্যাচার করে উগ্র মতাদর্শের কর্তাব্যক্তিগণ । 

আসুন , এবার ধর্মান্ধতার পাশপাশি পরধর্মসহিষ্ণুতাকে রাখি । ধর্মান্ধ ব্যক্তিগণ বেশির ভাগ অজ্ঞ হন , তবে পরধর্মসহিষ্ণু হতে গেলে আপনাকে উদার হলেই চলবে , বিরাট বোঝাবুঝির কোন ব্যাপার নেই । প্রায়শই আমরা দেখি মন্দিরের জন্য জায়গা দান করছেন গ্রামেরই একজন মুসলমান লোক । এই দানটাই তাঁর উদার মননের ফল । তিনি নিজের ধর্মের প্রতি যেমন বিশ্বাসী , তেমনি অন্য ধর্মের প্রতিও শ্রদ্ধাবান । আবার কোথাও দেখা যায় ভগ্ন মসজিদ সরাইয়ে হাত লাগিয়েছেন পাশের হিন্দুরা । সেই সব মানুষগুলো উদার , ধর্মীয় গোঁড়ামি তাঁদের ভক্ত বানিয়ে তোলেনি । আসলে কোন ধর্মেই ধর্মান্ধ হওয়ার কথা কিন্তু বলেনা , একথা ধর্মবিশেষজ্ঞগণ লক্ষবার বলেছেন । অপউদ্দেশ্যে কিছু লোক ধর্মকে অপব্যবহার করে মানুষকে বিপদগামী করে তোলে । অতি ধর্মান্ধতা একটা বহুধর্মবাদী রাষ্ট্রের জন্য বিপদজ্জনক এবং কাম্যও নয় । মানুষকে উদার হতে হবে , ধর্মও একই কথা বলেছে । মানুষকে ভালোবাসতে হবে , তাঁদের বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করতে হবে । ভুললে চলবে না ' জীব সেবায় শিব সেবা ' ।



লেখক 
আরিফুল ইসলাম সাহাজি 
৭৯০৮১১৮৬০০

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।