অর্থ না বুঝেই আরবী নাম রাখেন অধিকাংশই বাঙালি মুসলমান । এ বিষয়ে লিখেছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
আরবি যেহেতু বাংলাভূমির নিজস্ব ভাষা নয় , একটি বিজাতীয় ভাষা , উক্তহেতুগত কারণে আরবি ভাষার চর্চামূলত কোরানশরীফ পাঠের মধ্যেই অনেকক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ আছে । কোরান পাঠের যে ব্যাপারটা , সেটি হল অধিকাংশ মুসলিমই অর্থ না বুঝেই কোরান পাঠ করেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম । ফলে কোরানের অর্থ , আরবি শব্দসমূহের অর্থ না জানবার কারণে অনেকেরই নামকরণ হাস্যকর অর্থযুক্ত হয়ে পড়ে । বিষয়টির ঋজুপূর্ণ ব্যাখ্যা দরকার , ধরুন কারও নাম জামাল মিয়া কিম্বা জামালউদ্দিন ।
এখন আরবি জাত ' জামাল ' শব্দের অর্থ উটগুলো , ' মিয়া ' শব্দের অর্থ একশ । তাহলে জামাল মিয়ার অর্থ একশত উট , অর্থাৎ তিনি নিজেই এক স্বয়ংসম্পূর্ণ উটশালা ।
বাঙালি মুসলমানরা নামের পূর্বে নবী মুহম্মদের নামের সংযুক্তিকরণে স্বস্তি বোধ করে । অধিকাংশ মুসলমান গণমানবের নামের পূর্বে এম .ডি বসানো একপ্রকার ঐতিহ্য হয়ে পড়েছে । বিষয়টি বঙ্গদেশীয় মুসলমান সমাজে বেশি দেখা যায় , অথচ আরব সহ মুসলিম বিশ্বের অন্যত্র নামের পূর্বে এম .ডি বসানোর রীতি দেখা যায় না । নবী মহম্মদের আত্মীয় পরিজন , সহচর কিম্বা সেই সময়কার কোন মুসলমান সাধকের নামের পূর্বে মহম্মদ নাম সংযুক্তিকরণ লক্ষ্য করা যায় না । মহম্মদ শব্দের অর্থ প্রশংসিত বা চরম প্রশংসিত ।
প্রথমপর্বের বাঙালি মুসলমানদের অধিকাংশই ধর্মান্তরিত । হিন্দুধর্মের নামের পূর্বে ' শ্রী ' শব্দবন্ধের উপস্থিতি লক্ষ্যগোচর হয় । সদৃশভাবে মুসলমানরা হিন্দুদের থেকে পৃথক , এই উপস্থিতির জানান দিতেই নামের পূর্বে মহম্মদ নামের প্রতিস্থাপন করবার ঐতিহ্য চালু করেন বলে অনেক বিশেষজ্ঞ অভিমত জ্ঞাপন করেছেন । নামের পূর্বে ' মহম্মদ' এই শব্দবন্ধটির ব্যবহার সাধারণত মুসলমান জনসমাজ করেন না , তাঁরা সংক্ষেপ হিসাবে লেখেন এম . ডি । এম . ডি চিকিৎসা শাস্ত্রের একটি পরিভাষাও বটে , ফলে মুসলিম সংস্কৃতি বিষয়ে জ্ঞাত নন এমন কোন ব্যক্তি নামের আগে এম . ডি দেখে সেই ব্যক্তিপুরুষকে ডাক্তার হিসাবে চিহ্নিত করতে পারেন ।
আরবি ' আব ' শব্দের অর্থ পিতা । সেই সূত্রে নবী মহম্মদ স.কে বলা হত আবুল কাশেম , অর্থাৎ কাশেমের পিতা । বাঙালি মুসলমানদের নামের ক্ষেত্রে এমন অনেক নামই কিন্তু দেখতে পাওয়া যায় , যেমন আবুল ফজল , আবুল কাশেম , আবুল খায়ের , আবু মুনসুর প্রভৃতি । এঁরা কেউই পিতাপুত্র নয় , একক ব্যক্তি । পরিষ্কার করে বললে , আবুল খায়ের একজনই ব্যক্তি , অথচ এই নামের আরবি অর্থ দাঁড়ায় খায়েরের পিতা । এইরকম অজস্র নিদর্শন রয়েছে , যে নাম সমূহের অর্থগত দিক দেখলে একটা বিভ্রাট লক্ষ্য করা যাবে । আরও উদাহরণ , যেমন নবীউল্লাহ আপাদ একটা নিরীহ নাম , অথচ এর যে অর্থ দাঁড়ায় , সেটা কারও নাম হওয়ার উপযুক্ত নয় , বরং অর্থ জানলে মুসলমানরা ওই নামটি রাখবেনই না । নবীউল্লাহ শব্দের অর্থ আল্লাহর নবী । অর্থাৎ কোন ব্যক্তি যদি নবীউল্লাহ নামে অন্য কোন ব্যক্তিকে সম্বোধন করেন , তাহলে তিনি সাক্ষ্যই দিচ্ছেন ওই ব্যক্তি আল্লাহর নবী । বিষয়টি ইসলাম ধর্ম রীতি বিরুদ্ধ । কেননা , ধর্মপ্রাণ মুসলমান মাত্রই বিশ্বাস করেন , নবী মহম্মদ স. ইসলাম ধর্মের শেষ নবী , তাঁর পরে আর কোন নবী আসবেন না । কেউ যদি বিশ্বাস করেন যে , আরও নবী আসবেন তাহলে তিনি ইসলাম বিরুদ্ধ কাজ করার অপরাধে কাফের বলে পরিগণিত হবেন । অথচ অর্থ না জেনেই অনেকেই এমন নাম রাখেন ।
আসলে আরবি ভাষা যেহেতু বিজাতীয় ভাষা সেইহেতু সব শব্দের অর্থ জানা বাঙালি মুসলমানদের পক্ষে সম্ভব হয় না । অনেকেই প্রবাহমান কাল থেকে চলে আসা নামগুলোর থেকে সন্তানের জন্য বেছে নেন পছন্দসয় নাম , পরবর্তীতে দেখা যায় হয় নামের অর্থই অর্থহীন , নতুবা অদ্ভূত অভিধান সমন্বিত । বাঙালি পুরুষরা যেমন নামের আগে এম .ডি বসান , তেমনি মুসলমান মহিলারা নামের আগে বসান মোসাম্মৎ , এই মোসাম্মৎ শব্দটি অর্থহীন । আবার মহম্মদ স. এর প্রিয় একটি নাম আহমদ , এই ' আহমদ ' নামটিও অনেক বাঙালি মুসলমানের নামের অংশ , সাধারণত নামের মধ্য অংশ । তবে এই নামটির ক্ষেত্রে বানানগত এবং উচ্চারণগত সমন্বয় রক্ষা করা হয় না । সাধারণ , ' আহমদ ' নামটির উচ্চারণ ও লেখ্যরুপ মুসলমান নামে এইভাবে থাকে , যেমন - আহমেদ , আহাম্মাদ , আহাম্মেদ এইরুপে । ফলে অর্থগত একটা প্রভেদ লক্ষ্যগোচর হয় ।
বাঙালি মুসলমানদের নামের এই অর্থগত বিসদৃশের আরও অজস্র নিদর্শন রয়েছে । আরও কয়েকটি উদাহরণ , যেমন ' লায়েবা ' একটি মুসলমান নারীর নাম । আরবিতে ' লায়েবা ' শব্দের অর্থ হল , খেলার সামগ্রী । মানুষ কখনও খেলার সামগ্রী হতে পারে না , ফলে লায়েবা নামটির অর্থগত সমন্বয় রক্ষিত হল না । আবার , অনেক বাঙালি মুসলমান মেয়ের নাম হয় তাহরীন । এই ' তাহরীন ' শব্দের আরবি অর্থ হল , হারাম কাজ করা । ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা হারাম কাজ থেকে দূরে থাকতে চান । অথচ না জেনেই তাঁরা নাম রাখছেন তাহরীন , যার অর্থ হারাম কাজ করা । আরও একটি দৃষ্টান্ত দেখা যাক , অনেক মুসলমান পুরুষের নাম মুহম্মদ ওবাইদ । এই নামটির অর্থ জানলে বাঙালি মুসলিমরা নামটি উচ্চারণই করবে না । ' তওবা ' ' নাউজবিল্লাহ ' পাঠ করে পাপমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করবেন । পাঠক ভাবছেন , ' মুহম্মদ ওবাইদ ' শব্দের অর্থ কি ? আসলে ' মুহম্মদ ওবাইদ ' শব্দের আরবি অর্থ মহম্মদ অতি ক্ষুদ্র গোলাম । এই অংশটি কোন বাঙালি পাঠক পাঠ করলে এতক্ষণ তিনি ' তওবা ' (পাপমুক্তির দুয়া )পড়তে শুরু করেছেন । প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধারাবহিকভাবে এপার এবং ওপার বাংলার বাঙালি মুসলমানগণ অর্থ না বুঝেই আরবি নাম রাখেন , যা অনেক সময় হিতের বিপরীত হাস্যস্পদ অর্থবিভ্রাট সৃষ্টি করে ।
লেখক
৭৯০৮১১৮৬০০
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন