স্থায়ী চাকরি নেই , বেসরকারি ক্ষেত্রে লাঞ্ছিত হচ্ছেন শিক্ষিত যুবক যুবতীগণ । এ বিষয়ে কলম ধরেছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
সরকারি চাকরির হাঁড়িতে মা ভবানী বাস করতে শুরু করেছে বেশ কিছু বছর । চাকরি নেই , কালেভাদ্রে দু চারটে পরীক্ষা হলেও
নিয়োগ নিয়ে ধোঁয়াশা কাটে না । ফলত , জীবনের জন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ অন্যত্র মাথা গুঁজছেন শিক্ষিত যুবক যুবতীগণ । লাঞ্ছনা , অপমান ও অনিয়মিত বেতন কাঠামোর আবর্তে অনেকেরই জীবন বাঁধা পড়ছে । বিষয়টি দৃষ্টান্তযোগে বললে পাঠক বুঝবেন ।
একটা কলেজের পাশাপাশি এক মিশন স্কুলেও পড়িয়েছি বেশ কিছু সময় । এ গল্প সেই সময়কার । গল্প বলতে সাধারণভাবে যেমন বোধ হয় আমাদের , তার থেকে এ গল্প কিছুটা স্বতন্ত্র । গল্পটি এক ঝাঁক তরুণ এবং তরুণীর ।একটা কথা প্রচলিত আছে , বেসরকারি প্রতিষ্টানে কাজ করতে গেলে চামড়াটা নাকি একটু পুরু হতে হয় । কর্তাব্যক্তিদের মেজাজ বুঝে চলতে হয় । তাঁরা শুধু বলে যাবেন , আপনি কিছু বলতে পারবেন না ।
ঠিকঠাক মাইনে দিতে চাইত না উক্ত প্রতিষ্টানটি । এটা নাকি মিশন স্কুলের ঐতিহ্য , যদিও ব্যতিক্রম নিঃসন্দেহ আছে । তবে , আমাদের এই স্কুলটা শিক্ষিত যুবকদের খুব একটা কদর করতো বলে মনে হতো না । দেখতাম , পিছনে সকল শিক্ষক কানাঘুষি করতো , কলুর বলদের মত খাটিয়ে নিয়ে মাইনে দিতে এদের এত লাগে কেন ? আমিও ভেবে পেতাম না , সত্যি সারাটা মাস এতটা পরিশ্রম করিয়ে এদের বেতন দিতে এত কিসের কষ্ট হয় । বিষয়টা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হতো না , চাকরি নেই , চারদিক বেকার অগুণতি যুবক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে । একজন চলে গেলে ওই রকম কত্ত পাওয়া যাবে , এমন একটা মানসিকতা নিয়েই চলে এই সব বেনিয়ার দল ।
দুই মাস পর এক মাসের বেতন দেওয়ার নিয়ম ছিল । যদি ভাবেন , এক মাসের বেতন এক সঙ্গে দেওয়া হতো , তাহলে আপনি মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন মশায় । ওই টাকাটিও বেশ কয়েকটা কিস্তিতে দেওয়া হতো । সাধারণত দুই মাস শেষ হয়ে কুড়ি একুশ তারিখ হলে বেতন দেওয়ার সময় আসতো । অর্থাৎ ধরলে তিনমাস প্রায় কালব্যাপি সময়ে শিক্ষকগণ এক মাসের বেতন পেতেন । মাস তিন মত ছিলাম । নিজেকে কেমন ভিক্ষুক বলে মনে হতো । সারা মাস পড়িয়ে একবার একে ধরো , একবার ওর হাতে পায়ে ধরো , ও স্যার টাকার ভীষণ দরকার , ছেলেটা অসুস্থ , বৌ এর বাচ্চা হবে , দেবেন টাকাটা ? পাঠক , এম. এ প্রথম শ্রেণী , বি.এড করা একজন মানুষের কণ্ঠে আমি ভিক্ষুকের অধিক আকুতি দেখেছি । আঁতকে উঠেছি , ভেবে পায়নি একটা সভ্য দেশে সত্যকার মানব সম্পদ শিক্ষককে এইভাবে বেনিয়াদের কাছে ভিক্ষাপাত্র পাততে হবে ? এর থেকে লজ্জার , কষ্টের ছবি আর দুটি দেখেছি বলে মনে হয় না ।
ভাবনার গভীরে আরও নিমজ্জিত হওয়ার আগে , একটা ঘটনা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিলে বুঝতে সুবিধা হবে । দুই মাস অতিক্রান্ত হয়ে চৌদ্দ তারিখ হয়েছে । হঠাৎ শুনলাম মাইনে হবে । সব্বাই জব্বর খুশি । প্রায় দশদিন পূর্বে মাইনে হচ্ছে , খুশি হওয়ারই কথা । অফিস রুমে বসে আছি সব্বাই । এক এক করে ডাক পড়ছে । তারপর যে ঘটনাটি ঘটল , মনে হয়েছিল এই অপমান সহ্য করবার চেয়ে বিষ খেয়ে মরা অনেক ভালো । দুই মাস চৌদ্দ দিন পর এক একজন শিক্ষকের হাতে দুই হাজার তিন হাজার করে টাকা দেওয়া হচ্ছে । দেখলাম সব্বার আহ্লাদ করা মুখ হঠাৎ করেই বিষন্ন হয়ে উঠল । অনেকেই সব্বার সামনে কেঁদে পর্যন্ত ফেলছে । এর থেকে বড়ো লজ্জার মুখোমুখি হতে হয়নি আগে কখনও । একজন শিক্ষক জোর করে তার ঘরে নিয়ে গেল , দেখলাম তাঁর চোখ ভিজে । দুই হাজার টাকার কত্ত টুকু বাড়িতে পাঠাবে , আর কত্ত টুকুইবা নিজের নিজের কাছে রাখবে এই বিষয়টাই সে ঠিক করতে পারছে না । বললাম , আমি ছেড়ে দিচ্ছি , আপনি দিন । তিনি যা বললেন , তাতে আরও অবাক হলাম । তিনি বললেন , আপনার রেজাল্ট ভালো , লেখালিখি করেন , অনেকেই চেনে , আপনি যেকোন কাজ পেয়ে যাবেন , কিন্তু আমি ছেড়ে দিয়ে কী করবো ? বললাম , এতটা অপমানের পরও থাকবেন ? তিনি দীর্ঘশ্বাস টানলেন একটা , তারপর বললেন , পূর্ব জন্মের পাপ এসব স্যার !
সত্যই , পূর্ব জন্মের পাপ বটে । সকালে আলু , দুপুরে আলু , রাত্রী আলু খেয়ে আবাসিক থেকে বাচ্চা পড়িয়ে চোখের জল সহযোগে মাইনে নিতে হয় , এ পূর্ব জন্মের পাপ নয়তো কী ? যাঁরা দেশ ও জাতির অহংকার , যাঁদের হাত ধরে একটি দেশ হাঁটবে প্রগতির পথে , তাঁরা এইভাবে অর্ধশিক্ষিত বেনিয়াদের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন প্রতিদিন । কোন রকম সৌজন্যবোধটুকু নেই । চাকরের মত ব্যবহার করেন । অল্প কয়েকটা টাকার বিনিময়ে শিক্ষিত ভারতকে কিনে নিয়েছে এমন আস্পর্ধা তাদের । এম . এ , বি.এড ডিগ্রি অর্জন করতেই পেরিয়ে যায় জীবনের বৃহত্তর প্রহর । মা বাবা আশায় বুক বাঁধে সন্তান যোগ্য হয়েছে সেই এবার সংসারের ঘানি টানবে । হায় রে , পোড়া দেশ ! চাকরির হাঁড়িতে মাকড়সা জাল বুনেছে আজ । মাত্র ছয় সাত হাজার টাকার বিনিময়ে এত্তদিনের অর্জিত মেধা জ্ঞান বিকিয়ে বসে শিক্ষিত মানুষগুলো । তাছাড়া করবেনটাই বা কী ? শ্রমজীবী হিসাবে কিম্বা কলের কর্মী হওয়া কী তাঁর সাজে ? তাই অর্ধ শিক্ষিত অমানবিক বেনিয়াদের অপমান সহ্য করেও মাটি কামড়ে পড়ে থাকছেন তাঁরা । ঈশ্বর তাঁদের রক্ষা করুন , মঙ্গল করুন ।
লেখক পরিচিতি
আরিফুল ইসলাম সাহাজি
রায়পুর , চাকলা ,
দেগঙ্গা , উত্তর ২৪ পরগনা,
পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ ।
আলাপন : ৭৯০৮১১৮৬০০
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন