ব্যতিক্রমী শিল্পমানস শ্রী শম্ভু মিত্র । আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।


শ্রী শম্ভু মিত্র 
বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব নট এবং নাট্যকার শম্ভু মিত্র । গণনাট্য সংঘের প্রাণ পুরুষ শম্ভু মিত্র নাট্য ধারায় এক অনন্য ধারার সংযোজন করতে সচেষ্ট ছিলেন । ' ভালো করে , ভালো নাটক করবো ' এই ভাবনা দ্বারা শুধু প্রভাবিত তিনি হননি , সারা জীবন এই বোধ দ্বারাই তিনি স্বজীবনকে পরিচালিত করেন । কোনরুপ রাজনীতিক ছত্রছায়া ব্যতিরেকেই , কোন ধনীপুরুষের সহয়তা কিম্বা কোন সংঘটনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকেই তিনি ' বহুরুপী ' নাট্যদল গঠন করেন । বহুরুপীর প্রতিষ্ঠা বাংলা নাট্যের ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা । রবীন্দ্রনাথের ' রক্তকরবী ', ' চার অধ্যায়'   ' , রাজা , ' , তুলসী লাহিড়ির ' পথিক ' , ছেঁড়াতার ' , ইবসেনের ' এ্যান এনিমি অফ দ্য পিপল ' এর রুপান্তর ' দশচক্র ' ,'  আ ডলস হাউজ ' এর অনুবাদ ' পুতুল খেলা ' , নাটকের প্রযোজনা ও অভিনয় নিঃসন্দেহে এক উল্লেখযোগ্য বিষয় । শ্রী মিত্র শুধুমাত্র ভালো নাটক অভিনয়ই করেননি , সুস্থনাট্য ধারার নিমিত্তে দর্শকও প্রস্তত করতে সক্ষম হয়েছিলেন ।

চল্লিশের দশকে গণনাট্যসংঘের উদ্দোগে ১৯৪৪ এ প্রখ্যাত নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য বিরচিত ' নবান্ন ' নাটকের প্রযোজনার মধ্য দিয়েই বাংলা নাট্যকাশে নট শম্ভু মিত্রের আবির্ভাব । পরবর্তীতে গণনাট্য সংঘের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর শ্রীমিত্র মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের সহায়তাই ' বহুরুপী ' নাট্যদলের উপস্থাপনা করেন । ভালো নাটক প্রযোজনা করতে গিয়ে অর্থনুকুল হননি শ্রী মিত্রের প্রযোজনা সংস্থা । কখনও কখনও রুজি রুটির নিমিত্তে মন বিরোধী কিছু কাজ তিনি করতে বাধ্য হয়েছেন , কখনও বা অভুক্ত থেকেছেন তবুও প্রবাহমান দর্শক প্রিয় সাংস্কৃতিক ভাবে নিন্মমানের নাটকের কাজ ফিরিয়ে দিয়েছেন । 

 ১৯৫৪ সালে  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ' রক্তকরবী ' নাটকের প্রযোজনা করেন শ্রীমিত্র । তাঁর এই সিদ্ধান্ত বাংলা নাট্যধারায় সুস্থ নাট্য সংস্কৃতির বিবর্তনে সবিশেষ ভূমিকা পালন করে । ১৯৬৪ সালে ' বহুরুপী '  শম্ভুমিত্র অনূদিত নির্দেশিত এবং অভিনীত সোফোক্লেসের ' রাজা অয়দিপাউস ' নাট্যপ্রেমী দর্শককুল ভীষণরকম চমকিত করে । রবীন্দ্রনাটক ' রাজা 'র নাট্যরুপ এবং অভিনয় শ্রীমিত্রের এক মহৎ কাজ । এছাড়াও শ্রীমিত্র বাদল সরকার , নীতিশ সেন এবং শ্রীবিজয় টেন্ডুলকারের নাটক ' বহুরুপী ' রঙ্গমঞ্চ প্রণয়ন করে নাট্যমোদী দর্শককুল সবিশেষ আনন্দ প্রদান করেন । ১৯৭৮ সালে এক দুর্ভাগ্য বিষয়ের সৃস্টি হয় । ' বহুরুপী ' নাট্যগোষ্টির সঙ্গে মতবিরোধে জড়িয়ে পড়েন শম্ভু মিত্র । এই পর্বে '  বহুরুপী ' শ্রীমিত্রকে অস্বীকার করে । 

নান্দিকার , চেনামুখ এবং পরবর্তীতে পঞ্চম বৈদিকের মত নামজাদা নাট্যসংস্থার প্রযোজনায় অবদান রাখেন শম্ভু মিত্র । সাল ১৯৮০ - ৮১ নাগাদ ছয়টি নাট্যদলের উদ্দোগে তৎকালিন ক্যালকাটা রেপাটারি থিয়েটার প্রযোজিত নাট্যকার ব্র্খ্টের নাটক ' গ্যালিলেও - র জীবন ' নাটকে গ্যালিলিওর ভূমিকায় অভিনয় করেন নাট্যভিনেতা শ্রীমিত্র , তাঁর অভিনয় দেখে অভিভূত হন দর্শককুল । 
অন্যধারার নাট্যভিনয়ের জন্য নিজস্ব একটি নাট্যমঞ্চ গঠনের স্বপ্ন চিরজীবন শম্ভুমিত্রকে তাড়িত করেছে । দুর্ভাগ্য , তাঁর এই স্বপ্ন পূর্ণ হয়নি বিবিধ কারণের জন্য । 

শম্ভু মিত্র বিরচিত প্রবন্ধ গ্রন্থগুলির মধ্যে , ' নাটক রক্তকরবী ' , ' কাকে বলে নাট্যকলা ' , ' নাট্যভাষ' , ইত্যাদি । শ্রীমিত্র প্রণিত পাঁচটি গল্প ও দুটি নাটক ' পাঁচ দুই ' নামে প্রকাশিত । সব মিলিয়ে তাঁর লিখিত নাটকের সংখ্যা দশটি । 
শ্রীমিত্র অভিনীত কয়েকটি প্রখ্যাত নাট্যপালার মধ্যে উল্লেখ্য কয়েকটি হল ,'  রক্তকরবী ' , ' ডাকঘর ' , ' চার অধ্যায় ' ,'  তাঁহার নামটি রঞ্জনা ' , ' রাজা অয়দিপাউস ' প্রভৃতি । 

[শম্ভু মিত্র : ২২ আগষ্ট , ১৯১৫ , কলকাতা - ১৯ শে মে , ১৯৯৭ ,কলকাতা ]

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।