ডাক্তারবাবুগণ এবার রোগীদের আরও একটু বেশি যত্ন নিন। এ বিষয়ে লিখেছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
পৃথিবীর মহৎ পেশা মানব সেবা ।' জীবে প্রেম করে যেজন , সেই সেবিছে ঈশ্বর , ' স্বামী বিবেকানন্দের এই অময়বাণী আজও হৃদয়পটে চিত্রিত হয় । জীব সেবায় তো শিবসেবা , কেননা ঈশ্বরের বাস তো মানবের শরীরেই , মন্দির কিম্বা মসজিদে কি ঈশ্বরকে পাওয়া যায় ? মানব সেবার মহৎকর্ম করবার সৌভাগ্য কম বেশি সকলেরই হয় , গণমানুষ হাজার রকম কর্ম করে জীবনের চলার পথকে মসৃণ করবার চেষ্টা করেন । এই কর্মপন্থায় হলো পেশা । আর পাঁচটা মানব পেশার থেকে চিকিৎসকদের কর্ম একটু পৃথক ধরনের , মুমূর্ষ রোগীকে প্রাণ দান করেন চিকিৎসক । সরাসরি এমন মানব সেবার সুযোগ অন্যান্য পেশার মানুষদের সৌভাগ্যে ঘটে না । মাটি - উত্তাপ - জল - বায়ু ছাড়া মানবভূমি কল্পনা করা যায় না , সেইরকমই চিকিৎসক ব্যতীত দেশ সমাজ কল্পনা করা স্বপ্নেও সম্ভবপর নয় । চিকিৎসকদের কি ভয়ঙ্কর রকম প্রয়োজন রয়েছে , গতকয়েকদিনের চিকিৎসক অসহযোগে আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি । অনেক গরীব মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন । এটাও কি একপ্রকার অনিচ্ছাকৃত খুন নয় ? কেননা চিকিৎসা ব্যবস্থার গতি প্রকৃতি সুস্থ থাকলে সকলেই ঘুমের দেশে নিশ্চয় চলে যেতেন না । স্বাস্থ্য পরিকাঠামো সচল থাকলেও কিছু মানুষের মৃত্যু হয় , তবে বিনা চিকিৎসায় আত্মীয় হারানো পরিজনরা কিভাবে নিজেদেরকে সান্ত্বনা দেবে ? তাঁরা কি ক্ষমা করবেন এই সো কলড মানুষের ভগবানদের ? চিকিৎসকগণ যদি একটু মানবিকতা দেখাতেন , তাহলে তাঁর বাচ্চাটা আজও চোখের সামনেই থাকতো , এই আফসোস কি আদৈও কখনও যাবে ? আগামী দিনে এই আন্দোলনই হয়তো দেশবিদেশে নব্য চিকিৎসক বিপ্লবীগণকে পথ দেখাবে , কিন্তু স্বজন হারা মা কখনও ভুলবেন না , এই অচলাবস্থার জন্যই অকালে চলে যেতে হয়েছে তাঁর আত্মজকে ।
নিরাপত্তা সকলেরই মৌলিক অধিকার , ভয় ভীতির মধ্যে কাজ করাও বেশ অসুবিধার এ বিষয়ে দ্বিমত থাকা উচিৎ নয় । চিকিৎসকদের অবশ্যই নিরাপত্তার বেষ্টনীর মধ্যে রাখা দরকার , যাঁরা আমাদের জীবন রক্ষায় সব ধরনের চেষ্টা করেন , তাঁদেরকে কেউ মেরে চলে যাবে , এটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয় । এন .আর .এস হাসপাতালে যে ঘটনা নিয়ে এই মহালঙ্কা কান্ডটি ঘটল সে বিষয়ে আলপটকা মন্তব্য না করাই ভালো , বিষয়টা তদন্ত সাপেক্ষ । প্রথম থেকেই কিন্তু একটা অভিযোগ উঠছিল , চিকিৎসকদের গাফিলতিতে রোগী মৃত্যু , পরে লাশ আটকে রাখার ফলেই গন্ডগোলের সূত্রপাত ঘটে । দু লরি ভর্তি দুশতাধিক মানুষ নিয়ে জুনিয়র চিকিৎসকদের উপর হামলার যে ঘটনা জুনিয়র ডাক্তারদের তরফ থেকে তোলা হচ্ছিল , তাও আষাঢ়ে গল্প বলেই অনেকে অভিযোগ করছেন । সোশাল মিডিয়াতে ভাইরাল হওয়া অল্প কয়েক সেকেন্ডের যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে , সেখানে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে জুনিয়র ডাক্তারগণ রোগীর এক পরিজনকে বেদম প্রহার করছেন , পুলিশ উদ্দ্যোগী না হলে হয়তো মরেই যেত । ডা: পরিবহর আহত হওয়ার ঘটনাটি কাম্য ছিল না , তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন । তবে ওইদিন সঠিক কি হয়েছিল , সেটা বুঝতে অবশ্যই সুষ্ঠ নিরপেক্ষ তদন্তের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে ।
ঘটনা পরস্পরা যায় ঘটুক , তার পূনরাবৃত্তি হওয়া কাম্য নয় , এমন ঘটনা আগামীতে যাতে না ঘটে , সে বিষয়ে নিশ্চয় প্রশাসন সঠিক পদক্ষেপ নেবেন । তবে গণ অন্ত্যজ মানুষের প্রতিনিধি হিসাবে বুঝতে পারছি , এই দাবি আদায়ের কয়েকদিনে সাধারণ আম মানুষের বড়ো ক্ষতি হয়ে গেছে । উচ্চবিত্ত এবং উচ্চমধ্যবিত্ত , অর্থাৎ সমাজের এলিটপর্বের প্রতিভূ যাঁরা , তাঁরা কখনই সরকারি হাসপাতালের উপর নির্ভরশীল নন , কোনদিনই ছিলও না । সরকারি হাসপাতালগুলোতে সাধারণত ভিড় জমান ছাপোষা মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত সমাজের মানুষজন । ফলে এই তথাকথিত আন্দোলনের ফলে প্রাপ্তি যায়হোক সমাজিকভাবে অল্পদামি মানুষগুলোর প্রাপ্তি কিন্তু অনেকটাই ভোগান্তির , স্বজনহারানো কান্নাও । টিভির পর্দায় একজন গর্ভবতী কিশোরী আর .জি .কর মেডিকেল হাসপাতালের গেটে ছটফট করছেন , গেটে তালা ! এখানে বোঝা দরকার , সকলেই জানেন হাসপাতালগুলোতে অসহযোগ আন্দোলন চলছে , তাহলে কত্তটা অসহায় হলে প্রসবের মত এত অধিক গুরুত্বপূর্ন রোগীকে তাঁরা সরকারি হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন । আসলে তাঁদের বেসরকারি হাসপাতালে যাওয়ার মত অর্থই নেই । আবার মালদহ মেডিকেল কলেজের একজন পিতার আর্তনাদ সকলের হৃদয়কে মোচড় দিয়েছে , তিনি তাঁর সাপে কাটা বালক পুত্রকে নিয়ে এসেছেন সরকারি হাসপাতালে , ফিরিয়ে দিলেন চিকিৎসকগণ । বিনা চিকিৎসায় মারা গেল সেই বালক । চিকিৎসকগণ একটু মানবিক হতে পারলেন না ? অন্ততঃ যাঁরা মারাত্মক রকম সিরিয়াস পেশেন্ট , তাঁদের উপর কি একটু নমনীয়তা দেখানো যেত না । সাধারণ অল্পবিস্তর অসুস্থ রোগীদের বেশ কিছুদিন চিকিৎসার বাইরে রাখলেও বিশেষ ক্ষতি নেই , তবে সাপে কাটা , আত্মহনন , অক্সিডেন্ট , ক্যান্সারের মত পেশেন্টদের হাতে তো সময় নেই অত , সেজন্যই ডাক্তার বাবুদের দাবি আদায়ের জেদের তলায় অসহায়ের মত পিষ্ট হলেন তাঁরা ।
সমস্ত ঘটনার মূলপীঠস্থান এন .আর .এস' এর জুনিয়র চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কোরপান নামের এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে মারার অভিযোগ রয়েছে । সেই মামলাটির এখনও সুরাহা হয়নি , কোরপানের পরিবার ন্যায় বিচার পাবে কীনা , সে সময় জানে । চিকিৎসকগণ অবশ্যই নিরাপত্তা চাইবেন , এটা তাঁদের মৌলিক অধিকার । তবে আমরা যাঁরা গণ মানুষ তাঁদেরও তো নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে , অর্থাৎ সোজাভাবে শিরদাঁড়া সোজা রেখে বললে , চিকিৎসকদের হেনস্তা পীড়ন করলে অবশ্যই একশোবার সাজা হোক অপরাধীর , তবে চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হলে চিকিৎসকগণ কেন কৈফিয়ত দেবেন না ? চিকিৎসকগণ সুস্থ পরিষেবা প্রদান করছে কীনা , এই বিষয়টি কেন নজরদারির আওতায় আনা হবে না ? আইনের উর্দ্ধে কেউই নন , এই বিশ্বাসটা হারিয়ে গেলে মুশকিল ॥
লেখকের এই প্রবন্ধটি দৈনিক স্টেটসম্যান এ প্রকাশিত ।
লেখক
আরিফুল ইসলাম সাহাজি
আলাপন : ৭৯০৮১১৮৬০০
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন