ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানতাপস ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। এই বিষয়ে আলোকপাত করেছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।



বহু ভাষার বিদগ্ধ  পন্ডিত , ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানতাপস মনীষী ড.মহম্মদ শহীদুল্লাহ । ভাবের সমুদ্রে নোঙর ফেলবার পূর্বে , একটা বিষয় স্পষ্ট করে দিই , আর পাঁচটা লেখার গতানুগতিক ভাবপ্রবাহের ছকে আঁকতে চাইছি না শ্রদ্ধীয় ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেবের প্রতিকৃতি । বিষয়ের গিঁট খোলা প্রয়োজন , পাঠকের সঙ্গে লেখকের দূরত্ব তৈরি হলে মুশকিল । গর্বে অন্তর পূর্ণ হয় তাঁর নাম উচ্চারণেই , তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক আকাশ আবেগ , শ্রদ্ধা আর ভাললাগা । বিষয়টি এখনও বোধহয় স্পষ্টত ব্যাখ্যপূর্ণ হল না , কেননা মনীষী ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেব তাঁর পূর্ণ জীবনদশায় যে ভাবে বাঙলা ভাষা এবং অধম এ জাতির সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন , তাতে আপামর বাঙালির হৃদয়ের মনিকোঠায় জ্বলজ্বলে নক্ষত্রটি হয়েই তো থাকবেন , সেটায় কাম্য এবং স্বাভাবিকও তো বটে ।  বিষয়টি আমার ক্ষেত্রে পৃথক এবং আলাদা বৈচিত্রপূর্ণ হলো কী করে ? কেনই বা এমন ছকভাঙা ঢংয়ে শুরু করলাম লেখাটা , এ প্রশ্ন পাঠকের অন্তরে উদিত হতেই পারে । প্রহেলিকার চাদরে কণ্ঠস্বরকে আর অস্পষ্ট করা বোধহয় উচিৎ নয় , আসলে যাঁর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আবেগ , শ্রদ্ধা এবং অহংকার , তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে পাঠককে একটু বিব্রত করলেও লেখককে তাঁরা ক্ষমা করবেন বলেই মনে হয় । ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আমার অহংকার , আমাদের গৌরব , আমাদের মাথা উঁচু করবার সেই জ্বলন্ত প্রদীপ , যার নিচে কখনও আঁধার নামে না । তাঁর ফেলে যাওয়া জন্মভূমি ,  যেখানকার ধুলাবালি একদিন ধন্য হয়েছিল মহামানবের চরণস্পর্শে , সেই পবিত্রভূমিতেই জন্ম এবং তাঁর নামাঙ্কিত কলেজ থেকেই স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এ অধম । এবার কী  পাঠক বলবেন , ড.শহীদুল্লাহ সাহেবকে নিয়ে আপামর বাঙালির যে আবেগ , শ্রদ্ধা , ভাললাগা একটু হলেও আমার ক্ষেত্রে পৃথক এবং বৈচিত্রপূর্ণ নয়  ! সময়ে , অসময়ে ছুটে যায় তাঁর জন্মভূমি হাড়োয়ার পিয়ারা গ্রামে , স্পর্শ করি সেই ভূধূলি , এক আস্বাদনীয় গৌরব অনুভূত হয় অজান্তেই । 

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র , তার উপর ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেবের নামাঙ্কিত শহীদুল্লাহ স্মৃতিমহাবিদ্যালয় থেকে পাঠ সম্পূর্ণ করার সময়পর্বে তাঁকে বিস্তৃত  জানবার সুযোগ হয় । তাঁকে জানবার এক অদম্য চাহিদা বশ করে , সেই জানবার স্তর উন্নয়নের ক্রমপর্বে চমকিত হয়েছি বার বার । এমন এক মহামানবের জন্মভূমিতে জন্মাতে পেরে অহংকারও করেছি , যখনই বিদ্যালয় , বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই চিরাচরিত প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি  , তোমার এলাকায় জন্ম নেওয়া একজন মনীষীর নাম বলো তো ? গর্বে বুক ফুলে উঠেছে , হাত উদ্ধে তুলে উচ্চস্বরে গর্জন করেছি , মনীষী ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহের পবিত্র জন্মভূমির পাশেই আমার ঘর । পরে যখন তাঁকে আরও বেশি করে জানবার সৌভাগ্য হয়েছে , তখন কোথায় যেন একটা অস্পষ্ট বেসুর তারে গাওয়া আক্ষেপ অন্তরকে পীড়িত করেছে , তাঁর যতটুকু সন্মান প্রাপ্য ছিল , তাঁর ঋন তো আমরা পরিশোধ করতে পারবো না , তিনিও কখনও প্রতিদান যদিও চাননি , তবুও তাঁর প্রাপ্য সন্মান আমরা কী তাঁকে দিতে পেরেছি ? মনে হয় না । 



ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী , বাংলাভাষা চর্চায় তাঁর গবেষণা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে । বিষয়টি অত্যন্ত চর্চিত , শহীদুল্লাহ চর্চায় নিমগ্ন সাধক এবং সাধারণ পাঠক সকলেই অবগত আছেন । শ্রদ্ধীয় শহীদুল্লাহ সাহেবের একটি অমর কৃতিত্ব পাঠকের সামনে উন্মুক্ত করার অভিলাষ রাখছি । তিনি শুধুমাত্র অমর ভাষাতাত্বিক নন , আদ্যপান্ত একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি । বিশেষ করে বর্তমান অপসময়ে যখন বিচ্ছেদের সুর উচ্চনদে ধ্বনিত হচ্ছে , ঠিক এই মুহূর্ত শহীদুল্লাহ চর্চা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক । একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম পন্ডিত হওয়া সত্ত্বেও কোন অন্ধত্ব , ধর্মান্ধতা , অপসংস্কৃতি তাঁকে বিড়ম্বিত করেনি , তিনি বিশ্বাস করতেন অন্তর থেকেই । 
' ' আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙ্গালি , ' ' 

তিনি একাধিক ভাষা জানতেন , অনন্য বিদগ্ধতা অর্জন করেছিলেন সেই সব ভাষাতেও  । তবে তাঁর গবেষণা , চর্চার মূল আধার ছিল ' আ মরি বাংলা ভাষা ' । বাংলাভাষা চর্চায় তিনি যেমন সকলকে বিস্মিত করেছিলেন তেমনি বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর  কর্তব্য নিষ্ঠাও দায়বদ্ধতার কথা বাঙালির বিস্মরণ হওয়ার কথা নয় । বিষয়টির গাঢ়ত্ব সুস্পষ্ট করতে , শহীদুল্লাহ সাহেবের এক মহান কর্মের উল্লেখ করা প্রয়োজন । পাঠককে যদি জিজ্ঞাস করা হয় , বলুন তো বাঙালির শ্রেষ্ঠতম দিবস কোনটি ? সকলেই বলবেন ,

   ' আমার ভাইয়ের রক্তরাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি , আমি কী তা ভুলিতে পারি ' । 

ঠিকই অমর একুশ আমাদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন । এবার যদি পাঠককে প্রশ্ন করা হয় , বলুন তো অমর একুশের প্রথম  ঘোষক কে ?বিষয়টি অনেকেরই অজানা , কেউ বলতে পারবেন না , এমন কথা বলা উচিৎ হবে না । একটু সচেতন এবং বাংলা ভাষা চর্চার পাঠ যাঁদের আছে , তাঁরা বিলক্ষণই জানবেন । বিষয়টির  সরলীকরণ করা দরকার , সাল ১৯৪৭ ,ভারতবর্ষ স্বাধীন হতে কয়েকমাস মাত্র বাকি । দুদেশই রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর সুদক্ষ রূপায়ণে তৎপর , এমন এক যুগপ্রেক্ষাপটে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আলোচনাপর্বে উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করবার অদ্ভুত দাবি করে বসেন । মান্যবর ড.শহীদুল্লাহ সাহেব উক্ত আলোচনা চক্রে অন্যান্যদের সঙ্গে উপস্থিত উপস্থিত ছিলেন । অন্যান্য বাঙালি পন্ডিতগণ বিষয়টি গলধঃকরন করলেও বাংলাভাষা অন্তপ্রাণ শহীদুল্লাহ সাহেব তীব্র প্রতিবাদ করেন । পাল্টা দাবি তোলেন , বাংলা ভাষা কেন রাষ্ট্রভাষা হবে না ? তিনিই প্রথম জিয়াউদ্দিন আহমেদের এই সুপারিশের অসারতা সম্পর্কে পাকিস্তানের জনসাধারণ ও শিক্ষিত সমাজকে অভিহিত করতে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। বিষয়টি ভালোভাবে হৃদজাত করতে ভাষা সৈনিক ও লেখক বদরুদ্দীন ওমরের ' পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি ' নামক গ্রন্থটির সাহায্য এবং  অংশবিশেষ উদ্ধৃতি নেবো  , এজন্য ওমর সাহেবের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি । ওমর সাহেব তাঁর ' পূর্ব বাংলা ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি ' বইতে ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেবের  বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে লেখা একটি জ্বালাময়ী প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করেছেন ।সেই প্রবন্ধের অংশ বিশেষ হুবহু তুলে দেওয়া হলো , পাঠক বুঝতে পারবেন , তাঁর বক্তব্য কতটা বলিষ্ঠ এবং যুক্তিপূর্ণ ছিল । পড়ুন -

 ‘কংগ্রেসের নির্দিষ্ট হিন্দীর অনুকরণে উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা রূপে গণ্য হইলে তাহা শুধু পশ্চাদগমনই হইবে না।... ইংরেজী ভাষার বিরুদ্ধে একমাত্র যুক্তি এই যে ইহা পাকিস্তান ডোমিনিয়নের কোন প্রদেশের অধিবাসীরই মাতৃভাষা নয়। উর্দুর বিপক্ষেও একই যুক্তি প্রযোজ্য।’ ওই প্রবন্ধে শহীদুল্লাহ আরও লিখেছেন, ‘যদি বিদেশী ভাষা বলিয়া ইংরেজী ভাষা পরিত্যক্ত হয়, তাহলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ না করার কোন যুক্তি নাই। যদি বাংলা ভাষার অতিরিক্ত কোন দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা গ্রহণ করতে হয়, তবে উর্দু ভাষার দাবি বিবেচনা করা কর্তব্য।’



বদরুদ্দীন সাহেব তাঁর ঐতিহাসিক সেই গ্রন্থে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় উপস্থাপন করেছেন , বিষয়টি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাতিল গণ্য করতে শহীদুল্লাহ সাহেব একবারও ধর্মীয় গোঁড়ামিকে প্রশয় দেননি । সেসময় কিন্তু বিষয়টি   বেশ দুঃসাহসিক , কেননা যেহেতু উর্দু অনেকটাই আরবী সমগোত্রীয় , ফলে অসংখ্য মুসলিম পন্ডিত শুধুমাত্র ধর্মীয় গোঁড়ামির বশে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা মেনে নিচ্ছিলেন । বদরুদ্দীন সাহেব শহীদুল্লাহ সাহেবের বাংলা ভাষা কেন হবে না রাষ্ট্রভাষা , এ বিষয়ক সেই তীব্র প্রতিবাদের দুর্লভ  প্রবন্ধের যে শেষাংশের উল্লেখ তাঁর গ্রন্থে করেছেন , সে অংশটুকুও উদ্ধৃতিযোগ্য ।পড়ুন , 

‘বাংলা দেশের কোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দী ভাষা গ্রহণ করা হইলে তাহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে। ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের বিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহনরূপে প্রদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষার সপক্ষে যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন আমি একজন শিক্ষাবিদরূপে উহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি। ইহা কেবল বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও নীতি বিরোধীই নয়, প্রদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতি বিগর্হিতও বটে।’

বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর এই প্রবল প্রেম বাঙালি মননে বিরাট আলোড়ন তোলে , তাঁর এই বলিষ্ঠ প্রতিবাদ একসময় গণআন্দোলনের রুপ নেয় । বাকি টুকু তো ইতিহাস , বাঙালি জাতি সর্বপ্রথম ভাষাকে কেন্দ্র করে পথে নামেন , রাজপথ রঞ্জিত হয়  রফিক , বরকত , সালামের রক্তে । সেই ঐতিহাসিক গৌরব অর্জনের প্রথম দিশা দেখিয়েছিলেন ড .মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেব । 


লেখক 
আরিফুল ইসলাম সাহাজি 
 ৭৯০৮১১৮৬০০

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।