কাশ্মীর ও জহরলাল নেহেরু , একটি সমান্তরাল আলোচনা । লিখছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।



গাজা ভূখন্ড প্যালেস্টাইন এবং ইজরায়েলের দ্বন্দ ফ্যাসাদের কেন্দ্রিক অংশ , তেমনি কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তান , দুই রাষ্ট্রের সম্পর্ক সৃষ্টিলগ্নপর্ব থেকে আজ পর্যন্ত আগ্নেয়গিরি আকার ধারণ করে রয়েছে । সুপ্ত অবস্থায় থাকলে বেশ চলে সম্পর্কের সমীকরণ , তবে জাগ্রত হলেই উত্তপ্ত বিদ্বেষের লাভা দুই ভূখন্ডের সম্পদ এবং মানুষকে খাতের কিনারে দাঁড় করায় । বলতে গেলে সব দ্বন্দ ফ্যাসাদের মূল ঝাড় কাশ্মীরই , দেশবিভাগের সময় কাশ্মীর সমস্যার সুষ্ট সমাধান সম্ভব হলে মনে হয় প্রতিবেশী হিসাবে দুই দেশের সম্পর্ক এমন বিশ্রীরকম খারাপ পর্যায়ে পৌঁছাতো না । কাশ্মীর সমস্যার গভীরতা উপলব্ধ করতে , কাশ্মীর সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা দেওয়া দরকার । লোককথানুসারে , কাশ্মীর আসলে শুষ্ক ভূমি , নামের অর্থনুসারেই এইরুপ অভিধা । সংস্কৃতে ' কা ' শব্দের অর্থ জল , অনুরুপ ' শীমিরা ' শব্দের অর্থ ভূমি । দ্বাদশ শতাব্দীর মনীষী কলহন কাশ্মীর কেন্দ্রিক একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন , নাম 'রাজতরঙ্গিণী', সেখানে বলা হয়েছে , পূর্বে কাশ্মীর ছিল একটি হ্রদ । ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতে আসেন প্রখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং , তিনিও ' ' কাশ -মি -লো ' রাজ্যের কথা উল্লেখ করেছেন । শিখগৌরব মহারাজা রণজিৎ সিংহ সাল ১৮১৯ নাগাদ কাশ্মীর দখল করেন , দখলের পূর্বে পাশতুন উপজাতিয় দুরানী রাজবংশ ছিল কাশ্মীরের প্রশাসক । সর্বগ্রাসী ইংরেজ শাসকের নজর প্রথম থেকেই ছিল ভূস্বর্গের উপর , প্রথম ইঙ্গ শিখ যুদ্ধের পর ক্ষতিপূরণ হিসাবে জোর করেই মহারাজার কাছ থেকে কাশ্মীর কেড়ে নেয় ব্রিটিশরা । তবে অর্থলোলুপ ইংরেজ কোম্পানি জম্মুর রাজা গোলাপ সিংহকে কাশ্মীর বিক্রি করে দেয় অমৃতসর চুক্তি করে । গোলাপ সিংহ কাশ্মীরের সঙ্গে জম্মুকে জুড়ে পুরো ভূখন্ডের শাসক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন । ১৯৪৭ সালের দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত জম্মু ও কাশ্মীর হিন্দু রাজাদের অধীনে ছিল , ওই সময় জম্মু ও লডাক অঞ্চল ছাড়া পুরো রাজ্যে মুসলমানরাই ছিলেন সংখ্যায় বেশি । 

১৯৪৭ সালের দেশভাগ মূলত ধর্মভিত্তিক ,অর্থাৎ যে প্রদেশ বা অঞ্চল সমূহ মুসলমান সংখ্যাধিক্য , সেই প্রদেশ সমূহ নিয়েই গঠিত হওয়ার পরিকল্পনা ছিল জিন্নাহ সহ পাকিস্তানের অন্যান্য নেতৃত্বের । সেই যুক্তিতেই তাঁরা পুরো কাশ্মীর দাবি করে বসেন , তবে ভারতের পক্ষেও কাশ্মীর দাবি ছাড়া সম্ভবপর ছিল না । ফলে পাকিস্তানের দাবি ঘোরতর বিরোধিতা করেন শক্তিশালী ভারতগড়ার প্রথম দিনের কান্ডারীরা । শেষমেষ বিষয়টি কাশ্মীর এবং কাশ্মীরের রাজা হরি সিংহের উপর ন্যস্ত করা হয় ,  ভারত না পাকিস্তান কোন ভূখন্ডের সঙ্গে যুক্ত হবেন ? হরি সিংহ প্রথম দিকে স্বাধীন কাশ্মীরের জন্য চেষ্টা করতে থাকেন , তলে তলে কোনভাবে নিজের ক্ষমতা ধরা রাখবার এই চেষ্টায় , কোন রাষ্ট্রে কাশ্মীরকে অন্তভূক্ত করবেন , এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করছিলেন । অপরদিকে পাকিস্তান কাশ্মীর বিষয়ে ক্রমশঃ অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছিল , বক্রপথে হলেও কাশ্মীরের অন্তভূক্তি তাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছিল । একপ্রকার লোভের বশে পাকিস্তান কাশ্মীর আক্রমণ করে বসে , মহারাজ হরি সিংহ পড়েন মহাবিপদে , সাহায্য নিলেন  ভারতের কাছ থেকে এবং ২৬ অক্টোবর ১৯৪৭ সালে কাশ্মীর ভারতের অঙ্গরাজ্য এই চুক্তিপত্রে সাক্ষর করেন । 

কাশ্মীরের ভারতভুক্তির বিষয়টি পাকিস্তান প্রথম থেকেই মেনে নিতে পারেনি , তাঁদের ঠকানো হয়েছে , পুরো কাশ্মীর তাদের প্রাপ্য এমন একটা চিত্রকল্প প্রথম থেকেই পাকিস্তানের হর্তাকর্তারা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল । ফলে আজন্ম এক সংঘাতের পথে পা বাড়ালো সদ্যজাত প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্র । এখনও পর্যন্ত কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে অন্ততঃ  তিনটে যুদ্ধ হয়েছে (১৯৪৭ ,৬৫ ,৯৯)। খণ্ড যুদ্ধ তো  রোজ হয়  সীমান্তে । পন্ডিত নেহেরুর বড় প্রিয় ছিল ভূস্বর্গের মাটি , কাশ্মীরের মুসলমান এবং নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও ছিল মধুর । স্যার ক্রিপসকে তিনি ১৯৪৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর একটি চিঠির উত্তরে জানিয়ে ছিলেন , কেন তাঁরা কাশ্মীরকে পাকিস্তানকে এমনিই নিয়ে যেতে দেননি । ক্রিপসকে তিনি লিখেছেন , ' ' শুধুমাত্র ভৌগোলিক গুরুত্বের কারণেই আমরা কাশ্মীরের জন্য লড়াই করিনি । এটা শুধু ভূমিযুদ্ধ নয় , এর কারণ আরও অনেক গভীরে প্রোথিত । কাশ্মীরের মুসলমানরা আব্দুল্লার নেতৃত্বধীন , যাঁরা জিন্নার দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিরোধী । কাশ্মীরকে ভারতের অন্তভূক্ত করা আমাদের কাছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ । কারণ তা সারা দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের সমস্যার সমাধান করবে ' ' । যদিও পন্ডিত নেহেরুর এই মূল্যায়ন বর্তমান প্রেক্ষিতে অপ্রাসঙ্গিক , কাশ্মীর সংকট এত রক্তাক্ত হয়ে উঠবে , তা অনুমান করা তাঁর পক্ষেও সম্ভবপর ছিল না । 

সাল ১৯৪৭ পন্ডিত নেহেরুর একটি সিদ্ধান্ত কাশ্মীর সমস্যাকে আরও ধোঁয়াশাপূর্ণ আকার দেয় , কাশ্মীর সমস্যাকে তিনি রাষ্ট্রপুঞ্জে উপস্থাপন করেন । রাজনীতিক বিশেষজ্ঞদের মতে , নেহেরুর সিদ্ধান্তটি অপরিপক্ক ছিল । কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ , মহারাজা হরি সিংহ নিঃস্বার্থভাবেই ভারতীয় ইউনিয়নে যুক্ত হয়েছিলেন । লর্ড মাউন্টব্যাটেন স্বয়ং ২৭ অক্টোবর , ১৯৪৭ সালের সেই খসড়াই সাক্ষর করেন । আইনগত ভাবে কাশ্মীরে ভারতের অধিকার প্রাপ্তি সম্পূর্ণ হয় ওই চুক্তিতেই । ঠিক চারদিন পর পন্ডিত নেহেরু কাশ্মীর বিষয়টি  রাষ্ট্রপুঞ্জে নিয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে একটি  রাজনীতিক ভূল । কেন নেহেরু কাশ্মীর সমস্যাকে রাষ্ট্রপুঞ্জে উপস্থাপন করলেন , এ বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে একাধিক বিশেষজ্ঞগণ এই সিদ্ধান্তের পিছনে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন । সাল ১৯৪৭ এর ২৬ ডিসেম্বর মাউন্টব্যাটেনকে লেখা একটি চিঠিতে পন্ডিত নেহেরু লেখেন , ' উই শ্যাল প্রসিড উইথ দিস ইউএনও ম্যাটার । ' সে সময় পশ্চিম পাঞ্জাব এবং কাশ্মীরে অনুপ্রবেশকারীদের  ভিড় ছিল চেপড়াপড়া । ২৮ শে ডিসেম্বর অ্যাটলিকে লেখা একটি চিঠিতে সেই উদ্বেগের কথাই  পন্ডিত নেহেরু উল্লেখ করেছিলেন , সেই চিঠিতে তিনি লেখেন , ' ' ...সীমান্তের অনুপ্রবেশকারীদের চাপে কাশ্মীর সীমান্ত পর্যুদস্ত । আমাদের সৈন্য বড়োসড়ো আক্রমণের আশঙ্কায় । শুধুমাত্র জম্মু - কাশ্মীর নিয়ে বিপদ নয় , আমাদের সবার । ' ' আসলে শান্তিপ্রিয় নেহেরু কাশ্মীর নিয়ে সুষ্ঠ এক সমাধান চেয়েছিলেন , কিন্তু রাষ্ট্রপুঞ্জে বিষয়টি উপস্থাপন করায় বিষয়টি আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয় । এটা হওয়া কাম্য ছিল না , কেননা কাশ্মীর যেমন ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ , তেমনি কাশ্মীর সমস্যাও ভারতের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ বিষয় । তবে বিষয়টি রাষ্ট্রপুঞ্জে উপস্থাপিত হওয়ার পর পাকিস্তান শিবির উজ্জ্বীবিত হয়ে ওঠে । পাকিস্তানী নেতৃত্ব আন্তর্জাতিক মহলে তাঁদের বঞ্চনার গল্প শোনাবার সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যান এবং সদ্ব্যবহারও করেন । 

১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি করাচিতে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতের রাষ্ট্রপুঞ্জে যাওয়ার বিষয়টি সমর্থনের সুরেই বলেন , শুধু কাশ্মীর কেন , ভারত পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সবদিকটিই রাষ্ট্রপুঞ্জে কাছে দৃশ্যমান হওয়া দরকার । এতদিন বিষয়টি ছিল দ্বিপক্ষীয় , এবার আন্তর্জাতিক মহলও সুযোগ পেল কাশ্মীর সমস্যা বিষয়ে নাক গলাতে । এমনকি পাকিস্তান জুনাগড় এবং হায়দ্রাবাদকেও নিজেদের সঙ্গে সংযুক্তির হাস্যকর দাবি করে । ১৯৪৮ এর শেষের দিকে রাষ্ট্রসংঘ প্রথম পাকিস্তানকে ' অ্যাগ্রেসর ' তকমা দেয় । যা ভারত পাকিস্তানের সম্পর্ককে আরও তিক্ততার পর্যায়ে নিয়ে যায় । পরিস্থতি উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রসংঘের সমাধান সূত্র মেনে নিয়েছিল ভারত । তবে বিষয়টি দাঁড়ায় হিতের বিপরীতে । ওই একটি মাত্র ভূল , স্বাধীন হওয়ার পরও নেহেরুর মাউন্টব্যাটেনের পরামর্শ ধারণ ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতিতে এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে । যা স্বাধীন ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং শান্তির পথে এঁকে দেয় অনেক প্রশ্নচিহ্ন । সদ্যোজাত রাষ্ট্রের শুরুর দিনের এই ভ্রান্ত কূটনীতির রেশ এখনও অনেকাংশেই বহন করতে হচ্ছে । পন্ডিত নেহেরু বিষয়টি রাষ্ট্রপুঞ্জে না তুললেই পারতেন , তাহলে আর্ন্তজাতিক মহল কাশ্মীর বিষয়ে নাক গলানোর যেমন সুযোগ পেতেন না , তেমনি বিষয়টি একান্ত ভারতবর্ষের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসাবেই থাকতে পারতো । 

কাশ্মীরের উপর তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিৎ , এমন একটি ধারণা উত্তরাধিকার হিসাবেই মিশে গেছে পাকিস্তানের রক্তে । ফলে ভিতরে ভিতরে কাশ্মীর হস্তগত করবার একটা চেষ্টা এখনও রয়েছে পাকিস্তানের কিছু মানুষের মধ্যে । চোরাগোপ্তা পথে উগ্রবাদী সংঘটনগুলো  কাশ্মীর  আজাদ করেঙ্গে ,এই  স্লোগান সামনে রেখে  উত্তপ্ত করে দেয় দুই দেশের পরিস্থতি । কিছু বিষয়ের বোধহয় সমাধান সম্ভব নয় , কাশ্মীর তেমনি একটি বিষয় । ভারত পৃথিবীর অন্যতম সামরিক শক্তিধর দেশ এবং ভারতবর্ষের ১৩০ কোটি মানুষ মনে করেন কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ , পাকিস্তানের পক্ষে কাশ্মীর ছিনিয়ে নেওয়া অলৌকিক এবং হাস্যকর একটা বিষয় । দুই দেশের শান্তির জন্য পাকিস্তানের উচিৎ কাশ্মীর দাবি ত্যাগ করা , তাছাড়া উপায়ও নেই তাঁদের কাছে । উইকিপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্যনুযায়ি , ২০১০ সালের হিসাবে আজাদ কাশ্মীর এবং গিলগিট বাল্টিস্থানের উত্তরাঞ্চল মিলিয়ে কাশ্মীর উপত্যকার মোট ৩৭ শতাংশ পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণভুক্ত । ওই অংশটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকুক পাকিস্তান , বাকিটুকু নাই ভারতেরই থাক । । 

লেখকের এই প্রবন্ধটি দৈনিক যুগশঙ্খে প্রকাশিত । 


লেখক
আরিফুল ইসলাম সাহা
আ লাপন : 7908118600

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।