: আধুনিকতা , উত্তর আধুনিকতা কি শ্লীলতা ও অশ্লীলতার পরিআবহবোধ মুক্ত করছে গণসমাজকে ? এই বিষয়ে লিখছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি ॥








শ্লীলতাকে অতিক্রম করলে আগেকার দিনে ভীষণই নিন্দিত করা হত সেই বিশেষ ব্যক্তি কিম্বা ব্যক্তি সমষ্টিকে , সমাজ চ্যুত বা একঘরে করার মত নিদান জারি করতেন সমাজপতিগণ । শ্লীল অশ্লীল বিষয়ে মারাত্মক রকম সতর্কতা সেই সময়পর্বে লক্ষ্য করা যেত । কেমন পোশাক পড়তে হবে , দেহের কতটুকু অংশ মানুষের দৃশ্যগোচর হবে , এই সমস্ত বিষয়েও একটা অলিখিত নিয়ম সেই সময়কালে ছিল । বিষয়টা ধর্মভেদে তখনকার দিনে আলাদা ছিল না । ইসলাম ধর্মের একেবারেই শুরুতেই শ্লীলতার একটা বিশেষ পরিআবহ বা দিকনির্দেশ ছিল । পোশাক দেহের অতিগোপনীয় অংশসমূহের গোপনীয়তা রক্ষা করবে , এমন পোশাক পড়বার বিধান ইসলাম ধর্মে বরাবরই কিন্তু ছিল । সারা দেহ আবৃত্ত করা রাখবার মতো যে পোশাকটি সাধারণত মুসলিম উম্মাহর অতি প্রিয় সেটি হল হিজাব । তবে হিন্দু কিম্বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের মাঝেও শ্লীলতাকেই মান্যতা দেওয়া হত , এককথায় বললে ভালো চোখে দেখা হত । সোজাসুজি বললে , শুধু চারিত্রিক দোষ , অর্থাৎ সমাজ বিরুদ্ধ যে আচরণ সমূহ রয়েছে , যেমন পরকীয়ার উন্মত্ততা কিম্বা যৌনতার সমাজগত দিকনিদেশর্নার বহিরঙ্গের প্রকাশ শুধু নয় , অপেক্ষাকৃত ছোট পোশাক পরিধান করলেও সেটি অশ্লীলতা হিসাবেই গণ্য করা হত । 


বর্তমান , অর্থাৎ এই যে সময় ও কালপর্বের মধ্যে আমাদের জীবনের গল্পগুলো রোজ মুখরিত হয়ে উঠছে , সেখানকার প্রেক্ষিত এবং মানস গঠন পূর্বের তুলনায় বেশ ভিন্ন । আগেকার মত মা মাসিদের যুগ এখন আর নেই , এ বিষয়ে কোন রুপ দ্বিমত নেই । ওই কাজটি করো না কিম্বা ওত ছোট কাপড় পড়লে লোক কি বলবে , এই গোছের কথা এখন খুব একটা চাউর হয় বলে তো মনে হয় না । তবে একেবারেই পুরোটাই পাল্টে গেছে সমাজ , এমনটি বললে আবার ভূল বলা হবে । বিশেষ করে গ্রামের দিকে , তবে সেই বিরাট বিধিনিষিদ্ধতার ইন্দ্রজাল গ্রামীণ জনজীবনকেও এখন আর প্রভাবিত করে না । তবুও , পোশাকের ব্যবহারে এখনও এখনকার জনপদে শ্লীল অশ্লীল ব্যাপারটা ওঁৎ পেতে রয়ে গেছে । তাই অনেক সময়ই দেখেছি প্যান্ট শার্ট পরিহিত যে সমস্ত মেয়েরা গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাঁটেন , তাঁরা অনেকেই বিদ্রুপের শিকার হয়েছেন । তবে সব জায়গাতেই হবেন এমন নয় , ওই যে বললাম কিছু জায়গায় । 

ব্যতিক্রমী কিছু জায়গা ব্যতীত বর্তমান সময় কালপর্বের মানুষ শ্লীল অশ্লীল বিষয়ে মাথা ঘামাতে খুব বেশি আগ্রহী নন । অর্থাৎ দৃষ্টিভঙ্গিগত বৈচিত্র সব সময় ছিল , এখনও থাকবে সেটায় স্বাভাবিক । তবে এখনকার সময়ের সবচেয়ে ভালো একটা বিষয় হলো , এখন আর কেউ কাউকে নিয়ে ভাবতে ওতটা আগ্রহী নন , অর্থাৎ যাঁর জীবন সিদ্ধান্তও তাঁর একান্ত নিজস্ব । তিনি কেমন পোশাক পড়বেন , কয়টা সম্পর্কে জড়াবেন , অথবা সমাজ মান্যতা দেয় না এমন যৌন সঙ্গে লিপ্ত হবেন কীনা , সেটা তাঁর ব্যক্তিক বিষয় । এই সমস্ত বিষয় , এখন আর খুব একটা আলোড়ন ফেলতে দেখা যায় না । সমাজিক ভাবে বয়কট বা সমাজচ্যুতি তো অনেক পরের ব্যাপার । সভ্য এমন আধুনিক যুগ ও সময়ে সমাজিক দৃষ্টিকোন এমনই হওয়া উচিৎ । যদিও অনেকক্ষেত্রে এর উল্টো চিত্রও আমাদের চোখে পড়ে , যেমন খাপ পঞ্চায়েত কিম্বা শালিশি সভার নামে নির্যাতন । 

আধুনিকতায় কাম্য , তবে অতি আধুনিকতা কাম্য হওয়া উচিৎ ? আধুনিকতার একটা অপসংজ্ঞায়ন করা হচ্ছে । নিঃসন্দেহে জীবন যার , জীবনচক্রের মূল হোতাও অবশ্যই তিনি । তবে কারও জীবনাচার আর পাঁচজনের মূল্যবোধে আঘাত করুক , এমন বিষয় বোধহয় কাম্য নয় । বিষয়টিকে ব্যাখ্যাপূর্ন করা দরকার , বেশ কিছুদিন আগে কলকাতা মেট্রোতে এক বিরাট লঙ্কাকান্ড ঘটেছিল , আপনারা জানেন । দুই চুম্বনরত , ভালো করে বললে গণলোক ভর্তি মেট্রোতে একজন যুবক ও যুবতী যৌনউত্তেজক কর্মে লিপ্ত ছিল , অতঃপর মেট্রোর কিছু মানুষ ওই যুবক যুবতীকে উত্তম ধোলায় দিয়েছিলেন । বিষয়টি নিয়ে সেই সময় ভয়ঙ্কর রকম হইচই হয়েছিল । সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে রাগ , বিদ্বেষ ভরিয়ে  দিয়েছিলেন , অধিকাংশই সেই চুম্বনরত যুবক যুবতীর পক্ষে ।অনেককেই সেই সময় বলতে শুনেছি , আহা কি দেশে বাস করি , এখানে রাস্তাতে মলত্যাগ করলে দোষ নেই , অথচ চুমু খেলেই যত দোষ । আমারও ভয়ঙ্কর রকম রাগ হয়েছিল , কোন পাশবিক অত্যাচারই কাম্য নয় । তবে একেবারেই পাবলিক প্লেসে চুমুটুমু একটু অস্বস্তি লাগে , এই সময়ের ছেলে হয়েও বলতে অসুবিধা হয় না । আসলে ওতটা আধুনিক বোধহয় আমরা এখনও হয়ে উঠতে পারিনি । 

আরও একটা আপত্তি রয়েছে , ' সাহসী ' এই শব্দবন্ধটির অপপ্রয়োগ করার একটা বিরাট প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় । আগেকার সময়ে  ' সাহসী ' শব্দটির ব্যবহার করার বিষয়ে গণমানবরা বেশ সচেতন ছিলেন । কোন যুদ্ধজয়ী বীর সৈনিক , যিনি একাই একশ না হলেও শত্রুর ভয়ে রণক্ষেত্র থেকে না পালিয়ে যাননি , বরং পেশী শক্ত করেছেন এবং জীবন মৃত্যুর অদৃশ্য রেখাবরাবর লড়াই করেছেন , ফলাফল যায়হোক না কেন । তিনি জিতলেও সাহসী , হারলেও সাহসী সৈনিক রুপেই আখ্যায়িত হতেন । অথবা জীবনযুদ্ধে চরম অব্যবস্থার মধ্যে পড়েও ভবনদী সাঁতরে যিনি এভারেস্ট চড়েন , তিনিই সাহসী মানুষ । ভীরু কাপুরুষদের মত হেরে যাননি ,লড়াই করেছেন এবং সাফল্যও অর্জন করেছেন । 


 সাহসী শব্দবন্ধখানি অতি গুরুত্বপূর্ন , শব্দটির ব্যবহারে সতর্ক হওয়া উচিৎ । সাহসী শব্দবন্ধটি বীর সৈনিক অভিনন্দন বর্তমানদের মতো শ্রদ্ধেয় জনগণের  জন্য ব্যবহার উপযোগি । তবে বর্তমান সময় ও কালপর্বে ' সাহসী ' শব্দটির কিছুটা অপপ্রয়োগ  হচ্ছে । ' সাহসী লেখক ' , ' সাহসী নায়িকা ' , ' সাহসী মা ' , এমন অনেক শব্দ আমাদেরকে প্রায় শুনতে হয় , আমরা শুনিও । ' সাহসী লেখক ' শব্দবন্ধটি যাঁকে উপযাজক হয়েই উপহার দেওয়া হচ্ছে , তাঁর সাহিত্যের বেসাতি ঘেঁটলে অনেকক্ষেত্রেই (সর্বত্র নয় , ব্যতিক্রমী বিষয় নিয়ে বলছি ) দেখা যায় তিনি ধর্মীয় ভাবাবেগকে আঘাত করেই  সাজিয়ে তুলেছেন তাঁর সাহিত্য শরীরের এক একটা ইঁট । হাঁ , অবশ্যই তিনি ধর্মের ভালো মন্দ দিক তুলে ধরবেন , এ বিষয়ে আপত্তি করা কোন সমালোচক লেখক কিম্বা সাধারণ গণমানুষের উচিৎ নয় । তবে এক্ষেত্রে হয় কি , সাহিত্যের শাশ্বত যে চিরন্তন কাব্যগুণ একজন স্রষ্টাকে অমর আকাশের তারা করে তোলে ,  তার ধারে কাছ দিয়েও যেতে পারেননি সেই লেখক কিম্বা লেখিকা । যেহেতু তিনি ধর্মকে আঘাত করেছেন , অতএব তিনি সাহসী লেখক , তাই তাঁকে মাথায় তুলে নাচো ।

আবার সিনেমার রুপালী জগতেও সাহসী শব্দবন্ধটির ব্যবহার করা হচ্ছে একটু নতুন আঙ্গিকে । কাউকে ' সাহসী নায়িকা ' বলা হয় এখন একটি বিশেষ মানদণ্ডের উপর নির্ভর করে । সেই চিত্রভিনেত্রী কত ছোট কাপড় পড়ছেন , দেহের গোপন অঙ্গসমূহের কতটুকু অংশ দর্শকদের জন্য তিনি উন্মুক্ত করছেন বা কতখানি যৌনউত্তেজক চিত্রে তিনি অভিনয় করছেন , তার ভিত্তিতেই সাহসী তকমাখানি দেওয়া হচ্ছে । 

আসলে , সময়ের সঙ্গেই  চিন্তা চেতনার নদী তার গতিপথ পাল্টে নিয়েছে । আগেকার দিনে শ্লীলতাকে অতিক্রম করলেই নিন্দা করা হত । এখন নিন্দা তো করা হয়ই না , বরং প্রশংসা  করা হয় । তবে একটা বিষয় লক্ষ্য করবার মতো , বিষয়টি বেশ উপভোগ্যও , দেখবেন , যাঁরা এই তথাকথিত অতিআধুনিক বিষয় বলে সানন্দে অশ্লীলতাকে আলিঙ্গন করছেন , তাঁরা কিন্তু বাস্তবজীবনে , অর্থাৎ সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের  বাইরের যে সত্যকার জীবনখানি রয়েছে সেখানে মারাত্মক রকম শ্লীলতার পক্ষপাতি । তবে , সোশাল মিডিয়ায়  কেন উল্টো রুপ ? আসলে ওরা সত্যকার মুখটাকে এনে নিন্দিত হতে চাইছেন না । তাই স্বগর্বে মুখোশটাকে সামনে আনছেন  । কেননা , অশ্লীলতার বিরোধী কিম্বা মেট্রোর চুম্বনকান্ডের বিরোধিতা করলেই নীতিপুলিশগণ মধ্যযুগীয় বস্তাপচা ধ্যান ধারণার মানুষ বলে নিন্দিত করবেন , এই ভয় থেকেই অনেকেই সত্য কথা যেমন বলেন না , তেমনি লেখেনও না  । আধুনিকতা অর্থ এই নয় যে , সব নব্যজিনিসকে গোগ্রাসে গিলতে হবে । খারাপ বিষয় থেকে দূরে থাকাও তো আধুনিকতা । আরও একটা বিষয় কেউ কাপড় খুললে যেমন সাহসী অভিনেত্রী হয়ে যান না , তেমনি ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করেও কেউ সাহসী লেখক হতে পারেন না  , তিনি আঙ্গিক , প্রকরণ ও সাহিত্যবোধকে কত্তটা ছুঁতে পারছেন সেটায় আসল । আমাদের শব্দভাঁড়ারে শব্দের আকাল পড়েছে কি ? যত্রতত্র সাহসী শব্দের ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া উচিৎ  । 

প্রবন্ধটি দৈনিক কলমে প্রকাশিত । 


লেখক 
আরিফুল ইসলাম সাহাজি 
 ৭৯০৮১১৮৬০০



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।