' শিবজ্ঞানে জীব সেবা ' এই উপলব্ধিতেই নরেন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছিলেন বিবেকানন্দ । এই বিষয়ে লিখেছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি





ভারতভূমিতে  যুগে যুগে আবির্ভূত  হয়েছেন  সহস্র পবিত্র আত্মা , এই মহামানবগণের আবির্ভাবক্ষণ   আমাদের  প্রাচীন ঐতিহ্যময়ী সভ্যতাকে বারংবার দিয়েছে  গৌরবময় অমৃত আস্বাদ । ' ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে ' এই আপ্তবাক্যের অনুগত হয়েই তাঁরা দেশ ও জাতির সেবায় উৎসর্গ করেছেন স্বজীবনের সবটুকু অংশ  । প্রবন্ধটিতে এক মহাজীবনকে নিয়ে সমান্যতম আলোকপাত করবার  প্রচেষ্টা হৃদয়ের গভীর থেকেই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অনুভূত হয় এই কলমকারের , যিনি  আর্ত গণমানুষের জীবনের অমাবস্যাক্ষণে পূর্ণিমার চাঁদের মত আলোকময় করে রাঙিয়ে  দিয়ে গেছেন স্ববিবেকময় প্রভায় ।পাঠকের বোধহয় বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় , আমরা সিদ্ধপুরুষ স্বামীবিবেকানন্দের মহাজীবনের অমৃতকুম্ভের আস্বাদ নেওয়ার কথা বলছি ।

মানবতাকে মানবসভ্যতার মূল শিকড়ে শক্তভাবে প্রোথিত করবার লক্ষ্যই স্বামীজির জীবনপ্রবাহের প্রতিটা অমূল্যক্ষণ ব্যয়িত হয়েছে । আসলে তাঁর ধর্ম - দর্শন -আধ্যাত্মচিন্তার পরিমিত আবহের সবটুকু অংশ জুড়েই ছিল মানুষের কল্যাণময় জীবনের কার্পেট বিছানোর প্রক্রিয়া । স্বগুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসের ' শিবজ্ঞানে জীব সেবা ' এই অমৃত বাণীকে করে নিয়েছিলেন জীবনকর্মের বিশ্বকোষ । ঈশ্বর সেবার এই স্বরুপ উপলব্ধিই তাঁকে যোগী পুরুষে রূপান্তর ঘটালো । ঈশ্বরের  অবস্থান বিষয়ে , গুরুভাই তূরীয়ানন্দকে এক আলাপচারিতায় স্বামীজি বলেছিলেন , ' জীবে জীবে , বিশেষত মানুষের মধ্যে তাঁর অবস্থান ' । ' তাঁর ' অর্থাৎ তিনি হলেন মানুষের ঈশ্বর , পরমব্রক্ষ্ম বিশ্বপিতা । স্বামীজি অনুভব করেছিলেন , দেবতার জন্ম হয় মানুষের মধ্যেই । তিনি জীবন্ত মানুষের পূজার পক্ষপাতি । শিষ্যদের প্রতি তাঁর নির্দেশ ছিল , ' মানুষের জন্য কাজ (পূজার নামান্তর ) করে করে তোরা শেষ হয়ে যা , এটায় আমার আশীর্বাদ । ' গণমানবের উপর তাঁর সামুদ্রিক প্রেম , যা অসীমতায় গন্ডিবদ্ধ ছিল না , তা ছিল সসীম - উন্মুক্ত ।

 পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্তের প্রয়ান হওয়ার পর অর্থকষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে স্বামীজির পরিবারকে একটা সময় ।  ক্ষুধার অন্ন ভাত জোগাড় করবার পথও পুরোপুরি উন্মুক্ত ছিল না । তখনও স্বামীজি হয়ে ওঠা হয়নি নরেন্দ্রনাথের । আমার বাইরে নেমন্তন্ন আছে ,  বলে প্রায়  বেরিয়ে পড়তেন তিনি , যাতে বাড়ির অন্যরা  পেটপুরে খেতে পারেন । এক মহাজীবনের এ যেন উন্মেষলগ্ন । আমরা মূলত আত্মকেন্দ্রিক , স্বার্থসর্বস্ব মানসগঠনের আদল স্বপরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষের । ব্যতিক্রম অবশ্যই আছেন , তবে সংখ্যায় নগণ্য । অন্যর কল্যাণ সাধনই জীবনের মূল ধ্রুবলক্ষ্য হওয়া উচিৎ , এই শিক্ষায় স্বামীজি দিয়েছেন দেশবাসীকে । 

সাম্যতার পূজারী ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ । তাঁর বিবেকময় ব্যবহার চুম্বকের মত আকর্ষিত হতেন হতদরিদ্র , প্রান্তিক অন্ত্যজ , উচ্চবিত্ত সকলেই । সাল ১৮৮৮ দিকে আগ্রা থেকে বৃন্দাবন যাওয়ার পথে একজন ব্যক্তিকে গাঁজা খেতে দেখে দাঁড়িয়ে যান বিবেকানন্দ । বসে পড়েন সমাজিকভাবে অচ্ছুত সেই ব্যক্তির পাশেই । গাঁজার ছিলিম চাইলেন স্বামীজি সেই আগন্তুকের কাছে । অবাক হলো সেই সমাজিকভাবে অল্পদামি মানুষটি , আড়ষ্টভাবে বললো , আমি নিচু জাতের মানুষ , আপনি সন্ন্যাসী । আপনাকে ছিলিম দিই কি করে ? একপ্রকার জোর করেই বিবেকানন্দ ছিলিম নিয়ে গালে পোরেন । অচ্ছুত মানুষটির হৃত বিশ্বাস ফিরল । স্বামীজি ফিরবার পূর্বে তাঁকে বললেন , বিশ্বাস হারিয়ো না , সকল মানুষ সমান । আমরা সকলেই এক ঈশ্বরের সন্তান । 

বিবেকানন্দ ছিলেন জাগ্রত চেতনার প্রতীক । হতাশায় নুব্জ যুবসমাজকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন , কেননা ঋষিপ্রতীম স্বামীজি জানতেন , সমাজ ও দেশের কল্যাণ সাধনের নেপথ্যে বেশি অবদান রাখবেন এই সকল যুবা পুরুষগণ । আলস্যকে বড়ো অপছন্দ করতেন তিনি , কেননা সফলতার মুখ একমাত্র পরিশ্রমীদের জন্যই বরাদ্দ । দিনের শেষে পরিশ্রমীরাই হাসে , এই আপ্তবাক্য মিশে গিয়েছিল তাঁর রক্তপ্রবাহে । তিনি বিশ্বাস করতেন , আলস্য স্বর্গে বাস করলে কখনই জীবন সমৃদ্ধময় রুপ সৃজন হয়ে উঠবে না । বরং পরিশ্রম করো ।  সাফল্য লাভ করতে গেলে প্রবল অধ্যবসায় এবং প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তির অধিকারী হওয়া দরকার । কেননা , অতৃপ্ত আত্মা ব্যতীত সফলতার সোপান স্পর্শ করা মুশকিল । তবে , এই সফলতার বিজয়গাঁথা পথের প্রধান কণ্টক হলো ভয় । স্বামীজি এই ভয়কে জয় করবার উপর বারংবার জোর দিয়েছেন । তিনি উপলব্ধি করতেন , ভয়কে পরাস্ত করতে পারলেই জয় পাওয়া সম্ভব । বিপদে পড়লে পালিয়ে যাওয়া মূর্খামি , বরং বিপদের মুখোমুখি হও , লড়াই করো । স্বামীজি বলতেন , ' নিজেদের বিপদ থেকে টেনে তোলো । তোমার উদ্ধার সাধন তোমাকেই করতে হবে । ভীত হয়ো না । বার বার বিফল হয়েছো বলে নিরাশ হয়ো না । কাল সীমাহীন , অগ্রসর হতে থাকো , বার বার তোমার শক্তি প্রকাশ করতে থাকো , আলোক আসবেই । ' যুবা পুরুষদের প্রতি তাঁর আরও আহ্বান , ' হে বীর হৃদয় যুবকগণ , তোমরা বিশ্বাস কর যে , তোমরা বড় বড় কাজ করবার জন্য জন্মেছ । ওঠ , জাগো , আর ঘুমিও না ; সকল অভাব , সকল দুঃখ ঘুচাবার শক্তি তোমাদের ভিতরেই আছে । একথা বিশ্বাস করো , তাহলেই ঐ শক্তি জেগে উঠবে । '   

স্বামীজির কাছে দেশ প্রথম , দেশই শেষ । দেশ এবং জাতি , এই দুই সমান্তরাল ভাবনা প্রবাহই তাঁর চিন্তার কোরক  সর্বদায় আন্দোলিত করেছে । কাপুরুষতায় দেশের কল্যাণ সাধিত হওয়া সম্ভব নয় । পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন করতে গেলে নির্ভীক , অকুতোভয় হতে হবে , তবেই আসবে চির কাঙ্ক্ষিত মুক্তির প্রহর । শিষ্যদের উদ্দেশ্যে স্বামীজির ভাষ্য  , ' তোমরা কাজ করে চলো । দেশবাসীর জন্য কিছু কর - তাহলে তারাও তোমাদের সাহায্য করবে , সমগ্র জাতি তোমাদের পিছনে থাকবে । সাহসী হও , সাহসী হও ! মানুষ একবারই মরে । আমার শিষ্যরা যেন কোন মতে কাপুরুষ না হয় । ' 
দেশে কল্যাণময় পরিআবহ তৈরি করতে গেলে আদর্শ চরিত্রগঠন করা অত্যন্ত জরুরি । সৎ কর্মনিষ্ট , পরোপকারী মহৎ মননের অধিকারী গণ মানবই দেশীয় মানব সম্পদ হিসাবে আরাধ্য হন । অসৎ চরিত্রের অধিকারী জনমানব দেশের ভার স্বরুপ , জঞ্জাল সদৃশ । তাই দেশের কল্যাণের স্বার্থে দেশবাসীকে সৎ উন্নত চরিত্রের অধিকারী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন স্বামী বিবেক - ' চরিত্র গঠনের জন্য ধীর ও অবিচলিত যত্ন এবং সত্যপলব্ধির জন্য তীব্র প্রচেষ্টাই কেবল মানব জাতির ভবিষ্যৎ জীবনের উপর প্রভাব বিস্তার করিতে পারে । ' শরীরে  শিহরণ ওঠে এ সব স্বর্গীয়  কথামৃতে , মনে হয় জীবন লড়িয়ে দিই অসফলতার খোলস ঝেড়ে । তাঁর উচ্চারিত বাণী সমূহ সমকালীন ভারতবর্ষে যেমন নবজাগরণের সঞ্চার করেছিল , সেই অমৃত জীবন দর্শন আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক । 


 লেখকের এই প্রবন্ধটি দৈনিক একদিনে প্রকাশিত । 


লেখক 
আরিফুল ইসলাম সাহাজি 
৭৯০৮১১৮৬০০

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।