পৃথিবী পুরুষ বৃদ্ধ হচ্ছে , এগিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে । লিখেছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
১ .
মানুষের কান্না এখন পৃথিবীর জাতীয় সঙ্গীত :
যে সূর্য রোজ পৃথিবী পুরুষের বুক চিরে সগৌরবে ওঠে , তা জীবন্ত সূর্য নয় , গ্রহণলাগা সূর্য । একটা বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবী পুরুষের পুরো শরীরময় । মানুষের সাধের এ ভূমি সুস্থ নয় । ক্যান্সারের মত এক মহাক্ষয় রোগ তাঁর হৃদপিন্ডকে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে ধ্বংশের মহাদ্বারপ্রান্তে ।একটা উন্মাদ ধ্বংশ নৃত্যে মুখরিত হচ্ছে জীবনের গল্পগুলো । ' সাধের মানব জনম ঘেঁটে ঘ ' আকার ধারণ করেছে । মানবিক বিশ্ব কিম্বা মানবিক মুখ সমূহ লুকিয়ে পড়েছে কুয়াশার আড়ালে । ভালো মানুষ কমে আসছে এমনটি কিন্তু নয় । ভালো মানুষ আছেন । যথেষ্ট পরিমাণই আছেন , তবে ক্ষীণতর স্বর নিয়ে । ফলে অত্যচারির খড়্গহস্ত শক্তপাথরের মত হয়ে ভালোমানুষের টুঁটি চেপে ধরলেও অন্য ভালোমানুষ সকল স্বকাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন জীবনের গাড়িকে সচল রাখতে । অর্থাৎ বিপদ যতসময় না শরীর ঘেঁষে এসে দাঁড়াচ্ছে কিম্বা দেওয়ালে ঠেকছে পিঠ , তার প্রাকমুহূর্ত পর্যন্ত গণভালো মানুষগণ টু শব্দটি করছেন না । প্রসঙ্গক্রমে না বললে অন্যায় হবে , সব্বাই যে এই একই দলভুক্ত এমন আপ্তবাক্য উপস্থাপন করবার দুঃসাহস দেখানোর প্রতিস্পর্ধী মনোভাব এক্কেবারেই নেই । কিছু মানুষ অবশ্যই আছেন , যাঁরা ভীষণ ভাবেই প্রতিবাদে আছেন । তবে সেই সংখ্যাটি বেশ কম । এই একটি জায়গাতে অত্যাচারীর মনোবল দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে । গণ জনমানবের একটা বড়ো অংশই কিন্তু এখন মানুষের রক্তঝরানোর পক্ষে । উইঘুর হোক , কিম্বা নিউজিল্যান্ড বা শ্রীলঙ্কান গণহত্যা হোক , সেই সকল হিংস্র মানব নামের জঙ্গলদের ' হা হা ' ইমোজি দেওয়া দেখেই তাদের মানসলোক পড়ে নিতে কষ্ট হয়না । আসলে , রক্ত চাই , এ স্লোগানের সঙ্গে কেমন যেন মানিয়ে নিয়েছেন মানব সকল । দূর দূরান্তের রক্ত ঝরা দৃশ্য এই সময় আর তাদের কাঁপিয়ে দিতে পারছে না । বরং ফেসবুক টুইটার ম্যাসেঞ্জারে জোর বাহাস চলছে তাই নিয়ে । হিংস্র রক্তপন্থা হয়ে উঠেছে মানবকুলের জীবনপথ ।
২ .
গুরু শিষ্যের সম্পর্ক দাঁড়িয়ে ধ্বংশের দ্বারপ্রান্তে :
সার্বিক অর্থে পৃথিবী পুরুষের চলার পথে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে , বিষয়টি অস্বীকার করবার উপায় নেই । মানব জীবনের প্রায় প্রতিটি পর্বই বর্তমান কাল প্রবাহে এসে ' ঘেঁটে ঘ ' সদৃশ আকার নিয়েছে । সত্য কথা শক্তভাবে বললে লিখতে হবে , একটা মানবিক অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে মুখরিত হয় এখনকার জীবনের গল্পগুলো । ফলে প্রতিটা সম্পর্কও দাঁড়িয়ে যাচ্ছে ইগো , হিংসা প্রতিহিংসার গোত্রে । সন্তান বাবা মাকে শীতের সন্ধ্যায় একাকী নির্জন রেল স্টেশনে যেমন ফেলে যাচ্ছে , তেমনি অকৃতজ্ঞ বাবা মাও সদ্যোজাত বাচ্চাকে আঁস্তাকুড়ে ফেলতেও কম্পিত হচ্ছেন না । এসবই হয়তো কালের কারসাজি । আমরা অভিযোজিত হচ্ছি মাত্র , যুগের ঘূর্ণি ঘুরিয়ে অমানবিক সভ্যতার প্রতিভূ করে তুলছে আমাদের । মূলত শিক্ষকতার পেশার যুক্ত আছি । সেই অভিজ্ঞান থেকেই গুরু শিষ্যের সম্পর্কের সেকাল একালগত পরিআবহিক পরিমণ্ডলের মানদন্ডের ওঠা নামা নিয়ে একটু আলোচনা রাখছি । পাঠক আপনারা নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন , আর পাঁচটি সম্পর্কের মতই গুরু শিষ্যের সম্পর্কের আনুপাতিক ভাগহার কিছুটা হলেও নিন্মমুখী হচ্ছে । আমাদের বিদ্যালয় সময়কার শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ছিল । গুরু বা শিক্ষক ঈশ্বরের রুপ অন্ততঃ একজন শিক্ষার্থীর কাছে । সেসময়কার শিক্ষকগণ তাঁর ছাত্রদের শাসন তর্জন যেমন করতেন , তেমনি ভালোটিও বাসতেন । শিক্ষার্থীরাও গুরুকে ঈশ্বরতুল্য জ্ঞান করতো । বলে রাখা ভালো সে রামও যেমনি নেই , সেই লঙ্কাও আজ অদৃশ্য । অর্থাৎ শিক্ষকদের মানসগত পরিবর্তন যেমন সাধিত হয়েছে , তেমনি শিক্ষার্থীদের একটা বড়ো অংশ হয়ে উঠেছে অবাধ্য , বেপরোয়া । শিক্ষার্থীদের এই বেমানানগত আচরণের জন্য নিঃসন্দেহভাবে প্রথমে কাঠগড়ায় তোলা দরকার তার পরিবারকে, অতঃপর বিদ্যালয় এবং শিক্ষকগণও এর জন্য দায়ী থাকবেন ।অনেক শিক্ষকের সর্বদাই নজর আটকা পড়বে মাসের তারিখের উপর , কবে গো হবে মাসটি শেষ ? মাইনে নেবো , ঘুরব আনন্দ করবো বেশ । ভাবলে শরীর শিহরিত হয় , এই সকল শিক্ষকগণ যথার্থই ভূমিকা পালন করলে কে বলতে পারে , সামনের বেঞ্চে বসে থাকা শিশুটি হবে না কোন দেশ গঠনের কারিগর ?
একটা অংশের শিক্ষক মহোদয়ের খাপছাড়া অবান্তর মানসিকতার জন্য ছাত্রসমাজের যেমন ক্ষতি হচ্ছে তেমনি গুরু শিষ্যের সম্পর্কের পারদও নামছে হু হু করে । শিক্ষার্থীরা অবাধ্য হয়ে উঠছে , শিক্ষককে অমান্য করছে , বিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট করছে , তবুও শিক্ষকগণ অনেক সময় নির্বিকার ভূমিকা পালন করেন । এখানে একটি কথা ঋজুভাবে উপস্থাপন করা দরকার , পাঠক বুঝবেন । বিষয়টি হল সব দায় শিক্ষক সমাজের উপর অর্পণ করলে বোধহয় অন্যায় হবে । আমরা যখন পুরোনো সময়ের গুরু শিষ্যের সম্পর্কের পরিআবহিক গ্রাফ নিয়ে আলোচনা করছি , তেমনি সেই সময়কার যাঁরা
অভিভাবক ছিলেন , তাঁদের সঙ্গে এখানকার সময়ের অভিভাবকদের তুলনা করা আশু জরুরি । একটা অভিযোগ হয়তো আমরা সাধারণ গণমানবগণ শিক্ষকদের শরীরে লেপ্টে দিই , সেটা হল শিক্ষকগণ ছাত্রদের উপর এখন আর তত্তটা যত্নবান নয় । এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন । আমার বাবাদের মুখে শোনা কথা , তাঁদের বিদ্যালয়ের জীবনের শিক্ষকগণ কী অসম্ভব দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী ছিলেন । শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা না করলে কিম্বা দুষ্টমি করলে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর শাস্তির বিধান জারি করতেন । কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরলেও অভিভাবকরা অভিযোগ করা তো দূরের কথা , মাস্টার মশায়ের সঙ্গে দেখা করে বলতেন , চোখ কান নাক বাঁচিয়ে রেখে বাঁদরটাকে মানুষ করে দিন স্যার । এবারে , এখনকার সময়ের অভিভাবকদের কথা বলি । শিক্ষক শিক্ষার্থীর ভালোর জন্য সামান্যই শাসন তর্জন করলে অভিভাবকদের সহ্যই হয় না । দলবল জুটিয়ে তাঁরা লাঠিসাঁটা হাতে নিয়ে ঢুকে পড়েন বিদ্যার মন্দিরে । ঈশ্বরতুল্য শিক্ষকদের গণধোলায় দিতেও বাধে না তাদের । এই যদি হয় অভিভাবকদের চরিত্র , তাহলে একজন শিক্ষক কিভাবে একজন শিক্ষার্থীর ভালমন্দর দায়িত্ব নেবে । মড়ার উপর খোঁড়ার ঘা , প্রশাসন থেকেও শিক্ষার্থী শাসনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে । ফলে , একজন শিক্ষক তিনি দূর থেকে আসেন চাকরি করতে । তিনি কেন জীবনের ঝুঁকি নিতে যাবেন ? তাঁরও তো পরিবার আছে , স্বজন আছে ।
৩ .
শাশুড়ি বৌমার দ্বন্দ একালের ঐতিহ্য :
শাশুড়ি বৌমার ক্ষমতার লড়াই এই কালপর্বের অন্যতম এক মাথা ব্যথার অংশ ।শাশুড়ি বৌমার এই দ্বন্দময় পরিবেশন তৈরি মূল কারণটি অবশ্যই মনস্তাত্বিক । এক অহেতুক আশঙ্কা এবং ঈর্ষা রয়েছে এর মূলকথনে । সংসারের চাবি থাকবে কার আঁচলে ? এই দ্বন্দের মূল প্রশ্নই এটি । বিষয়টিকে ব্যাখ্যাপূর্ণ করে ভাবনার গভীরে তলিয়ে যাওয়ার পূর্বে বিষয়টি ঋজু করে পরিবেশন করা দরকার । সংসার অন্তঃপুরের প্রধান মুখ হলেন মা , তিনি বহু পরিশ্রম করে দাঁড় করান একটি সংসার । স্বামী পুত্র কন্যা নিয়েই চলে তাঁর সুখ গুজরান । কন্যা সন্তানকে বিবাহ দেন আনন্দেই , তবে পুত্র সন্তানকে বিবাহ দেওয়ার সময় তিনি আতঙ্কিত থাকেন । সংসারে একজন প্রতিদ্বন্দীর আবির্ভাব ঘটে । তিনি এরপর সাধ্যমত চেষ্টা ফিকির করতে থাকেন , কিভাবে সংসার হেঁসেলের চাবিটি রাখবেন নিজের কাছে । এইটুকু মা , অর্থাৎ বাঙালি শাশুড়ি মা'দের দৃষ্টিজাত অভিজ্ঞান , বলে রাখা উচিৎ সবক্ষেত্রের মত , এ বিষয়েও ব্যাতিক্রম আছে । এবার আসুন , নববধূ যাঁরা একটি সংসারে আসছেন নতুন মানুষ হিসাবে তাঁদের দৃষ্টিকোন থেকে দেখা যাক বিষয়টি । প্রথমেই পরিষ্কার করা দরকার , শাশুড়ি মা'রা যে সময়পর্বে সংসারে বধূ হিসাবে এসেছিলেন , সেই সময়কার মহিলাদের মানস গঠনের সঙ্গে বর্তমান সময়ের তরুণী নারীগণের মানসজাত গঠনের আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে । ফলস্বরূপ শাশুড়িগণ বৌমাদের সঙ্গে নিজেদের সময়কার সময়কে মেলাতে পারেন না । শাশুড়ি একটা খুব পরিচিত কথনের সঙ্গে পাঠকের আলাপ থাকবে , কথাটি এমন - ' আমরাও তো বৌ ছিলাম , আর এখনকার এঁরা ' । নিজেদের সঙ্গে বৌমাদের মেলাতে হিমশিম খাওয়ার পিছনে কালের কারসাজি রয়েছে অনেকটাই । তখনকার সময়ের থেকে এই সময়ের ভাবনাগত পরম্পরার অনেকটাই পরিবর্তন ঘটেছে । সেই সময়ের নারীগণ অনেকটাই ছিলেন অন্তপুরবাসিনী , তবে বর্তমানে সেই বন্ধনের আগল অনেকটাই শিথিল হয়ে গেছে । নারীগণ এখন শিক্ষা সহ প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রেই পুরুষদের প্রতিদ্বন্দীতার মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে ।
সর্বঅর্থেই এই সময়ের মেয়েরা আধুনিক , শিক্ষা - সংস্কৃতিচর্চা -বৈশ্বিক ধারণা এবং বিজ্ঞান মনস্কও । সময়ের চাহিদা অনুযায়ি স্বাধীনতা বিলাসী এবং নারীবাদী চিন্তাজাত চেতনা দ্বারা তাঁদের মনজগৎ সমৃদ্ধ । এই নারীবাদী চিন্তা , অর্থাৎ নারী স্বাধীনতার পক্ষে তাঁদের সওয়াল শাশুড়ির বন্ধন থেকে মুক্তির ইন্ধন জোগাচ্ছে , বিষয়টি অস্বীকার করবার নয় । অনেকেই আবার অতিরিক্ত নারীবাদী চিন্তা দ্বারা পীড়িত , এই চিন্তার গাম্ভীর্য সংসারে ক্ষতের সঞ্চার করছে । এই পর্বে শাশুড়িদের ভাবনা সাধারণত , সংসারের চাবি আঁচলে বেঁধে তিনি ঘুরবেন , কাজ করবেন কম । এই ভাবনার পিছনে সদর্থক যুক্তি হল , এত দিন তো আমি টানলাম হেঁসেল , এবার সংসার বৌমার । পুরোপুরি সন্ন্যাস অবশ্য শাশুড়ি মা নেন না , সংসারের সকল কর্মে তিনি নিজের সিদ্ধান্তটাই চূড়ান্ত দেখতে চান । বধূদের আবার এই জায়গাতে ঘোর আপত্তি । অনেককেই বলতে শুনেছি , আমি সংসার করবো , আর আপনি ঘুরে বেড়াবেন সেটা চলছে । আসলে শাশুড়ির সন্ন্যাস গ্রহণে বৌমার আপত্তি নেই , আপত্তি চাবির গোছা সহ সন্ন্যাস গ্রহণের জায়গাতে ।
এখনকার বৌমারা অন্তপুরবাসিনী নয় , বরং অধিকাংশই শিক্ষিত । কোন রকম বন্ধন দ্বারা তাঁরা আর পীড়িত হতে চান না , অতিরিক্ত নারীবাদী চিন্তার সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করেন । একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গেছে বেশ কয়েক দশক আগেই । নিউক্লিয় ঢংয়ে এখন গঠিত হচ্ছে অনুবীক্ষণিক পরিবার সব । পতিদেবের বাবা মাকে গ্রহণ করতেও এখন ঘোরতর আপত্তি দেখাচ্ছেন অনেক পুত্রবধূ। এই দ্বন্দগত পরিআবহে ভাঙছে বাঙালির সংসার । প্রায় শুনশান স্টেশনে , খোলা মাঠে বাবা মাকে ফেলে যাচ্ছে গুণধর ছেলেরা ।
৪ .
শিক্ষিত যুবক যুবতীর হতাশা , শ্বাস এখন দীর্ঘশ্বাস :
শিক্ষিত বেকার কর্মহীন যুবকদের হতাশা বিশ্বময় এক বিভীষিকার জন্ম দিয়েছে । আমাদের দেশে এ সংকট মহামারির আকার নিয়েছে । সরকারি চাকরির হাঁড়িতে মা ভবানী বাস করতে শুরু করেছে বেশ কিছু বছর । চাকরি নেই , কালেভাদ্রে দু চারটে পরীক্ষা হলেও নিয়োগ নিয়ে ধোঁয়াশা কাটে না । ফলত , জীবনের জন্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ অন্যত্র মাথা গুঁজছেন শিক্ষিত যুবক যুবতীগণ । লাঞ্ছনা , অপমান ও অনিয়মিত বেতন কাঠামোর আবর্তে অনেকেরই জীবন বাঁধা পড়ছে । বিষয়টি দৃষ্টান্তযোগে বললে পাঠক বুঝবেন । একটা কলেজের পাশাপাশি এক মিশন স্কুলেও পড়িয়েছি বেশ কিছু সময় । এ গল্প সেই সময়কার । গল্প বলতে সাধারণভাবে যেমন বোধ হয় আমাদের , তার থেকে এ গল্প কিছুটা স্বতন্ত্র । গল্পটি এক ঝাঁক তরুণ এবং তরুণীর ।একটা কথা প্রচলিত আছে , বেসরকারি প্রতিষ্টানে কাজ করতে গেলে চামড়াটা নাকি একটু পুরু হতে হয় । কর্তাব্যক্তিদের মেজাজ বুঝে চলতে হয় । তাঁরা শুধু বলে যাবেন , আপনি কিছু বলতে পারবেন না ।
যাঁরা দেশ ও জাতির অহংকার , যাঁদের হাত ধরে একটি দেশ হাঁটবে প্রগতির পথে , তাঁরা এইভাবে অর্ধশিক্ষিত বেনিয়াদের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন প্রতিদিন । কোন রকম সৌজন্যবোধটুকু নেই । চাকরের মত ব্যবহার করেন । অল্প কয়েকটা টাকার বিনিময়ে শিক্ষিত ভারতকে কিনে নিয়েছে এমন আস্পর্ধা তাদের । এম . এ , বি.এড ডিগ্রি অর্জন করতেই পেরিয়ে যায় জীবনের বৃহত্তর প্রহর । মা বাবা আশায় বুক বাঁধে সন্তান যোগ্য হয়েছে সেই এবার সংসারের ঘানি টানবে । হায় রে , পোড়া দেশ ! চাকরির হাঁড়িতে মাকড়সা জাল বুনেছে আজ । মাত্র ছয় সাত হাজার টাকার বিনিময়ে এত্তদিনের অর্জিত মেধা জ্ঞান বিকিয়ে বসে শিক্ষিত মানুষগুলো । তাছাড়া করবেনটাই বা কী ? শ্রমজীবী হিসাবে কিম্বা কলের কর্মী হওয়া কী তাঁর সাজে ? তাই অর্ধ শিক্ষিত অমানবিক বেনিয়াদের অপমান সহ্য করেও মাটি কামড়ে পড়ে থাকছেন তাঁরা । ঈশ্বর তাঁদের রক্ষা করুন , মঙ্গল করুন ।
৫ .
কৃষকদের চোখে জল :
ছোটবেলা থেকেই খুব কাছ থেকে কৃষকদের দুঃখ অভাব দেখতে দেখতে বড়ো হয়েছি । ভিতরে ভিতরে কেমন একটা অনুভব তৈরি হয়েছিল , কৃষক বাবার সন্তান হলেও চাষা হবো না । আমার মা'ও কখনও চাননি তাঁর সন্তানরা কৃষক হয়ে তাঁর ও বাবার মতো কষ্ট পাক । বলে রাখা দরকার , কৃষক হতে না চাইলেও ওই পেশা এবং পেশার মানুষদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা রয়েছে । কিন্তু শ্রদ্ধা সম্ভ্রম এসব দিয়ে তো পেট চলে না । আমরা দুই ভাই , কেউই কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত নয় আজ । দাদা স্বাধীন ব্যবসায় এবং আমি শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে বরন করেছি ।
বিশ্বাস করুন , কৃষক সমাজ ভালো নেই আজ । কোন রকম উদরপূর্তিটুকুই হয় । একটা মারাত্মক রোগে পড়লে হাটে মাঠে চাঁদাই ভরসা । অথচ অনেক জমির মালিক হয়ত তিনি । জমি জায়গা নিয়ে করবেন টা কী ? ভাতে দিয়ে খাবেন ? সারা বছর উদয়াস্ত পরিশ্রম করে ফসল ফলান কৃষক , কতটুকু দাম পান তাঁরা ! এই যে পেঁয়াজের দাম এখন আকাশচুম্বী , কৃষকের পেয়াঁজ যখন ওঠে ঘরে তখন কত টাকা দাম থাকে , সেটা সকলেই জানেন - দুটাকা - আড়াই টাকা । বিঘা বিঘা চাষ করেন , অথচ দাম পান না । অনেক কৃষককে দেখেছি , উপড়ান না । গরীবগুর্বারা বস্তা বস্তা নিয়ে যান । আলু সাধারণত সারা বছরই আমাদের চড়া দামে কিনে খেতে হয় , অথচ যখনই কৃষকের আলু ওঠে তখন আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায় আলুর দাম । অনেক কৃষককে মহাজন , গ্রামের দিকে যাদের বলা হয় সুদখোর । এই সুদখোরদের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে আলু চাষ করেন , কেন যে করেন ? এই বিষয়টা মাথায় আসা কঠিন , কেননা আলুর দাম কোন বছরেই আশানুরুপ থাকে না , বাবা একটি কথা বলেন প্রায় , চাষা মরে আশায় । কথাটি মিথ্যা নয় একেবারেই । আরও একটি চাষের কথা বলতে হয় , পাট চাষ । একটা সময় পাট ছিল গ্রামীণ কৃষক সমাজের প্রধানতম অর্থকরী ফসল । এককালীন একটা ভালো টাকা পেতেন কৃষকগণ । তবে সে সব এখন অতীত । কৃষক বাবার ছেলে তো , আসুন পাট চাষের লাভের হিসাব দিই , এক বিঘা পাট কাটতে শ্রমিকরা নেয় ছয় হাজার টাকা , পাট ধুতে দুই হাজার টাকার মত খরচ হয় । এই এক বিঘা জমির পাট বিক্রি করলে যদি খুব ভালো পাট হয় , তাহলে দশ হাজার টাকার মত কৃষক হাতে পেতে পারেন । পাট খারাপ হলে অনেকেই পাট কাটেন না । তিনি জানেন লাভ তো হবে না বরং গাঁটের কড়ি যাবে কতগুলো । ধান চাষের গল্পটাও একই । নিজে কাটা , সিদ্ধ করে ভাঙাতে পারলে অল্প কিছু লভ্যাংশ থাকে । এই কম লভ্যাংশের জন্য সরিষা , মূসূর , ধনিয়া , তিল প্রভৃতি একাধিক কৃষিজ দ্রব্যের চাষ প্রায় আর দেখায় যায় না ।
আমাদের দেশে কৃষকরা কোন কালেই ভালো ছিলেন না । আত্মহনন , অভাব , অশান্তি কৃষক নামটির পাশেই লেপ্টে ছিল চিরকাল । কৃষিজ ফসলের দাম কোন কালেই আশানুরুপ ছিল না । কৃষিজ ফসলের দাম না থাকলেও ক্রেতাকে উচ্চহারেই কিনতে হয় । মাঝখানের মধ্যস্বত্বভোগীগণই খান লাভের সবটুকু গুড় । উৎপাদিত ফসলের দাম না থাকায় , কৃষক পরিবারের অর্থভান্ডার সব সময় অর্ধপূর্ণ হয়েই থাকে । অথচ অন্যান্য দ্রব্যদির দাম আকাশছোঁয়া , মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে । ফলে কৃষক পরিবারে হেঁচকীটান লেগে থাকে সারা বছর । নব প্রজন্মের কৃষিজ জমিমুখী না হওয়ার এটাই সবচেয়ে বড় কারণ । তাঁরা সরাসরিই বলছেন , হবে টা কী চাষ করে ? সারা বছর তো হাঁড়িতে বিরাজ করবেন মা ভবানী । মিথ্যা নয় , তাঁদের এই আক্ষেপ । দূর থেকে তাঁদের এই আক্ষেপ অনুধাবন করাও বোধহয় কঠিন । যাঁরা কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত , কৃষক পরিবারের সঙ্গে যুক্ত তাঁরাই একমাত্র বুঝবেন কৃষকদের যন্ত্রণা । আসলে সব কিছু এই দামের বাজারে , কৃষকের ফসলই একমাত্র কমদামি । নব প্রজন্ম তাই কৃষিকাজে আগ্রহ হারালে তাঁদের দোষ দেওয়া খুব একটা যুক্তিযুক্ত ব্যাপার নয় । অবস্থার উন্নতি না হলে আগামী দিন কৃষিসংকটের মুখে পড়তে হবে , একথা বলতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই ।
এভাবেই জীবনের প্রায় প্রতিপর্বেই এক্কেবারে যাচ্ছেতাই বাজে রকম ফেঁসে গেছে আধুনিক গণমানবগণ । জীবনের কোন গল্পই এখন আর সহজ ঋজু নয় । কঠিন এক বাস্তবভূমিতে আবাস পৃথিবী পুরুষের । এক মায়াজালে জড়িয়ে জীবনের ময়নাতদন্ত হয় প্রতিমূহূর্ত । হয়তো , একদিন সূর্য উঠবে , এখনকার মত এমন গ্রহণলাগা সূর্য নয় । একেবারেই জীবন্ত সূর্য । যার উত্তাপে ধরাভূমির সব অসুখ ঝরে পড়বে । মরা পৃথিবীর সাথে সাথে জীবন্ত হবে আমার স্বদেশও । সেই আশাতেই বাঁচতে হবে আমাদের ।
লেখক
৭৯০৮১১৮৬০০
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন