জল সংকটের মুখে দেশ , মুক্তি কোন পথে ? এই নিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত আলোকপাত করেছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।




অভিমানি বর্ষা , বর্ষণ কৃপণ নিষ্টুর রুপ ধারণ করেছে এই বছর । জলের অকালে বিবর্ণ জনজীবন । মানুষের জল হাহাকার , জল নিয়ে মানসিক চিন্তার পারদ বাড়ছে । একক সমস্যা নয় , পুরো দেশময় মানবকুলের প্রধানতম সমস্যার ঝাড় হতে চলেছে জল চিন্তা । হঠাৎ করেই এমন চরম জলঅচলাবস্থার পরিস্থিতি
তৈরি হলো কেন ? এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াবার সময় এসে গেছে আমাদের সামনে । এক , বৃষ্টির জল অন্যান্য বছরের থেকে ৫০ শতাংশ কম  হওয়া অবশ্যই একটি প্রধানতম কারণ , সঙ্গে মানুষ্যজনের অসচেতন মানসিকতাও অনেকটাই দায়ী । আমাদের দেশে জলের বন্টন মূলত অসামঞ্জস্যপূর্ন । কোন প্রান্তে জলের প্রবল ঘাটতি রয়েছে , ১৫ - ২০ কিলোমিটার দূর থেকে জল আনতে হয় , আবার কোথাও জল এতটাই পর্যাপ্ত যে অকারণেই জল অপচয় হয় । এই দুই প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হবে একশ্রেণীর বেনিয়া গোষ্টির অহিতকর ভূমিকা । দেশের একাধিক সফ্ট ড্রিংকস কর্পোরেট সংস্থা (থামস আপ , কোকাকোলা , স্প্রাইট , লিমকার মত একাধিক সংস্থা ) নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থে ভূগর্ভস্থ জল ভান্ডার থেকে তুলে নিচ্ছে অমূল্য জলফোটা । প্রতিদিন ৫ লক্ষ লিটার জলের প্রয়োজন হয় এক একটি কোক ম্যানুফ্যাকচারিং প্লান্টের জন্য । পুরো দেশময় এমন ৫৮ টি প্লান্ট আছে । সারা বছর এই প্লান্টগুলো ১০ হাজার ৫৮৫ মিলিয়ন লিটার জল উত্তোলন করে । শেষ কুড়ি বছরের হিসাব ধরলে সফ্ট ড্রিংকস কর্পোরেট সংস্থাগুলো যে পরিমাণ  ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন করেছে তার পরিমাণ ২১১.৭ মিলিয়ন কিউব লিটার । যা আগামী এক বছর পুরো দেশের  জলতেষ্টা মেটাতে সক্ষম । 

 বাতাস ছাড়া জীবন ধারণ যেমন অযৌক্তিক কল্পনা , তেমনি জলব্যতীত মানবজীবনের গল্পও মুখরিত হতে পারে , এমন কল্পশক্তির অধিকারী গবেষক  রুপকথার গল্পকাহিনীতেও বেমানান  । চেন্নাইয়ে এক লিটার জলের দাম ৪০০ টাকা , ভাবলেই শিহরিত হতে হয় । ১০০ টাকা পেট্রেলের  দাম শুনে মূর্ছা যান যে মানুষকুল , তাঁরাই ৪০০ টাকা লিটার দরে জল কিনে পান করছে , বিষয়টি অন্য পৃথিবীর গল্প শোনার মত মনে হচ্ছে ।  অনেকেই একই জল দিয়ে স্নান সহ জীবনের অন্যান্য জলক্ষুণ্ণি করছে ।বিষয়টি বেশ চিন্তার , এবং এখনই জল সংরক্ষণে  ব্রত না হলে আগামী দিনে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশকেই  চরম জলসংকটে পড়তে হবে , এই বিষয়টি বুঝতে জল বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই । তবে  হঠাৎ করে এমন চরম জল - অব্যবস্থা তৈরি হলো কেন ? বিশেষজ্ঞদের মতে আমাদের দেশের বিশাল মানব সম্পদের ব্যবহারের জন্য প্রতিবছর অন্ততঃ প্রায় ৩,০০০হাজার বিলিয়ন ঘন মিটার  জলের প্রয়োজন রয়েছে । প্রতিবছর প্রায় ৪,০০০ বিলিয়ন ঘনমিটার বৃষ্টির জল হয় , তবে এ বছরে আমাদের দেশের বৃষ্টির পরিমাণ অপেক্ষাকৃত কম । বৃষ্টির পরিমাণ কম হওয়ায় (গত দশ বছরের তুলনায় এ বছর বৃষ্টির পরিমাণ ৫০ শতাংশ কম )এবার দেশের প্রায় ৫৫ শতাংশ এলাকায় খরাপ্রবণ হয়ে উঠেছে । 

সবচেয়ে প্রবল জল সংকটের মুখে পড়েছে চেন্নাই । রাজধানীতে জল সরবরাহ করবার জন্য প্রশাসন যে চারটি জলাধারের উপর নির্ভর করে , সেই চারটিই এবার শুকিয়ে কাঠ । আসবাবপত্র সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য বিক্রয় করে সেখানকার মানুষ জল কিনছেন । খুবই সহজেই অনুমিত হয় , চেন্নাইয়ের জল সংকট কত্তটা ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে । তবে শুধু চেন্নাই নয় , এখনই সতর্ক না হলে আরও অনেক বড়ো জল সংকটে পড়তে পারে দিল্লি , হায়দ্রাবাদ , বেঙ্গালুরু সহ ২১টি শহর  । গবেষকদের মতে , এক্ষুনি জল অপচয় বন্ধ না করলে এই ২১ টি শহরের জল ভান্ডার ২০২০ সালের মধ্যে নিঃশেষ হওয়ার মত অবস্থার মধ্যে পড়বে । বিশেষজ্ঞগণ আরও আশঙ্কা করছেন , দেশের ৯১টি মূল জলাধারের মধ্যে খুব তাড়াতাড়িই ৫৯টি জলাধারে প্রবল জলের ঘাটতি দেখা দেবে । 

চেন্নাই সহ দেশের অন্য প্রান্তে জলের যে অভাবজনিত ভয়ঙ্কর জল সংকট দেখা দিয়েছে , সেটা বেশ চিন্তার । আমাদের রাজ্যে জলের পরিমাণ উদ্বৃও থাকলেও এক্ষুনি সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে । জল জীবন , জল ব্যতীত মানবজীবন কল্পনা করতেও ভিতরে  কম্পন ওঠে । গবেষণায় যে সব জলবিষয়ক উদ্বেগের চিত্র ধরা পড়ছে , তা শুভবুদ্ধি সম্পূর্ণ জনমানবের রক্তচাপ বাড়াবে , এ বিষয়ে দ্বিমত নেই । গবেষণায় উঠে আসা তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে , ২০২০ সালের মধ্যে দেশের প্রধান ২১টি ভূগর্ভস্থ জলভাণ্ডার শেষ হয়ে আসবে । বিপদে পড়বেন ১০ কোটি মানুষ । 
২০৩০ সালের আগেই আমাদের দেশ ভালো রকম জলসংকটের কবলে পড়বে । মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ মানুষকে দেওয়ার মত পর্যাপ্ত পরিমাণ জল আমাদের জলভান্ডারে কম থাকবে । 

আমাদের দেশ শুধু নয় , পুরো পৃথিবীই জলসংকটের দ্বারে এসে দাঁড়িয়েছে । গবেষকদের মতে , ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষকে প্রবল জলসংকটের মুখোমুখি হতে হবে ।  পৃথিবীর ৯৭.৫ শতাংশ জল পান ও চাষ অযোগ্য । মোট জলভাণ্ডারের মাত্র ২.৫ শতাংশ জল পানযোগ্য । সেটাও আবার সহজলভ্য নয় । এই ২.৫ শতাংশের মধ্যে ৬৯ শতাংশ জল আসে হিমবাহ থেকে এবং ৩০ শতাংশ ভূগর্ভস্থ জল । জনসংখ্যার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জলের চাহিদা বাড়ছে । আশঙ্কার বিষয় হলো , এই পরিমাণ অংশ জলও ক্রমশঃ নিঃশেষ হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছে  । 

জল অন্য আর পাঁচটা প্রয়োজনীয় খাদ্যবস্ত মত নয় , যে এড়িয়ে যাওয়ার প্রশ্ন থাকবে । জীবনের গল্প সচল রাখতে জলের জোগান রাখা দরকার । প্রয়োজনের কম পানীয় জল , মানব সভ্যতাকে ধ্বংশের কিনারে  কান ধরে দাঁড় করিয়ে দেবে । সে ধ্বংশের দায়ও আমাদেরকেই নিতে হবে । বিভিন্ন কলকারখানা এবং ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা মিনারেল জলকোম্পানি সহ অন্যান্য বহুবিধ উপায়ে ভূগর্ভস্থ জল  উত্তোলন করবার ফলে  জলভান্ডার প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসছে ।  প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত জলও জলসরবরাহে সহায়ক ভূমিকা নেয় । কিন্তু এই বছর বৃষ্টির জলও অপেক্ষাকৃত কম হওয়ার এক ভয়ঙ্কর সমস্যার কবলে পড়েছে আমাদের দেশ ।
নীতি আয়োগের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিবছর জলঅল্পতার কারণে দুই লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় । আগামীতে এই সংকট আরও ব্যাপক আকার নিতে পারে । এই মুহুর্ত থেকেই জল ব্যবহারে সতর্কতা দেখানোর প্রয়োজন রয়েছে ।বর্তমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দেখে অনুমিত হয় ২০২৫ - ৩০ সাল নাগাদ দেশের জনসংখ্যা ২০০ কোটির কাছাকাছি হবে । পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান জনসংখ্যা ৯ কোটি প্রায় । এই বিপুল জনসমুদ্রের জন্য পর্যাপ্ত জলসরবরাহ অক্ষুন্ন রাখতে হলে  সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা এবং সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা দরকার । বৃহত্তর ভাবে সমাজ ভাবুক মানব সমাজকে মুখর হতে হবে , এগিয়ে আসতে হবে , এই চরম জলসংকটের হাত থেকে অব্যহতি পাওয়ার জন্য । সচেতনতা বাড়াতে হবে সর্বস্তরে । জল অপচয় করলে আগামী দিনে ভয়ঙ্কর রকম বিপদ অপেক্ষা করছে , এই বিষয়টি বোঝাতে না পারলে , এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় নেই । সেজন্যই জল ব্যবহারে আমাদের সকলকেই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে । অহেতুক জল অপচয় একদমই নয় । প্রতি বিন্দুই অমূল্য । জল সঞ্চয় করুন , ভবিষ্যৎ করুণ জলসংকট থেকে বিশ্বকে বাঁচাতে আসুন আমরা সকলেই ঐক্যবদ্ধ হয় । নিজে জল অপচয় থেকে বিরত থাকুন  , অন্যকেও জল অপচয় না করতে উদ্ভুদ্ধ করুন । তবেই এই সংকটকে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হবো আমরা ॥ 



লেখক 
আরিফুল ইসলাম সাহাজি 
 ৭৯০৮১১৮৬০০


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।