শাশুড়ি বৌমার লড়াই , বাঙালি ঘরের এক স্বাভাবিক বিষয় হয়ে উঠছে ।এই বিষয়ে আশঙ্কার কথা শুনিয়েছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।



সমাজ বহিরঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক , তবে অন্তঃপুরে পুরুষের শাসন থাকে না বললেই চলে । সাংসারিক রোজনামাচার প্রায় সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন নারীগণ । এককথায় বললে , বহির্জাগতিক বিষয়ে পুরুষগণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলেও , সংসারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নারীগণের সিদ্ধান্তই মুখ্য হিসাবে পরিগণিত হয় । পুরুষের জীবনে মূলত নারীগণ চার রকম সম্পর্কে আবির্ভূত হন । মা - স্ত্রী -কন্যা ও বোন নারীর মূলত এই চারটি রুপ হলেও , সংসার পরিচালনার ক্ষেত্রটি মূলত থাকে মা ও স্ত্রীর হাতে । জাগতিক নিয়মেই যেখানে কতৃত্ব , সেখানেই সংগোপনে লুকিয়ে থাকে দ্বন্দ । এটাও এক ধরনের ক্ষমতার লড়াই , যা ক্ষতবিক্ষত করে সংসার নামক সম্রাজ্যকে । শাশুড়ি বৌমার এই যে দ্বন্দগত পরম্পরা হঠাৎ করেই এক সংকটময় পরিআবহের সৃষ্টি করেছে , এমনটি ভাবলে ভুল হবে । দ্বন্দগত এই পরম্পরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাঙালি মহিলা মহল বহন করছেন , এটি একপ্রকার ঐতিহ্য বটে । 

শাশুড়ি বৌমার এই দ্বন্দময় পরিবেশন তৈরি মূল কারণটি অবশ্যই মনস্তাত্বিক । এক অহেতুক আশঙ্কা এবং ঈর্ষা রয়েছে এর মূলকথনে । সংসারের চাবি থাকবে কার আঁচলে ? এই দ্বন্দের মূল প্রশ্নই এটি । বিষয়টিকে ব্যাখ্যাপূর্ণ করে ভাবনার গভীরে তলিয়ে যাওয়ার পূর্বে বিষয়টি ঋজু করে পরিবেশন করা দরকার । সংসার অন্তঃপুরের প্রধান মুখ হলেন মা , তিনি বহু পরিশ্রম করে দাঁড় করান একটি সংসার । স্বামী পুত্র কন্যা নিয়েই চলে তাঁর সুখ গুজরান । কন্যা সন্তানকে বিবাহ দেন আনন্দেই , তবে পুত্র সন্তানকে বিবাহ দেওয়ার সময় তিনি আতঙ্কিত থাকেন । সংসারে একজন প্রতিদ্বন্দীর আবির্ভাব ঘটে । তিনি এরপর সাধ্যমত চেষ্টা ফিকির করতে থাকেন , কিভাবে সংসার হেঁসেলের চাবিটি রাখবেন নিজের কাছে । এইটুকু মা , অর্থাৎ বাঙালি শাশুড়ি মা'দের দৃষ্টিজাত অভিজ্ঞান , বলে রাখা উচিৎ সবক্ষেত্রের মত , এ বিষয়েও ব্যাতিক্রম আছে । এবার আসুন , নববধূ যাঁরা একটি সংসারে আসছেন নতুন মানুষ হিসাবে তাঁদের দৃষ্টিকোন থেকে দেখা যাক বিষয়টি । প্রথমেই পরিষ্কার করা দরকার , শাশুড়ি মা'রা যে সময়পর্বে সংসারে বধূ হিসাবে এসেছিলেন , সেই সময়কার মহিলাদের মানস গঠনের সঙ্গে বর্তমান সময়ের তরুণী নারীগণের মানসজাত গঠনের আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে । ফলস্বরূপ শাশুড়িগণ বৌমাদের সঙ্গে নিজেদের সময়কার সময়কে মেলাতে পারেন না । শাশুড়ি একটা খুব পরিচিত কথনের সঙ্গে পাঠকের আলাপ থাকবে , কথাটি এমন - ' আমরাও তো বৌ ছিলাম , আর এখনকার এঁরা ' । নিজেদের সঙ্গে বৌমাদের মেলাতে হিমশিম খাওয়ার পিছনে কালের কারসাজি রয়েছে অনেকটাই । তখনকার সময়ের থেকে এই সময়ের ভাবনাগত পরম্পরার অনেকটাই পরিবর্তন ঘটেছে । সেই সময়ের নারীগণ অনেকটাই ছিলেন অন্তপুরবাসিনী , তবে বর্তমানে সেই বন্ধনের আগল অনেকটাই শিথিল হয়ে গেছে । নারীগণ এখন শিক্ষা সহ প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রেই পুরুষদের প্রতিদ্বন্দীতার মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে । 
সর্বঅর্থেই এই সময়ের মেয়েরা আধুনিক , শিক্ষা - সংস্কৃতিচর্চা -বৈশ্বিক ধারণা এবং বিজ্ঞান মনস্কও । সময়ের চাহিদা অনুযায়ি স্বাধীনতা বিলাসী এবং নারীবাদী চিন্তাজাত চেতনা দ্বারা তাঁদের মনজগৎ সমৃদ্ধ । এই নারীবাদী চিন্তা , অর্থাৎ নারী স্বাধীনতার পক্ষে তাঁদের সওয়াল শাশুড়ির বন্ধন থেকে মুক্তির ইন্ধন জোগাচ্ছে , বিষয়টি অস্বীকার করবার নয় । অনেকেই আবার অতিরিক্ত নারীবাদী চিন্তা দ্বারা পীড়িত , এই চিন্তার গাম্ভীর্য সংসারে ক্ষতের সঞ্চার করছে । এই পর্বে শাশুড়িদের ভাবনা সাধারণত , সংসারের চাবি আঁচলে বেঁধে তিনি ঘুরবেন , কাজ করবেন কম । এই ভাবনার পিছনে সদর্থক যুক্তি হল , এত দিন তো আমি টানলাম হেঁসেল , এবার সংসার বৌমার । পুরোপুরি সন্ন্যাস অবশ্য শাশুড়ি মা নেন না , সংসারের সকল কর্মে তিনি নিজের সিদ্ধান্তটাই চূড়ান্ত দেখতে চান । বধূদের আবার এই জায়গাতে ঘোর আপত্তি । অনেককেই বলতে শুনেছি , আমি সংসার করবো , আর আপনি ঘুরে বেড়াবেন সেটা চলছে । আসলে শাশুড়ির সন্ন্যাস গ্রহণে বৌমার আপত্তি নেই , আপত্তি চাবির গোছা সহ সন্ন্যাস গ্রহণের জায়গাতে । 
এখনকার বৌমারা অন্তপুরবাসিনী নয় , বরং অধিকাংশই শিক্ষিত । কোন রকম বন্ধন দ্বারা তাঁরা আর পীড়িত হতে চান না , অতিরিক্ত নারীবাদী চিন্তার সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করেন  । একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গেছে বেশ কয়েক দশক আগেই । নিউক্লিয় ঢংয়ে এখন গঠিত হচ্ছে অনুবীক্ষণিক পরিবার সব । পতিদেবের বাবা মাকে গ্রহণ করতেও এখন ঘোরতর আপত্তি দেখাচ্ছেন অনেক পুত্রবধূ। এই দ্বন্দগত পরিআবহে ভাঙছে বাঙালির সংসার । প্রায় শুনশান স্টেশনে , খোলা মাঠে বাবা মাকে ফেলে যাচ্ছে গুণধর ছেলেরা । 
আসলে , শাশুড়ি বৌমার সম্পর্কটা ঠিক মা মেয়ের মত না ।অনেক ক্ষেত্রে একে অপরের প্রতিপক্ষ রূপে উপস্থিতি জাহির করে ।ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে ।তবে ,ইদানিং সম্পর্কটিতে মরিচা ধরছে প্রায় ঘরে ।পুরাতনের বিদায়ের মধ্য দিয়ে ঘটে নূতনের আগমন ।সংসারে এ নিয়ম কিন্তু অচল ।নূতন পুরাতন ভাবাদর্শই সংসারের মূল শক্তি ।এই দুই আদর্শের সংঘাত ঘটলে বিপদ ।অনেকে বলেন ,নারীরাই নারীদের প্রধান প্রধান শত্রু ।সামাজিক জীবনে যতগুলো নারী নির্যাতনের ঘটনা সামনে আসে ,প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রে এই আদর্শগত বৈসাদৃশ্য মুখ্য ভূমিকা পালন করছে ।
শাশুড়ি মায়ের মত ,বৌমা মেয়ের মত এই ভাবনার বিকাশ খুব প্রয়োজন ।প্রায় প্রতিদিন বৃদ্ধ বাবা মাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে ।।বলতে বাধা নেই এখন গৃহবধূ নির্যাতনের চেয়েও বেশি অত্যাচারিত হচ্ছেন বাবা মা রা ।তবে ,বধূ নির্যাতনের ঘটনাও অপ্রতুল নয় ।সাংসারিক জীবনে নারী নির্যাতনে নারীদের ভূমিকা সর্বাধিক।পরিবর্তিত হোক এই ট্রেডিশন ।গড়ে উঠুক আত্মার বলিষ্ঠ বন্ধন ।শাশুড়ি মা ,বৌমা হয়ে উঠুক মেয়ের মত লক্ষীপ্রতিমা॥

লেখকের এই প্রবন্ধটি 25:10:19 তারিখে দৈনিক একদিন সংবাদপত্রে  প্রকাশিত । 


লেখক 
আরিফুল ইসলাম সাহাজি 
 ৭৯০৮১১৮৬০০



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।