দ্রোহের কবি রুদ্র মহম্মদ শহীদুল্লাহ শুনতে পেতেন সমকালীন বাংলাদেশের ক্রন্দন। লিখছেন প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।




সময়ই কবিতার জন্ম দেয় , গেঁথে দেয় কাব্য শরীরে এক একটা ইট । রুদ্র মহম্মদ শহীদুল্লাহ মূলত দ্রোহ এবং বিপ্লবের কবি । কোথায় পেলেন তিনি ক্ষোভে ফেটে পড়বার এই তেজদীপ্ত  আস্ফালন । সময়ই দিয়েছে সেই অমোঘ সত্যবাণী লিখবার হিম্মত  । ২৯ আশ্বিন , ১৩৬৩ বঙ্গাব্দ , ইংরেজি ১৬ অক্টোবর ১৯৫৬ সালে রুদ্র মহম্মদ শহীদুল্লাহের জন্ম । চার বছর আগে সম্পূর্ণ হয়েছে ভাষার জন্য রক্তক্ষয়ী লড়াই । রাজপথ ভিজেছে বাংলার দামাল ছেলের বুকের রক্তে । সময় তো দ্রুত পরিবর্তন হয় না । রুদ্রের জন্ম সময় কালপর্ব বাংলাদেশের ইতিহাসে খুব একটা গৌরবময় নয় । দেশে চলছে পাকিস্থানী শাসনব্যবস্থা । ফলত রুদ্র মুহম্মদের শৈশব কেটেছে পরদেশীয়দের যাচ্ছেতাই রকম উৎপীড়নের ভিতর । জীবনের চলার প্রথম পর্বেই শাসকের ন্যায়হীনতা ও অসাম্যের পক্ষে সওয়ালের বিরুপে কিশোর রুদ্র মুহম্মদের মানস অজান্তেই মুক্তিকামি মানুষের মত ন্যায়রক্ষক হয়ে উঠছিল । সাল ১৯৬৯ উত্তাল হয়ে উঠল পুরো বাংলাদেশ , ক্ষোভে ফেটে পড়ল আস্ত বাংলাভাষী একটা ভূখন্ড । শৃঙ্খল মুক্তির লালসা শক্তিশালী রাষ্ট্রের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিল প্রায় নিরস্ত্র মুক্তি অক্ষকে । রুদ্র মুহম্মদ মুক্তিসংগ্রামের অংশ হয়ে উঠতে সচেষ্ট হয়ে উঠলেন । মা শিরিয়া বেগম একরত্তি রুদ্র মুহম্মদকে ছাড়পত্র দিলেন না , কেননা ততদিনে আব্বা ওয়ালিউল্লাহকে ধরে নিয়ে গেছে পাকসেনারা । এই অপঘাত , সময়ের রক্তবমির নির্গমন রুদ্রকে ক্রমশঃ দ্রোহের পথে টানছিল তাঁকে । 

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শুধুমাত্র দ্রোহের কবি , প্রতিবাদ সর্বস্ব তাঁর কাব্য শরীর , এমন বিষয়কে প্রতিষ্ঠা দিলে কবি প্রতি অবিচার হবে । এক অনন্ত বিস্তৃত বহুগামী স্বর ছড়িয়ে রয়েছে কবিতার প্রতিটা শব্দে । শহীদুল্লাহের কবিতা পাঠ করতে গিয়ে মনে হয়েছে  দুর্ভাগা বাঙালি পাঠককুল , মৃত্যু ছিনিয়ে নিল বাংলাকাব্যের এই অনন্য স্বরকে । মাত্র ৩৪ বছরের ছোট একটা জীবন , ভাবতে অবাক লাগে এত অল্প সময়েই তিনি বিনির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন নিজস্ব ঘরানা । সত্তর দশকের কাব্যে তাঁর গৌরবময় স্থান সুরক্ষিত । মুক্তি যুদ্ধের ভয়ঙ্কর আবহে লালিত কিশোর রুদ্র স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলা কাব্যধারায় যুক্ত করলেন নির্ভীক এক কাব্যময় স্বর । আপোষহীন সে স্বর , মেরুদন্ডহীন কবি নামের অকবিদের মত নিজেকে বিকিয়ে দিলেন না তিনি । রাজনীতিক উন্মাদনা , আবেগের বেগময় আস্ফালন এবং উদার জীবনবোধ রুদ্রকে দিল স্বতন্ত্রতা । অন্ধকারের মাঝে জ্বাললেন সত্যের টর্চ , ভিড়ের অংশ হলেন না , বরং ভিড়কে নিজের দিকে টেনে আনতে সক্ষম হলেন । সমসাময়িক বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী বিপর্যয়কে আঁকলেন দক্ষ চিত্রশিল্পীর মত । সমাজ জীবনের অসঙ্গতি , হতাশা , অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে রুদ্রমুর্ত্তি ধারণ করলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ । বাংলাদেশের আত্মার ক্রন্দন শুনতে পেতেন শহীদুল্লাহ , পিতৃদত্ত নাম মুহম্মদ শহীদুল্লাহের আগে তিনি রুদ্র যুক্ত করেছিলেন স্বইচ্ছায় ,  ফেটে পড়বার ইঙ্গিতই বহন করে তাঁর রুদ্র নামের সংযুক্তিকরণে ।



রুদ্রের কবিতা অতিমাত্রায় রাজনীতিমনস্ক । তাঁর স্বল্প  অথচ গৌরবময় জীবনের  প্রায় পুরোটাই রাজনীতিক অবক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে । ভাষা আন্দোলন না চাক্ষুস করলেও মুক্তিসংগ্রামের উত্তাপ তাঁর শরীর ভেদ করে হৃদয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর মত থাবা বসিয়েছিল । কৈশোর কালসীমা পেরিয়ে যৌবনের শক্তভূমিতে এসেও যুবক রুদ্র সমাজিক অসাম্যে পুরো বাংলাদেশকে ডুবতে দেখলেন  । রক্তাক্ত সময়কে ধরতে গিয়েই কবিতার নান্দনিক শাশ্বত আস্বাদ কোথায়ও যেন খেই হারিয়ে ফেলল রুদ্রের কবিতা থেকে , কিন্তু রুদ্র স্বৈরাচারি সেনা শাসকের বিরুপে দাঁড়িয়ে দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন , 
       ' ' ফাঁসির মঞ্চ থেকে আমাদের যাত্রা শুরু 
          এক একটি জন্মের সমান মেধাবী মৃত্যু 
          এক একটি প্রতিজ্ঞা - পুষ্ট মৃত্যুর সোপান 
        দুর্যোগ - অন্ধকারে তুলে রাখে সূর্যময় হাত 
        মৃত্যুর মঞ্চ থেকে 
        মৃত্যুর ভূমি থেকে 
        আমাদের প্রথম উত্থান । ' ' 
              ( ' ফাঁসির মঞ্চ থেকে , '  রচনা সমগ্র )
স্বৈরাচারি শাসক দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় , সেই কালপর্বে এমন সত্যকথন কাব্য শরীরে অঙ্কন করতে নিঃসন্দেহে হৃদয় প্রশস্ত হতে হয় । বিপদ ওঁৎ পেতে আছে রাজপথের অলিগলিতে জানতেন রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ , কিন্তু সময় সব নিজের হাতে তুলে নেয় এবং কবিকে বাধ্য করেন কাব্যশরীরে গেঁথে দিতে সময়ের প্রসব যন্ত্রণা । সময়ের দাবি মেনেই লেখেন রুদ্র , 
   ' ' যে ভাবে তোমার চোখে মিশে থাকে বেদনার লাভা /বিস্ফোরণ বুকে নিয়ে আমিও তেমনি আছি /আমার নিকটে রাখো , বুকে রাখো শীতার্ত স্বদেশ _ / প্রয়োজন ছাড়া আমি জ্বলি না কখনো । ' ' 
                 [ নিরাপদ দেশলাই , রচনা সমগ্র ]
স্বদেশের এই রক্তমুখ বিস্ফোরণের উন্মাদনাকে সম্বল করে রুদ্র সাজান তাঁর কাব্যের বেসাতি । এই দ্রোহই তাঁর কবিতার মূল সুর । তবে কবিআত্মার বহুগামীতাও তাঁর কবিতায় ঘর বেঁধেছে সাবলীলভাবেই । মানব অস্তিত্বের ভাঙাগড়া , ব্যক্তিমুখীনতা , প্রেমও রুদ্রের আরাধ্য । তবে স্বার্থপরের মত আত্মপ্রেমের বাড়বাড়ন্ত নেই , ব্যক্তির পরিবর্তে সমষ্টিই রুদ্রের কাব্যের শরীরী ভাষা হয়ে উঠেছে । সেখানে শরীর আছে , ফুলের উপর টান আছে আর ঘাপটি মেরে রয়েছে প্রত্যাখ্যান । রুদ্র লেখেন , 
' ' অতোটা হৃদয় প্রয়োজন নেই , 
  কিছুটা শরীর কিছুটা মাংস মাধবীও চাই । 
 এতোটা গ্রহন এতো প্রশংসার প্রয়োজন নেই , 
    কিছুটা আঘাত অবহেলা চাই প্রত্যাখান । ' ' 
            [অবেলায় শঙ্খধ্বনি , রচনা সমগ্র ]
সময়ের বুকে যখন রক্ত , দেশের বেশিরভাগ মানুষ যখন অনাহারে দিন কাটান সেই বিপ্রতীপ সময়ে প্রেমের বাতিতে অগ্নিযোগ কবির অপ্রয়োজনীয়ই মনে হয় । তাই রুদ্রের কবিতাই প্রেমের বেসাতি শক্তপোক্ত হয়নি , সচেতন ভাবেই এড়িয়ে গেছেন তিনি । ফুলের সৌন্দর্যে বিমোহিত হলেও আত্মাহুতি দেননি কবি , কেননা সময়ের পেটে ভয়ঙ্কর ক্ষুধা , রাজনীতিক দীনতা রুদ্র দাঁড় করিয়ে দিয়েছে খাদের কিনারে । তাই তিনি সাহসের অগ্নিস্ফুলিঙ্গে পথ চলেন - 
' ' সাহস আমাকে প্রেরনা দেয় 
   জীবন কিছুটা যাতনা শেখায় 
   ক্ষুধা ও খরার এই অবেলায় 
           অতোটা ফুলের প্রয়োজন নেই । ' ' 
          [ অবেলায় শঙ্খধ্বনি , রচনা সমগ্র ] 



রুদ্রের একটি সাড়াজাগানো কবিতা ' বাতাসে লাশের গন্ধ ' । কবিতাটির অন্তঃমূল্যায়নের মধ্য দিয়ে আসুন কবি মনকে আর একটু ভালো করে বুঝে নিই । রুদ্রের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ' উপদ্রুত উপকূল ' , প্রকাশিত হয়  ১৯৭৯ সালে ।'  উপদ্রুত উপকূল ' কাব্যগ্রন্থের প্রকাশ সালটা লক্ষ্য করুন । ৭১ এ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে দুর্ধর্ষ পাকহানাদারদের কাছ থেকে মুক্তিকামি বিপ্লব সাধকগণ ছিনিয়ে এনেছেন স্বপ্নের স্বাধীনতা । বাংলাভাষী মানুষগুলো পেল আস্ত একটা ভূখন্ড । পৃথিবীর মানচিত্রে গজালো একমাত্র বাংলাভাষী রাষ্ট্র বাংলাদেশ । বিষয়খানি অসম্ভব সুখকর অভিজ্ঞান , তাতে কোনরুপ দ্বিধা থাকবার কথা নয় । বিপ্লব ততক্ষণ পর্যন্ত যুগান্তরকারী আলোড়ন নয় যতক্ষণ তা সফলতার সিঁড়ি চড়ে লাল সূর্য্যের মত নিজেকে তেজদীপ্ত করছে । লক্ষ মানুষের রক্ত , আত্মত্যাগ , মহীয়সী নারীর লুপ্ত সম্ভমের বিনিময়ে পাওয়া সে স্বাধীনতা । বিদেশী শক্তি এখন সীমান্তের ওপারে । একটা উৎপীড়ন শূন্য জীবন আশা করছেন বাঙলার মানুষ । স্বাধীন দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত  হলেন সকলের প্রিয় , চোখের মণি বঙ্গবন্ধু সেখ মুজিবর রহমান । ভয়ঙ্কর ত্যাগের বিনিময় প্রাপ্ত স্বাধীনতাভোগ বাঙালির ভাগ্যে সইলো না বেশিদিন । দেশটাকে গুছিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেলেন না বঙ্গবন্ধু । শত্রুর দেশে দীর্ঘদিন বন্দি অবস্থাতেও তিনি অক্ষত থাকলেও অস্তিনের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল সাপ । পাকহানাদার বাহিনীর পতন হলেও মুক্তিকামি মানুষের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল তাদের দোসররা । মুখোশ তারা খুলল সাল ১৯৭৫ এ , নিহত হলেন বঙ্গবন্ধু সপরিবারে । দেশের স্বাধীনতা আবারও বিপন্ন হল । দেশের ক্ষমতাসীন হলেন স্বাধীনতা বিরোধী অক্ষ । অসহায়তার পাঁকে আবার নিমজ্জিত হবার উপক্রম হল মুক্তিকামি মানুষজন । সেনা শাসনে বাঁচবার মৌলিক অধিকারগুলোও ক্ষুণ্ন হতে থাকলো । নৈরাজ্য , দুঃশাসন , ক্ষমতার অপপ্রয়োগে অতিষ্ট হয়ে উঠল সকলে । 

মুক্তি প্রাপ্তি এবং আবার অধরা এই পর্বান্তরের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারল না দেশের মানুষ । অমুক্তির ঘানিতে পাক খাওয়ার যন্ত্রণা থেকেই শ্রদ্ধেয় কবি শামসুর রহমান লিখেছিলেন , 
 ' ' তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা,
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?

তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,
সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর।' '
মুক্তির এই অপ্রাপ্তি আর পাঁচজনের তরুণ রুদ্রকেও ব্যথিত করল । ক্ষোভে ফেটে পড়তে চাইল তাঁর অন্তরাত্মা । দ্রোহের কাছে আশ্রয় নিল তাঁর কাব্য শরীর । তেজদীপ্ত কবিতায় মুখরিত হয়ে উঠল প্রথম কাব্যগ্রন্থটি । অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেল রুদ্রের কবিতা ' বাতাসে লাশের গন্ধ ' । রাজনীতিক অবক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে গেছে তাঁর পুরো জীবন । বরাবরই তিনি মুক্তির পক্ষে , স্বাধীনতা বিরোধীদের সঙ্গে তাঁর ভয়ঙ্কর রকম আড়ি । ভীরুতা , অসহায়ত্ব নয় মুক্তি বিরোধী অক্ষের রক্তচোখকে যাচ্ছেতাই রকম তাচ্ছিল্য করে রুদ্র লেখেন , 
   ' ' আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ 
      আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি , 
      ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি
      তন্দ্রার ভিতরে .....' ' 
দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা আসীন তারা ভয়ঙ্কর রকম স্বৈরাচারি , মুক্তির  স্বরকে বিপদজ্জনক শিকল পড়াতে সদা তৎপর । এক বুক যন্ত্রণা রুদ্রের ' অন্তর বাহিরে ' , কোন ভয়ে তিনি প্রকম্পিত নন , কেননা তিনি সময়কে অস্বীকার করে সত্য সুন্দরের গান গাইতে পারেন না ।'  কত প্রাণ হল বলিদান ' , শৃঙ্খল মুক্তির জন্য যে ত্যাগ , তা কিভাবে বিস্মৃত হবেন তিনি । দেশের মানুষকে আয়নার সামনে দাঁড় করান রুদ্র , 
   ' ' এ দেশ কি ভূলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত , সেই রক্তাক্ত সময় ? ' ' 
ক্ষণিকের মুক্তি স্বাদ , তারপর আবারও খাঁচায় বন্দি হওয়ার যে অবস্থা বাঙালি জাতির ললাট লিখন হয়ে দাঁড়ালো , তা রুদ্রের অন্তরকে পিত্তিগেলা মাছের মত কুৎসিত আস্বাদ দিল । এ কেমন স্বাধীনতা ? রুদ্র লেখেন , 
  ' ' এ যেন নষ্ট জন্মের লজ্জায় আড়ষ্ট কুমারী জননী , স্বাধীনতা - 
একি তবে নষ্ট জন্ম ? 
একি তবে পিতাহীন জননীর লজ্জার ফসল ? ' '
অপশক্তির বিরুপে লড়তে গিয়ে কত সম্ভাবনাময় জীবন হারিয়েগেছে অন্ধগলিতে , কোন স্বপ্নে বিভোর হয়ে তাঁরা হাসতে হাসতে শত্রুর বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন ? স্বপ্ন তাঁদের একটাই ছিল , উত্তরসুরিরা আস্ত একটা দেশ পাবে , যেখানে বৈষম্য থাকবে না , উৎপীড়ন থাকবে না , আড়চোখে দেখবে না কেউ । লক্ষ সোনার জীবনের বিনিময়ে প্রাণের অধিক প্রিয় যে স্বাধীনতা তার সঠিক রূপায়ন হল না । মসনদে আসীন হল নব্য পাক । কোথায়ও যেন স্বাধীনতার আস্বাদ ভুলণ্ঠিত হল । রুদ্রের চোখ এড়ায় না , তিনি লেখেন , 
' ' জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরনো শকুন । ......
মাটিতে রক্তের দাগ - 
চালের গুদামে তবু জমা হয় অনাহারী মানুষের হাড় । ' ' 
রুদ্র শুধু কবি নন , তিনি সময়ের কণ্ঠস্বর । একজন সচেতন সংবেদনশীল মুক্তিকামি মানুষ । ভিতরে ভিতরে এক প্রবল অন্তর্দাহে পুড়ছেন তিনি । সহযোদ্ধারা যখন নিজেদেরকে রকমারি মুখোশে ঢাকতে ব্যস্ত , রুদ্র তখন শপথ নেন , মুখোশের আড়ালে থাকা মুখটির উন্মোচন তিনি করবেনই । তিনি কবি হতে চাননি হয়তো , বিপ্লবী কিশোর হিসাবেই নিজের কর্তব্য পালন করে গেছেন । নুপুংশক কবিদের দলভুক্ত হতে চাননি তিনি , স্রোতের বিপ্রতীপে দাঁড়াতেই তাঁর আনন্দ । তাই সংবেদনশীল রুদ্র আজ শুনতে পান , 
 ' ' তন্দ্রার ভেতরে আমি
    শুনি ধর্ষিতার চিৎকার , 
  নদীতে পানার মতো ভেসে থাকা মানুষের 
  পচা লাশ , 
মুন্ডুহীন বালিকার কুকুরে খাওয়া বীভৎস শরীর 
ভেসে ওঠে চোখের ভেতরে । ' ' 
চাইলে রুদ্র আর পাঁচটা নামধারী অকবিদের মত সময়ের উপর উন্নাসিক থেকে তাঁবাদারি জুটিয়ে নিতে পারতেন লাভের ভাগ । রুদ্র বাংলাসাহিত্যে রুদ্রমুক্তিই ধারণ করতে চেয়েছিলেন , স্বার্থপরের মত সময়কে অস্বীকার করবার দুঃসাহস করেননি । অল্পবয়সেই তিনি অসম্ভব পরিপক্ক ছিলেন , অন্ততঃ তাঁর রাজনীতিক সজ্ঞানতা তো সেই সাক্ষ্যই বহন করে । রুদ্রের কবিমানসে তাই অচিরেই ঘাপটি মেরে বসে পড়লো স্বদেশ , স্বকাল আর দেশের মানুষের করুন চিত্রকল্প । তাই রুদ্র বলতে পারেন , 
' ' রক্তের কাফনে মোড়া - কুকুরে খেয়েছে যারে 
  শকুন খেয়েছে যারে , 
  সে আমার ভাই , সে আমার মা , সে আমার প্রিয়তম পিতা । ' ' 
আর স্বাধীনতা ? রুদ্রের সব জড়ো হয় মুক্তির উন্মাদনায় । আর পাঁচজন মুক্তিকামি মানুষের মত তিনি স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর । এক নিষ্কলুষ স্বাধীনতা , যেখানে মুক্তির স্বাদ আস্বাদ করবেন সকলেই । দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বিক্ষুব্ধ হন তিনি , এই কি সেই স্বাধীনতা ? যার স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল পুরো দেশ ! সুখের সকাল বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি , অসাম্যের বালুচরে হারিয়ে গেছে  সেই সাম্যময় । প্রিয়জনের রক্তে কেনা এমন স্বাধীনতা বোধহয় তিনি চাননি । পড়ুন , 
' ' স্বাধীনতা ,  সে আমার স্বজন , হারিয়ে পাওয়া একমাত্র স্বজন -
স্বাধীনতা - আমার প্রিয় মানুষের রক্তে কেনা অমূল্য ফসল । 
ধর্ষিতা বোনের শাড়ী ওই আমার জাতির রক্ত পতাকা । ' ' 


মূলত রুদ্রের ভাবনার পিরামিডের সিংহভাগ অংশই জুড়ে রয়েছে দেশমায়ের যন্ত্রণাকর রক্তসিক্ত আঁচল । প্রবল ভাবে দেশ ও মানুষ জড়িয়ে গেছে তাঁর শব্দপ্রাচীরে । অনন্ত সে বন্ধন । সঙ্গত কারণেই তাঁর কবিতাই উঠে এসেছে সাম্যময় দেশ গঠনের জোরালো দাবি । দ্ব্যর্থহীন সে কণ্ঠ , অকুতোভয় সে স্বর । এক চিলতে সুখের জন্য তিনি লড়ে গেছে পুরোটা জীবন । ব্যক্তিসুখ নয় , সমষ্টির কল্যাণ নিমিত্ত গ্রহণ করেছেন প্রত্যয়ের শপথ । এ যেন নতুন বিদ্রোহী ।   ' ' শুধু রক্ত দিয়ে আজ পাল্টানো যাবে না           জীবন / 
    শুধু রক্তে আজ আর কৃষ্ণচূড়া ফুটবে না ডালে /শুধু মৃত্যু দিয়ে আজ আর পাল্টানো যাবে না আঁধার / অস্ত্র চাই , অস্ত্র চাই , স্বপ্নবান অস্ত্র চাই হাতে । ' ' 
তিনি ড্রয়িংরুম বিলাসী কবি নন ,  শব্দবোমায় স্বৈরাচারির বিরুদ্ধে আস্ফালনে ফেটে পড়েছেন , দ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দিয়েছেন দিক থেকে দিগন্তে । সম্মলিত সংস্কৃতিক জোটের (কবির নিজ হাতে গড়া সংস্কৃতিক মঞ্চ )সভাপতি গোলাম কুদ্দুস রুদ্রকে ' তারুণ্যের দীপ্ত কবি ' নামে আখ্যা দিয়েছেন , 
   ' ' সমাজিক দায়বদ্ধতা আর রাজনীতিক দর্শনের কথা কবিতায় ধারণ করেছিলেন রুদ্র । বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর স্বাধীনতা চেতনা যখন ভূলুণ্ঠিত , তখন রুদ্রের কবিতায় ফুটে উঠেছে দেশপ্রেমের কথা । রুদ্র তখন লড়ছেন অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ার আন্দোলনে । ' ' 
এই দ্রোহ , রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করবার স্পৃহা রুদ্রকে জনপ্রিয় করে তুলেছে , মৃত্যুর পরও যার খামতি নেই । কেননা তিনি সস্তার দেশপ্রেম , আবেগের উদ্গীরণের পরিবর্তে স্রোতের বিপরীতে মানুষের পক্ষে লড়েছেন । রুদ্রের কবিতাগুলো পড়লে ভিতরে এক অসহায় যন্ত্রণা অনুভব হয় । দেশের ভাটিয়ালী সুর কোথায় যেন অস্পষ্ট সুরে ক্রন্দন করছে , সেই সুরকে রুদ্র কবিতার শরীরে ধারণ করেছেন । হারতে দেননি , হারাতে দেন না প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ । এই দ্রোহই , সময়কে ধারণ করবার এই অসাধারণত্ব বাংলাভাষী পাঠকের হৃদকবরে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করে রাখবে । কেউ বিরক্ত করবে না রুদ্রকে । 



আরিফুল ইসলাম সাহাজি 
 ৭৯০৮১১৮৬০০

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।