দিশাহীন মুসলিম গণসমাজকে ভোট-বল হিসাবেই ব্যবহার করছে রাজনীতির কারবারিরা। আলোকপাত করছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।











পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজন কম বেশি সুবিধা বঞ্চিত হবেন , বিষয়টি অস্বাভাবিক নয় । এক প্রকার পরম্পরাই  বলা যায় । সংখ্যাগুরুদের উচ্চধ্বনির  নিচে চাপা পড়ে অল্পসংখ্যক মানুষের কণ্ঠস্বর ।  অল্পসংখ্যক বা সংখ্যালঘু শব্দবন্ধটির পরিসর বেশ বিস্তৃত । আমাদের দেশ আয়তনে বিরাট , রয়েছে একাধিক ভাষা , ধর্ম ও লোকাচার ।  সংখ্যালঘু শব্দটির ব্যবহার আরও অর্থপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় এখানে । যেহুতু , নানা ভাষা বর্ণের এই দেশ , উক্ত কারণে বিভিন্ন রকমের প্রতিবন্ধকতার মুখে অনেক সময় পড়েন অল্পসংখ্যক মানুষরা । অল্পপরিসরে পুরো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমস্যার ছবি ধারণ করা বেশ শক্ত । এই প্রবন্ধ মূলত সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রাথমিক কিছু সমস্যা ও তাঁদের নগণ্য কিছু চাহিদার উপর আলোকপাত করার চেষ্টা করছি । চাকরি  এবং মানব উন্নয়নের যে নির্ণয়ক পরিমিতি , সেই জায়গায় কোন অজানা কারণে স্বল্পসংখ্যক মুসলমান সম্প্রদায়ের  মানুষদের উপস্থিতির গ্রাফ সবসময়ই যাচ্ছেতাই রকম কম থাকে । বিষয়টি নিয়ে সংখ্যালঘু মানুষজনের ওতটা শিরঃপীড়া নেই , এর পিছনে যে কারণটি সবচেয়ে বেশি , সেটি বেশ মজাদার । অল্পসংখ্যক মানুষজন  এক অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী  কিছুটা বঞ্চনার শিকার হন , সেই বঞ্চনার ইতিবৃত্তই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে বড় মিথ হিসাবে বহু আগে থেকেই থাবা বসিয়ে রেখেছে । আমরা একটা কথা প্রায় সবাই শুনেছি , অন্ততঃ আমরা যারা গ্রাম থেকে বড় হয়েছি , ' পড়ে হবেটা কি ? মুসলমানদের চাকরি আছে ! ' কেউ যদি বলেন , কথাটি তিনি প্রথম শুনছেন , তাহলে অনেকেরই মত আমিও অবাক হব । অর্থাৎ যে শিশুটি সদ্য পঞ্চম শ্রেণীতে কিম্বা আর একটু বড় হয়েছে এবং অভিভাবকদের কাছ থেকে যখন ওই রকম নেতিবাচক কথা শুনছে , তখন সে অজান্তেই ওই বিষয়টির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছে । পরবর্তীতে  যখন সেই মুসলিম শিশুটি যৌবন তেজদীপ্ত শিক্ষিত তরুণ হয়ে  চাকরি পায়  না , তখন তার মনে তেমন বিরাট দুঃখ সঞ্চার হয় বলে তো মনে হয় না । কেননা '  মুসলমানদের চাকরি আছে ? ' এই আপ্তবাক্যটি তাঁর হৃদয়ে বটগাছের মত শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে বসে পড়েছে । 


দুর্বলকে সব দেশে সব সময়ই সহনশক্তির পরিচয় দিতে হয় । সংখ্যাগুরুদের মন জুগিয়ে চলায় একপ্রকার অলিখিত বিধান । সংখ্যাগুরুর উৎসবে যোগ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক প্রমাণ দিতে হয় তাঁদের  ।  সংখ্যাগুরুর রীতি , সংস্কৃতি , উৎসবকে সর্বজনীনতার রুপ দেওয়ার দায়িত্বও নিতে হয় অল্প সংখ্যক মানুষদের । অথচ নীরবে চলে যায় তাদের উৎসব - আচার বিচার , খোঁজ নিতে আসে না কেউ , শুভেচ্ছা বিনিময় খুব অল্প পরিসরেই  হয় । অল্পসংখ্যক মানুষদের উৎসবের খোঁজ নেন না , শুভেচ্ছা বিনিময় করেন না সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ , বিষয়টির প্রতিষ্ঠা দিলে কিছু অসাম্প্রদায়িক মহৎ মানুষদের অপমান করা হবে । এখানে শুধু বলবার , সংখ্যাগুরুর উৎসবে যে সর্বজনীন আবেশ , সেটা অল্পসংখ্যক মানুষদের উৎসবের সময় কিছুটা ভাঁটা পড়ছে । অল্পসংখ্যক মানুষজন যে স্বতস্ফুর্ত ভাবে বৃহত্তর উৎসব সমূহে অংশ নেন , অল্পসংখ্যক মানুষের উৎসবে কিন্তু বৃহত্তর জনগোষ্টির মানুষদের অংশগ্রহণ মন খারাপ করার মত কম । একপ্রকার ঘরোয়া হয়েই পালিত হয় । 

অল্পসংখ্যক মানুষদের জীবন যাত্রার মান খুব একটা উন্নত মানের হয় না । একটা আস্ত দেশের মধ্যে থেকেও লঘু ও গুরু সম্প্রদায়ের মধ্যে অর্থনীতিক পার্থক্য লক্ষ্য করবার মত বিষয় । ছোট একটা দৃষ্টান্ত দিয়ে উপস্থাপিত বিষয়টির পরিপক্কতা বোঝানো যাক , আমাদের দেশীয় প্রেক্ষিতকেই ধরুন , একটি মুসলিম আধিক্য সম্পূর্ণ পাড়া , গ্রাম কিম্বা জেলাকে বেছে নিয়ে যদি রাজ্য কিম্বা দেশের অন্যান্য অংশের তুলনা করেন , তাহলে সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হবে অল্প সংখ্যক  মানুষদের সেই পাড়া কিম্বা জেলা রাজ্য বা দেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় অনুন্নত । 

সরকারি চাকরিতে অল্পসংখ্যক মুসলমান মানুষদের উপস্থিতির হার অত্যন্ত লজ্জাকর । আমাদের দেশে কম বেশি ২ শতাংশের মত সংখ্যালঘু মুসলিম সরকারি চাকরির সঙ্গে যুক্ত আছেন । অল্প সংখ্যক মানুষজনের জীবিকা বহর গর্ব করার মত নয় , (যদিও কোন কাজই ছোট নয় )দুই বেলা , দুই মুঠো অন্নের জোগান হলেই দিন রাত কাটে আনন্দে । গ্রামের বাজারে ছোট ব্যবসা এবং কৃষিকাজে এদের যত সফলতা । নগণ্য সংখ্যক  মানুষ বড় ব্যবসা বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রাখেন । অন্যান্য সম্প্রদায়ের অর্থবান মানুষদের সঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের ধনী ব্যক্তিদের কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করবার মত । একটু মাথাধরা যাঁরা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে , তাঁরা ভয়ঙ্কর রকম স্বসমাজের উন্নয়নের ক্ষেত্রে উন্নাসিক ভূমিকা রাখেন (অন্যান্য সব ক্ষেত্রের মত এখানে ব্যতিক্রম আছে )। যে সমাজে তিনি লালিত পালিত হলেন , সেই সমাজকে কিছুটা অগ্রসর করার দায়িত্ব তার উপর বর্তায় । দুঃখের বিষয় , অধিকাংশই স্বসমাজের জন্য ভাবিত না হওয়ার কারণে এই সম্প্রদায়ের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন পরিলক্ষিত হচ্ছে না । খুব অল্প সংখ্যক মহৎপ্রাণ  সচ্ছল মানুষ অবশ্য কিছুটা কল্যাণকর ভূমিকা রাখছেন , মুসলমান পরিচালিত মিশনগুলোতে পড়া দুস্থ মেধাবী ছাত্র পড়ার খরচ অনেকেই বহন করেন । 

পড়াশুনার শতাংশের বিচারে অল্পসংখ্যক মুসলমানদের উপস্থিতি আমাদের মত সভ্য দেশের পক্ষে অত্যন্ত লজ্জাকর । মুসলমানদের মধ্যে একটা বড় অংশই এখনও অশিক্ষিত । একপ্রকার মূল সমাজ থেকে তাঁরা বিচ্ছিন্ন , একথা সচেতন থেকেই বলা যায় । তাঁদের জীবনের গতিপথটাই অদ্ভূত । নিজ এলাকা থেকে আট মাইল দূরে ঘটনা প্রবাহ কোনদিকে আবর্তিত হচ্ছে বেশিরভাগই সে বিষয়ে খবর রাখার প্রয়োজনীয়তা মনে করে না । ফলে এদেরকে ধোঁকা দেওয়া ভীষণই সোজা হয়ে দাঁড়ায় । দেশের অন্যান্য জায়গায় অ্যান্টি মুসলমান ধারণা পোষণকারী রাজনীতিক দলও এখানে এসে মুসলমান দরদী সাজবার দুঃসাহস করে , অশিক্ষিত অজ্ঞ মুসলমানগণ অনেকেই ভিড়ে যান সেই চরম ধর্মান্ধদের দলে । 

অল্পসংখ্যক মুসলমানদের মধ্যে মেয়েদের শিক্ষার হার শতাংশের বিচারে সন্তোষজনক । তবে ছেলেদের শিক্ষার পরিমিতি একপ্রকার মাঠে মারা গেছে । একটু অসচ্ছল মানুষরা আগে পুত্র সন্তানের শিক্ষার উপর বেশি গুরূত্ব আরোপ করতেন । অর্থাৎ দুটো বাচ্চার মধ্য যদি একজনের পড়ানোর সমর্থ তাঁর থাকত , তবে তিনি ছেলেকেই বিদ্যালয়ে পাঠাতেন । কন্যাশ্রী , রুপশ্রীর নারী শিক্ষার কয়েকটা প্রকল্প চালু হওয়ার পরই বিষয়টা একশ আশি ডিগ্রি ঘুরলো । এখন মেয়েদের শিক্ষার উপর সবাই জোর দিচ্ছেন । সংখ্যালঘু , বেশির মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ছেলেদের শিক্ষার স্খলন ঘটছে বিপদজ্জনকভাবে । শিক্ষায় যেহুতু একটি জাতির উন্নয়নের সূচক নির্ধারণ করে , সে অর্থে মুসলমানদের এই শিক্ষাহীনতা প্রগতির পথে আগামী দিন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে , তা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার বোধহয় প্রয়োজন নেই । 

শিক্ষা , চাকরি কিম্বা অন্যান্য বহুবিধ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য উপস্থিতি না থাকলেও অল্পসংখ্যক মুসলমানদের তেমন মাথাব্যথা নেই । কিছুটা বঞ্চনা অনেক আগে থেকেই চলে আসছে , একপ্রকার পরম্পরাও বটে । স্বাধীনতার পর মুসলমানরা দেশের একটা অংশ নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই এ দেশে থেকে যাওয়া মুসলমানদের জীবনযাত্রার মান অন্যান্যদের তুলনায় খারাপ হতে থাকে । এই অনুন্নয়ন নিয়েই তাঁদের জীবন ঘর সংসার । একটা বিষয় অল্প সংখ্যক মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত স্পর্শকাতর । চাকরি নেই , শিক্ষা নেই , অসুবিধা নেই ,  তবে কেউ যদি ধর্মপালনের অধিকার ছিনিয়ে নিতে চান তাহলে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা গর্জে ওঠেন । আসলে ধর্মের বেড়াজালের অলিগলিতেই জড়িয়ে মুসলমানদের জীবনের পথ । উক্ত পথে কোন রুপ প্রতিবন্ধকতা এলে , তা উপড়ে ফেলতে তাঁরা বদ্ধপরিকর । কিছু চাই না তাঁদের , চাই শুধু একটু ধর্মপালনের অধিকার । ঈমানের সঙ্গে ধর্মপালন করেই তাঁরা কবরে শুতে চান । তাঁরা মনপ্রাণে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন , মর্ত্যের এই খেলা দুইদিনের ।  সাঙ্গ হলেই ফিরে যেতে হবে , তারপর শুরু হবে আসল জীবন । বিচারের পরেই  ঠিকানা হবে বেহেস্ত বা নরক , সেখানেই কাটাতে হবে জীবনের অনন্ত প্রহর । সেকারণেই মুসলমানরা জীবন নিয়ে ওতটা ভাবিত নয় কোন কালেই , যতটা তাঁরা বেহেস্ত - নরক নিয়ে ভাবিত । এইজন্যই তাঁরা শুধু ধর্মপালনের অধিকার টুকুই চান । সেজন্যই , এই অচাহিদা থেকেই জীবনের গল্পের অন্ধগলিতে মুসলিম গণ সমাজের বাস । রাজনীতিক হর্তাকর্তারা  ফুটবলের সদৃশ আচরণ করে হাওয়াই মিটার ধরিয়ে রেখেছে মুসলমানদের হাতে ॥

লেখকের এই প্রবন্ধটি দৈনিক স্টেটসম্যান এ প্রকাশিত । 



লেখক 
আরিফুল ইসলাম সাহাজি 
৭৯০৮১১৮৬০০




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।