ইতিহাসে এক পৃথিবী বেনোজল , অপসময়কে জানতে সাহিত্য পাঠই উত্তম । লিখছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।




মহামতি প্লোটো তাঁর দার্শনিক অনুভূতি থেকে উপলব্ধি করেছিলেন এক চিরন্তন শাশ্বত সত্য । তিনি বলেছিলেন , সাহিত্য অনেকাংশেই সত্যের কাছাকাছি । ইতিহাসের চেয়েও । [Poetry is Nearer to vital truth than History ] বিষয়টি চিরন্তন সত্য । সর্বকালেই বন্ধ্যা কিম্বা অপসময় যায় বলা হোক , অব্যবস্থা এবং অরাজকতাপূর্ণ সময়ে ইতিহাস বিকৃত হওয়ার ঘটনা দুর্লভ নয় , বরং অতীতে এবং বর্তমানেও লক্ষ্য করা গেছে । সাহিত্য এমন একটি মাধ্যম যার বিকৃতি কিম্বা রক্তচোখ দেখিয়ে সত্যপথ থেকে পশ্চাৎসরণ করানো প্রায় অসম্ভব । তবে সকল সাহিত্যসাধকই যে সত্য সুন্দরের পূজারী হবেন , এমন মত প্রতিষ্ঠা করবার সাহস বোধহয় কোন সাহিত্যসমালোচকই দেখাবেন না । কিছু পাঁজরহীন কবি সাহিত্যিক নামের অকবি অলেখক থাকবেন , অতীতেও ছিলেন , এখনও ব্যাপকভাবেই আছেন  । সর্বযুগেই  এদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় । যাঁরা ভয়ভীতি কিম্বা পুরস্কারের লোভে নিজেদের বিকিয়ে দেন । অপরাধ করেন । দেশ কাল ও সময়কে ধারণ করবার যে গুরুদায়িত্ব তাঁর উপর অর্পিত ছিল , সেই সত্য সুন্দরের বাণী প্রচারের যে অক্ষমতা তাঁদের মধ্যে দেখা গেল  , সে জন্য তাঁরা অবশ্যই নিন্দিত হবেন । প্রাক স্বাধীনতার উত্তাল সময়ের দিকে নজর দিলেই বিষয়টি প্রাঞ্জল হবে , ইংরেজদের দমনপীড়ন তখন সপ্তমে । বাংলার কবিকুল দিশেহারা । কেউ রায়বাহাদুর উপাধি বাগিয়ে নেওয়ার জন্য কলম চালাচ্ছেন , কেউ বা অতি সাবধানী , অন্যায়ের  বিরুদ্ধে , ইংরেজ শাসকদের অসাম্যের বিরুদ্ধে লিখছেন । তবে এতই সাবধানে , এত ব্যাপক রূপক ব্যঞ্জনার আবর্তে সেই সাহিত্যকর্ম রচিত হচ্ছে  যে বড় মাপের সাহিত্য বোদ্ধা ব্যতীত সে সকল সাহিত্য কর্মের মর্ম উদ্ধার করা একপ্রকার সম্ভব হচ্ছিল না । সেই সময় দরকার ছিল কিছুটা আগুনের , যে সব কিছু তছনছ করে দেবে । ঠিক সেই সময় আবির্ভূত হলেন বিদ্রোহী দুখু মিয়া । তিনি লিখলেন , 
' ' আমি চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা-প্রলয় আমি নটরাজ,আমি সাইক্লোন,আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়,আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দুর্বার,আমি ভেঙে করি সব চুরমার! ....
বল বীর-
চির-উন্নত মম শির! ' ' 
ইংরেজ তোষণকারীগণ কালগর্ভে হারিয়ে গেলেন , বেঁচে থাকলেন রবীন্দ্র নজরুল শরৎচন্দ্র প্রমুখ শ্রদ্ধেয়জনরা । 


ইতিহাস অতীত ঘটনা সম্বলিত একটা বিষয় । আজ এই মুহুর্ত যেটি সমকাল , আগামী কাল সেটিই অতীত । ইতিহাস এই ফেলে আসা কালের কথায় মুখর ।আলোচনার সুবিধার জন্য বলে নেওয়া দরকার , ইতিহাস কোন অপরিবর্তিত গ্রন্থ নয় । এটি পরিবর্তিত এবং পরিমার্জন যোগ্য একটি পুস্তক সংকলন । সংযোজন ও বিয়োজনের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয় ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ ঘটনাপ্রবাহ । যেহেতু , গ্রন্থটি পরিমার্জনযোগ্য এবং সংযোজন বিয়োজনের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পায় , উক্তহেতুগত কারণে ইতিহাস পরিবর্তিত হয় । ঢুকে পড়তে পারে এক নদী বেনোজল । ঠিক এই জায়গাতে সাহিত্যের সঙ্গে ইতিহাসের বিস্তর প্রভেদ রয়েছে । ইতিহাস অতীত ঘটনা প্রবাহের বর্ণিত লিখিত অংশ হলেও সাহিত্যের ঘটনাক্রম শুধুমাত্র অতীতের অন্ধগলির আবর্তে সীমাবদ্ধ নয় । অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যের পথপ্রদর্শক হিসাবে কাজ করে সাহিত্য । ইতিহাসকে নিজের স্বার্থে ঢাল হিসাবে স্বৈরাচারি শাসক ব্যবহার করতে সক্ষম হলেও সাহিত্যের বহুগামিতাকে নিজ বশে আনতে তারা কোনদিনই সক্ষম হননি । ইতিহাস পাল্টে ফেলতে পারলেও সাহিত্যের কণ্ঠরোধ করা সম্ভব হয়নি । সময়  অনেক সময়ই নিয়ন্ত্রক শক্তি হয়ে ওঠে , সাহিত্যকে চালনা করে অজান্তেই । অপসময়ে ইতিহাস নয় , সত্যঘটনা প্রবাহকে সাহিত্যই আষ্টেপৃষ্ঠে স্বশরীরে ধারণ করে ।  বিষয়টি প্রাঞ্জল করতে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনীতিক অবক্ষয়ের দিনে সাহিত্য কিভাবে ইতিহাসের সমকক্ষই নয় , বরং ইতিহাসকে ছাড়িয়ে সেই সময়পর্বকে জানতে  আকর মাধ্যম হয়ে উঠেছিল  , সেই বিষয়টি আলোচনার মাধ্যম করা যাক । 

দেশটা সুদীর্ঘকাল রাজনীতিক অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে গেছে । তৎকালিন স্বৈরাচারির পাকহানাদার বাহিনী , পরবর্তীতে স্বাধীন হওয়ার পরও বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের হত্যা , সেনাশাসনের মধ্য দিয়ে গেছে দেশটি ।  ধ্বংশের পিরামিডে বসে সুখের নন্দনকানন রচনা করা সহজ নয় , বরং অত্যন্ত কঠিন কাজ ।চেষ্টাও করেননি সমকালীন সময়ের ওপার বাংলার সাহিত্যিক মানসগণ । স্বদেশমায়ের বুকফাটা কান্না উপেক্ষা করা তাঁদের পক্ষে একদমই সম্ভব ছিল না । ফলে সময়ের ক্ষত রক্ত পূঁজকেই তাঁরা দিলেন ভাষা , এক অনন্য কাব্যিক আদল । সময়কে ধারণ করতে গিয়ে অপশাসন , অব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেন তাঁরা ।  


লক্ষ মুক্তিযোদ্ধার তাজা রক্তের বিনিময়ে , মহীয়সী নারীগণের ইজ্জতের বিনিময়ে এসেছিল বহু কাঙ্খিত স্বাধীনতা । বাঙালি পেয়েছিল মুক্তির পরম আস্বাদ । দুঃখের বিষয় সেই স্বাধীনতা বেশিদিন ভোগ বাঙালির ললাট লিখনে ছিল না । অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু সেখ মুজিবর রহমান সপরিবারে নিহত হন । বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ এক প্রকার নিষিদ্ধ হয়ে যায়  স্বাধীন বাংলাদেশে । মুজিব হত্যাকারীরা  বুক ফুলিয়ে উৎফুল্লতা প্রকাশ করলো । এইপর্বে বাংলাভাষার কবিকুল একপ্রকার দিশেহারা হয়ে পড়েন । স্বাধীনতা বিরুধীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার মত সাহস প্রায় কেউই সেই সময় দেখাতে পারছেন না । সেই সময় সামসুর রাহমান ,  কবি নির্মলেন্দু
গুণ , আল মাহমুদ , রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হয়ে উঠলেন ব্যতিক্রমী ।  সেই চরম বিপ্রতীপ সময়েও  অসাম্য , স্বৈরাচারি শাসনব্যবস্থার বিরুপে সোচ্চার হলেন তাঁরা ।   মুক্তির পক্ষে , মুজিবের পক্ষে দাঁড়িয়ে পড়লেন অকুতোভয় সৈনিকের মত । কবি গুণ লিখলেন , 
' ' সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেইসব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।' ' 

মুজিবের হত্যাকে তাঁরা মেনে নিতে পারেননি , বিপদ আছে জেনেও তাঁরা  ফেটে পড়েছিলেন মুক্তির পক্ষে , মুজিবের পক্ষে ।  কোন ভয় তাঁদের  স্বরকে প্রভাবিত করতে পারেনি । '  শোকগাথা :১৬ আগষ্ট ১৯৭৫ ' শিরোনামের কবিতায় কবি গুণ লেখেন , 
' ' মুজিব মানে আর কিছু না 
   এক - যমুনা রক্ত ;
  মুজিব মানে সমাজতন্ত্র 
  আমি মুজিব ভক্ত । ' '
স্বৈরাচারি শাসক দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় , সেই কালপর্বে এমন সত্যকথন কাব্য শরীরে অঙ্কন করতে নিঃসন্দেহে হৃদয় প্রশস্ত হতে হয় । বিপদ ওঁৎ পেতে আছে রাজপথের অলিগলিতে জানতেন তাঁরা  , কিন্তু সময় সব নিজের হাতে তুলে নেয় এবং কবিকে বাধ্য করেন কাব্যশরীরে গেঁথে দিতে সময়ের প্রসব যন্ত্রণা । সময়ের দাবি মেনেই লেখেন রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লেখেন , 
   ' ' যে ভাবে তোমার চোখে মিশে থাকে বেদনার লাভা /বিস্ফোরণ বুকে নিয়ে আমিও তেমনি আছি /আমার নিকটে রাখো , বুকে রাখো শীতার্ত স্বদেশ _ / প্রয়োজন ছাড়া আমি জ্বলি না কখনো । ' ' 
                 [ নিরাপদ দেশলাই , রচনা সমগ্র ]
স্বদেশের এই রক্তমুখ বিস্ফোরণের উন্মাদনাকে সম্বল করেই সেই সময়পর্বের কবিগণ সাজিয়ে তোলেন তাঁদের  কাব্যের বেসাতি । এই দ্রোহই ছিল তাঁদের  কবিতার মূল সুর । 
সময়ের বুকে যখন রক্ত , দেশের বেশিরভাগ মানুষ যখন অনাহারে দিন কাটান সেই বিপ্রতীপ সময়ে প্রেমের বাতিতে অগ্নিযোগ কবির অপ্রয়োজনীয়ই মনে হয় । তাই তাঁদের কবিতায়  প্রেমের বেসাতি শক্তপোক্ত হয়নি , সচেতন ভাবেই এড়িয়ে গেছেন তাঁরা  । ফুলের সৌন্দর্যে বিমোহিত হলেও আত্মাহুতি দেননি কবি , কেননা সময়ের পেটে ভয়ঙ্কর ক্ষুধা , রাজনীতিক দীনতা রুদ্র দাঁড় করিয়ে দিয়েছে খাদের কিনারে । তাই রুদ্র মুহম্মদ সাহসের অগ্নিস্ফুলিঙ্গে পথ চলেন - 
' ' সাহস আমাকে প্রেরনা দেয় 
   জীবন কিছুটা যাতনা শেখায় 
   ক্ষুধা ও খরার এই অবেলায় 
           অতোটা ফুলের প্রয়োজন নেই । ' ' 
          [ অবেলায় শঙ্খধ্বনি , রচনা সমগ্র ] 
এই দ্রোহ , সমকাল ও ইতিহাসকে ধারণ করার প্রতিস্পর্ধী মানসকে উপেক্ষা করে তাঁদের সাহিত্য  কাব্যকলার আলোচনা সম্পূর্ণ হবার নয় । বরং তৎকালিন সময়কে জানতে ওই সমস্ত সাহিত্য মাধ্যম সমূহই সবচেয়ে বিশ্বস্ত আকর হয়ে দাঁড়িয়েছে । 


সময় ধারণ করে কাব্যে সাহিত্যের 
গন্তব্যক্ষণ । সময়কে ছাড়িয়ে বা উপেক্ষা করে কাব্যের শরীর গঠন হতে পারে না । বরং সময়ই কাব্য সাহিত্যের জন্ম দেয় , সাহিত্য  শরীরে এক একটা ইট গেঁথে দেয় , লেখকের হৃদয়কে শক্ত করে ধরে সময়ের কান্না । সাহিত্যিক  তো বাইরের কেউ নন , সমাজেরই কল্যাণে মগ্ন সাধক ।  সময়কে নিয়েই তাঁর ঘর , সমকালীন মানচিত্রকে একপ্রকার সম্মোহিত ভাবেই তিনি ধারণ করেন কাব্যের শরীরে । সময় অতিক্রম করে সুন্দরের গান গাওয়া তাঁর  আর হয়ে ওঠে না । কেননা ' কবি ' ' লেখক ' , শুধুমাত্র নামের আগে বসানো সন্মানিক পদবাচ্য নয় তো । গভীর অর্থবাহী , সমাজিক কল্যাণে নিয়োজিত আপোষহীন এক সংগ্রামী  তিনি । সীমান্তরক্ষীদের মতই সময়ের বুকে রক্তের নদী খননকারী নরখাদকদের বিপক্ষে দাঁড়ান তিনি । এইটুকু পাঠ করেই কবিকে শুধু সংগ্রামী হতে হবে , এমন ভ্রম হলে মুশকিল । আসলে তিনি হবেন সত্য সুন্দরের পূজারী  । ময়ূরের পেখম নৃত্যে তিনি সুর করে গাইবেন প্রেমের গান । আবার মাটি মায়ের বিপর্যয়ের দিনে শক্ত করবেন পেশী , হুঙ্কার দেবেন সেই সকল অপশক্তির বিপক্ষে । প্রকৃতিক সৌন্দর্যে বিভোর হবেন তিনি । সবার তাই কবি হয়ে ওঠা হয় না । প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের সেই চরণখানি আসুন স্মরণ করি , ' ' সকলে কবি নন , কেউ কেউ কবি । ' ' 
সময়ের কান্না , দেশের রক্তপূঁজ কাব্য শরীরে মাখাবেন তিনি , অন্ততঃ সময়ের সেটুকু দাবি থাকবেই ।  ইতিহাসও সাহিত্যের মত এত নির্ভেজালভাবে সময়কে উপস্থাপন করতে পারে না , অনেকক্ষেত্রেই ইতিহাসে ওঁৎ পেতে থাকে পক্ষপাত । বন্ধ্যা সময়কে জানতে সাহিত্য এক অনন্য উৎকৃষ্ট মাধ্যম । আকাশ থেকে তারা পেড়ে নিয়ে প্রেমিকার খোঁপায় গুঁজলে কাব্যখ্যাতি মিলতে পারে , কালজয়ীও হতে পারেন কবি , তবে সময়কে উপেক্ষা করে সমাজিক দায়বদ্ধতা পালন না করার যে অক্ষমতা , সেই দায়ে একশবার অভিযুক্ত হবেন পাঠকের দরবারে । 

লেখকের এই প্রবন্ধটি দৈনিক স্টেটসম্যান এ প্রকাশিত । 



লেখক 
আরিফুল ইসলাম সাহাজি 
 ৭৯০৮১১৮৬০০

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।