বই আলোচনা : কবি নজরুল ইসলামের জীবন নিয়ে নাটক , একটি অন্যধারার প্রয়াস ।আলোচক আরিফুল ইসলাম সাহাজি




অধ্যাপক অনিরুদ্ধ আলি আকতারের নাটকের বই ' অনন্য নজরুল - বাচিক উপস্থাপনায় ' , পড়লাম । কাজী নজরুল ইসলামের জীবন অবলম্বনে নাটক , বিষয়টি বেশ অভিনব , নতুনত্বের দিক থেকে নাট্যকারের ভাবনা বেশ অন্যরকম । বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের  গুণী উত্তরাধিকারী পুত্রবধূ মাননীয়া কল্যাণী কাজী  নাট্যগ্রন্থটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ,  সেই নতুন ভাবনা ও অভিনবত্বগত আঙ্গিকের কথায় বলেছেন । নাট্যগ্রন্থটির  একেবারে শুরুতেই  শ্রীমতি কল্যাণী কাজী লিখেছেন , ' কাজী নজরুল ইসলামের ব্যক্তি জীবন এবং কর্ম জীবন বৈচিত্রময় । তাঁর জীবনের কিছু ঘটনাকে বিষয়বস্ত করে অনিরুদ্ধ আলি আকতার তাকে নাট্যরুপ দেবার প্রচেষ্টা করেছেন তা অভিনবত্ব দাবি করে । এই ধরনের বই আগে বেরিয়েছে বলে আমার জানা নেই । এই ধরনের বই - এর প্রয়োজন ছিল ,  নাট্যপ্রেমীদের কাছে এ এক পরম পাওয়া বলে আমি মনে করি । ' নাট্যকার কবি নজরুলের জীবনকে নাটকের প্রেক্ষিত হিসাবে গ্রহণ করলেও কল্পভাবনায় চালিত হয়েছেন কোন কোন নাট্যঅঙ্কে , ফলে পুরো নিখাদ নজরুল জীবনী বিষয়ক গবেষণামূলক নাট্যগ্রন্থ  হয়ে ওঠার সুযোগ নাট্যকার দেননি । বাস্তব নজরুল এবং কল্প নজরুল , এই দ্বৈত ভাবনা নাট্যগ্রন্থটিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে ।

নাট্যগ্রন্থটি তের অঙ্ক বিশিষ্ট , পৃষ্টা সংখ্যা  একানব্বই । প্রথম অঙ্কটি , ' চরণ ছুঁয়ে যায় - রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল ' , স্থান বোলপুর , সময় - মধ্যাহ্ন । ১৯২১ সালের কোন এক সময় কবি কাজীর সঙ্গে কবিগুরুর সক্ষাৎ হয় । বিদ্রোহী প্রকাশিত হওয়ার পর কবি কাজী বাংলা কবিতার জগতে দামি হয়ে উঠতে শুরু করেছেন । বিদ্রোহী প্রকাশের বছরেই কবি কাজী বেশ কয়েকখান ' বিজলী ' (সাহিত্য পত্র ) নিয়ে কবিগুরুর বোলপুরের বাড়িতে হানা দেন । সৌভাগ্যক্রমে উভয়ের সক্ষাৎও হয় । সেই ঐতিহাসিক সক্ষাৎকারকে ভাবনাকেন্দ্রে রেখে নাট্যকার সাজিয়েছেন এই নাট্য অঙ্কটির শাব্দিক শরীর । গুরু শিষ্যের প্রেম , শ্রদ্ধা ও স্নেহ এবং অভিমান এই অঙ্কের মুখ্য আধার রুপে প্রতিভাত হয়েছে ।

 দ্বিতীয় অঙ্কের শিরোনাম 'অগ্নি আখরে লেখা ' , চরিত্র - নজরুল ও শরৎচন্দ্র , স্থান - হুগলি জেলখানা , সময় - ১৯২৩ এর ১৭ই মে মধ্যাহ্ন । এই অঙ্কে এসে নাট্যকার কল্পভাবনায় মুখর হয়েছেন । কাজী নজরুল ইসলাম এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একই যুগের দুই প্রতিভাবান সাহিত্য সাধক । উভয়ের প্রামাণ্য জীবনকাহিনী সংক্রান্ত তথ্যাদি অনুসন্ধান করলে দেখা যায় , এককালের হয়েও অমর কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দের সঙ্গে কবি কাজীর সাক্ষাৎকার বা বাক্যালাপের বিশেষ উল্লেখযোগ্য তেমন কোন তথ্য নেই । বিষয়টি নাট্যকারকে বেশ অবাক করেছে , তিনি দুই মহান সাহিত্য সাধককে কল্পভাবনায় সক্ষাৎ করিয়ে দিয়েছেন । জেলখানায় কারাবন্দিদের সাথে খারাপ ব্যবহারের প্রতিবাদে কবি অনশনে বসেছেন । অমর শিল্পী শরৎচন্দ্র এসেছেন কবিকে অনুরোধ করতে তিনি যেন অনশন তুলে নেন , কেননা নজরুল জাতির সম্পদ । এই কল্পঅঙ্কে কবির দেশপ্রেম , অনমনীয় প্রতিবাদী সত্ত্বা , কবির প্রতি শরৎচন্দের অকৃত্তিম ভালোবাসায় মুখ্য হয়ে উঠেছে । তৃতীয় অঙ্কের চরিত্র কবি কাজী এবং নাট্যচার্য শিশিরকুমার । সাপ্তাহিক বিজলীতে বিদ্রোহী কবিতাটি প্রকাশের পর পরই বিখ্যাত হন কবি নজরুল । অন্য অনেকেরই মত নজরুলে মুগ্ধ হন নাট্যগুরু শিশিরকুমার । পরস্পর সান্নিধ্যে আসেন এবং উভয়ের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয় , তাঁদের সম্পর্ক ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধই এই  অঙ্কের  মূল আধার । চতুর্থ অঙ্কের চরিত্র কবি কাজী এবং কবি সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার । ভিনবয়সী দুই সাহিত্যরসিক বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হলেও মাঝে মধ্যেই উভয়ের মাঝে বিরোধ প্রকট রুপ ধারণ করতো । মোহিত অনুগামী সমালোচক গণের অভিযোগ ছিল , কবির বিখ্যাত কবিতা বিদ্রোহী , মোহিতলালের প্রবন্ধ ' আমি 'র বিষয়ে আধারিত ।কবি  মোহিতলাল মজুমদারও ওইরুপ অভিমত পোষণ করতেন । এই অঙ্কটির নাম ' অভিঘাত ' , যা বেশ উপভোগ্য । 

পঞ্চম অঙ্ক '  সুরের ভূবনে ' দুই গান পাগল শিল্পী মানুষের গল্পে মুখরিত , তাঁরা হলেন কবি ও সঙ্গীত শিল্পী আব্বাসউদ্দিন । ষষ্ট অঙ্ক ' শপথ সহযাত্রী ' তে কবির সঙ্গে রয়েছেন তাঁর বিশিষ্ট বামপন্থী বন্ধু মুজাফ্ফর আহমেদ । দুজনের মধ্যে মধুর বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক ছিল । দুজনেই ছিলেন একে অপরের প্রতি ভয়ঙ্কর রকম শ্রদ্ধাশীল ।  বন্ধুত্বের সম্ভাষণ , মুজাফ্ফর আহমেদের কৃষক - শ্রমিক দরদ এবং নজরুল দর্শনে , অঙ্কটি খাঁটি সোনা হয়ে উঠেছে । 

সপ্তম অঙ্ক ' নিভৃত যাপন ' এর   চরিত্র কবি ও তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী প্রমীলা । কাল - কবির অসুস্থ হওয়ার আগের তিন বছর । প্রমীলা নজরুল , কবির সুখদুঃখময় জীবনের সঙ্গী । দুটি প্রাণ , কিন্তু এক সত্ত্বা । এই অমূল্য জীবন পথরেখার শেষ তিনটি বছরের ঘটনা পরস্পরাই মুখরিত এই অঙ্কখানি । উভয়ের প্রতি শ্রদ্ধা বিশ্বাস প্রেম সৌন্দর্যে , পাঠকের হৃদয় হরণ করতে সক্ষম হয়েছেন নাট্যকার ।  অষ্টম অঙ্ক ' রুপ সাগরে মনের মানুষ ' এ মুখোমুখি কবি এবং তাঁর প্রিয়তমা প্রিয়া নার্গিস । এক ট্রাজিক অধ্যায়ের নায়ক নায়িকা নজরুল ও নার্গিস । প্রথমে প্রেম , বিবাহ এবং পরে বিচ্ছেদ । বিচ্ছেদের পরও নার্গিস বার বার কবিকে চিঠি দিয়েছেন , ফিরে আসবার আকুল আর্তিজ্ঞাপণ করেছেন ।একটি চিঠিতে  নজরুলকে  তিনি লেখেন ' তুমি তো বলেছিলে চিরদিন সাথী হয়ে থাকবে /কুড়িয়ে পাওয়া এই বণফুল মালা করে রাখবে / হে পথিক তুমি ভালোবেসে /এই তো সেদিন জড়ালে এসে / আজ তুমি হায় ছিঁড়িলে বাঁধন/ আর কি কাছে এসে নাম ধরে ডাকবে । ' নার্গিসের এ প্রেম ব্যাকুলতা পাঠকেও দুঃখী করে তোলে । নজরুলের বিয়ের তের বছর পর ১৯৩৭ সালে নার্গিস কবিকে একটা চিঠি লেখেন । চিঠি প্রাপ্তির সময় কবিবন্ধু প্রখ্যাত লেখক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন । চিঠিতে কি লেখা ছিল জানা যায় না । শৈলজানন্দ উত্তর লিখতে বললে নজরুল একটা গান লিখে দেন ' যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই / কেন মনে রাখ তারে / ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে ' ' । কবির দেওয়া উত্তর থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না , তখনও নার্গিস কবির পথ চেয়ে বসে আছেন । হয়তো শেষবারের মত চেস্টা করেছিলেন । দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর কবির সঙ্গে নার্গিসের একবার দেখা হয়েছিল । বিবাহ বিচ্ছেদের দিন । ১৯৩৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে শিয়ালদহে কমরেড মুজাফফর আহমেদের বাসভবনে সরকারি ভাবে নজরুল নার্গিসের বিচ্ছেদ সম্পূর্ন হয় । দুটি হৃদয়ের অপ্রাপ্তির এক  ট্রাজিক পরিসমাপ্তি ।

 নবম অঙ্ক ' ছিন্ন সহযাত্রী 'তে কবির দুই প্রিয়তমা নারীর কল্পসক্ষাৎ ঘটিয়েছেন নাট্যকার । দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ এই দুইটি অঙ্ক সম্পূর্ণ নাট্যকারের মস্তিস্কপ্রসূত । পল রোবসন এবং নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে নাট্যকার কবি নজরুলের কল্পসক্ষাৎ ঘটিয়েছেন । বাস্তবে এঁদের পরিচয় কিম্বা আলাপ সম্ভব না হলেও দুই ভিন্ন প্রবাসী সৃষ্টিশীল লড়াকু জীবনমুখী ভিন্ন ব্যক্তিত্ব , নাট্যকারের স্বাধীন কল্পভাবনায় জীবন ধর্মে , আদর্শগত দৃষ্টিকোন থেকে কবির কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছেন  । এভাবে পুরো নাটকটিকে উপভোগ্যময় করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন নাট্যকার । 


        '  অনন্য নজরুল , বাচিক উপস্থাপনায় ' 
              অনিরুদ্ধ আলি আকতার 
                     গ্রন্থবিকাশ 
                ৫৯/১৩ ,রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট 
                কলকাতা - ৭০০০০৯
                মূল্য : ৬০/
           

লেখক 

আরিফুল ইসলাম সাহাজি 
মোবাইল : ৭৯০৮১১৮৬০০


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।