রাজ্য প্রশাসনের সবরকম চাকরির ক্ষেত্রে বাঙালির অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করা দরকার। এ বিষয়ে গভীরতর আলোকপাত করেছেন প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।
কিছুটা দায় বোধহয় আমাদেরও । আমরা বাংলা ভাষাকে হয়তো ততটা হৃদয়ের সামগ্রী করে তুলতে পারিনি । আমরা আমাদের সন্তানদের বাংলা ভাষায় শিক্ষা দিতে ততটা উৎসাহী হয়ে উঠি না, যতটা হিন্দি কিংবা ইংরেজি ক্ষেত্রে দেখায় । গ্রাম বাংলা ব্যতীত বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় সমূহের বাচ্চা পড়ানোর প্রবণতা ক্রমশ কমে আসছে । শহর এবং মফস্বল শহরে গজিয়ে ওঠা ইংলিশ মিডিয়াম বিদ্যালয়গুলিতে উপচে পড়ছে ভিড় । প্রথম ভাষা হিসেবে সেখানে বাচ্চারা শিখছে ইংরেজি , দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি । এমন অনেক শিশু রয়েছে, যারা বাংলায় কথা বলতে পারলেও , বাংলা ভাষা পড়তে পারে না । লিখতেও পারেনা । বাংলা ভাষার প্রতি তাই বলে ওই সকল অভিভাবকগণ প্রীত নন , এমনটি ভাববার দরকার নেই । বছরের একটা দিন অন্তত সেই সমস্ত অভিভাবকগণ বাংলা ভাষার গুণকীর্তন করেন । বাঙালি হিসাবে গর্ববোধ করেন । দিনটি বাঙালির গর্বের দিন , ভাষা দিবস । যে মানুষটি তাঁর সন্তানকে বাংলা ভাষায় শিক্ষাদান করতে দ্বিধা বোধ করেন , পিছিয়ে যাবেন জ্ঞান করেন , একুশে ফেব্রুয়ারির দিন , তিনিই ফেসবুকের দেয়ালে টানিয়ে দেন ' আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমরা কি তা ভুলিতে পারি । ' বাংলা ভাষার জন্য এর থেকে বড় অবমাননার বিষয় আর কিবা হতে পারে ।
বাংলা ভাষাকে আমরা সেই অর্থে ধারণ করতে পারিনি , এজন্য প্রশাসনিক দায়ও কিছুটা রয়েছে । প্রশাসনিক ক্ষেত্রে মাতৃভাষাকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি , চাকরির যে সমস্ত পরীক্ষা সর্বভারতীয় ভাবে আয়োজিত হয় , সেখানে মূলত ইংরেজি এবং হিন্দি কেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। ইংরেজি এবং হিন্দি জানা শিক্ষার্থীর তুলনায় বাংলা মাধ্যমে পড়া শিক্ষার্থী , শুরুতেই অনেকটাই পিছিয়ে পড়েন । যদিবা , পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলো , ইন্টারভিউ এর সময় তাঁকে হিন্দি কিংবা ইংরেজি মাধ্যম হিসাবে , যে কোন একটিকে বেছে নিতে হয় । যেহেতু ইংরেজি এবং হিন্দিতে ততটা দক্ষ অভিজ্ঞান বাংলা মাধ্যমে পড়া শিক্ষার্থীর হয়ে ওঠে না , সেইহেতুগত কারণে তাঁর ভাইভা , আশানুরূপ না হওয়ায় সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায় । আমরা অভিভাবক যাঁরা , তাদের প্রধানতম চিন্তা থাকে , তাঁর ' সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে' । একটি শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাবা মায়েরা তাদেরকে নামিয়ে দেন এক বিরাট ইঁদুর দৌড়ে । শুধুমাত্র বাচ্চাদের নাম লিখিয়েই তাঁরা বিরত থাকেন না । নিজেরাও সামিল হয়ে পড়েন সেই ইঁদুর দৌড়ের মহামিছিলে । যেহেতু সর্বভারতীয় পরীক্ষার ক্ষেত্রে হিন্দি এবং ইংরেজি জানাদের অগ্রাধিকার দেওয়ার লিখিত অলিখিত বিধান রয়েছে আমাদের দেশে । উক্তকারণে বাবা মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে নিয়ে হাজির হচ্ছেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুল সমূহের চত্বরে । স্বাভাবিক কারণেই বাঙালির ছেলে বেড়ে উঠছে সাহেব হয়ে । সে রবীন্দ্রনাথ পড়েনা , শরৎচন্দ্র নজরুলের নামও খুব একটা জানাশোনা থাকছে না তাদের । কোথাও যেন আমাদের মাতৃভাষা অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়াচ্ছে ।
এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া আশু প্রয়োজন । বাঙালির ছেলে বাংলা না শিখলে বিষয়টি যে ভয়ঙ্কর , বিষয়টি বুঝবার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার খুব একটা প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না ।বিহার , উত্তর প্রদেশ সহ অন্যান্য হিন্দি ভাষী প্রদেশ থেকে চাকরিপ্রার্থীরা সর্বভারতীয় এবং আমাদের রাজ্য স্তরীয় পরীক্ষাগুলোতে অংশগ্রহণ করে এবং রাজ্যের বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তর এসে বসছেন। খেটে খাওয়া অসহায় হতদরিদ্র মানুষগুলো ঐসকল আধিকারিকদের কাছে মনের ভাব প্রকাশ না করতে পারার জন্য অপদস্থ হচ্ছেন । অবাঙালী আধিকারিকদের মুখভঙ্গি দেখলে মনে হয় বাংলা ভাষায় কথা বলাটাই যেন কিছুটা হলেও অপরাধের ! কেন হিন্দিতে কথা বলতে পারি না আমরা বাঙালিরা , সেই নিয়েও তাঁরা হাসি-ঠাট্টা করেন । হিন্দিতে কথা বলা অপরাধ নয় কিন্তু বাংলায় বসবাস করে , বাংলা ছেড়ে হিন্দিতে কথা বলা কিছুটা হলেও মাতৃভাষার অবমাননা বলেই মনে হয় । যিনি অবাঙালি হিন্দিভাষী , তিনি যেহেতু বাংলাতে চাকরি করছেন , চাকরিসূত্রে এসেছেন, তাঁকে অবশ্যই বাংলা ভাষাটি শিখে নেওয়া উচিত । সে ক্ষেত্রে সময় লাগতে পারে , অস্থির অধৈর্য হয়ে বাংলা ভাষী গণমানবের সঙ্গে দুর্ব্যবহার কিংবা অপদস্ত করলে সেটা ক্ষমার অযোগ্য হিসাবেই দেখা উচিত। আমরা যাঁরা বাংলা ভাষায় কথা বলি, নিজেদেরকে গর্বিত বাঙালি বলে আখ্যায়িত করি, তাঁরা বাংলাতে কথা বলব । যিনি অন্যকোন রাজ্য প্রদেশ থেকে চাকরি করতে এসেছেন আমাদের রাজ্যে , তিনি বাংলা বাংলা শিখে নেবেন। আমাদের মনের ভাব বুঝবেন , সহৃদয়তার সঙ্গে বাংলাভাষী মানুষদের সঙ্গে আচরণ করবেন ।
মাতৃভাষার সংকট মোচনে রাজ্য প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের উদ্যোগী হওয়া দরকার । বিশেষ করে রাজ্য প্রশাসনের হাতে থাকা নিয়োগ প্রণালীতে বাংলা ভাষা এবং বাঙালিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে । রাজ্যের যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের বাংলাতেই কর্মের ব্যবস্থা করে দিতে উদ্দোগ নেওয়া আশু প্রয়োজন । সেই জন্য বাংলার চাকরিতে বাঙালিকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার ।বাইরে থেকে আসা অবাঙালি , যেহেতু বাংলা ভাষার' অ-আ-ক-খ ' সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ওয়াকিবহাল নয় । সেই কারণগত অভিজ্ঞানের কারণেই হয়তো , বাংলা ভাষায় কথা বলাকে অনেকটাই হেয় প্রতিপন্ন করে থাকেন। তাঁদের উপদ্রব থেকে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি কে বাঁচানোর কিছুটা দায়িত্ব অবশ্যই প্রশাসনিক কর্তাদের নিতে হবে।
দায়িত্ব আমাদেরও কম নয় । আমরা সন্তানদেরকে মা ভাষা বাংলা ভাষায় , কথা বলতে , লিখতে উৎসাহিত - উদ্বুদ্ধ করব । আমরা গর্বিত , আমরা বাঙালি , এই মর্মচেতনা তাঁদের হৃদয়ের অলিগলিতে উপস্থাপন করতে হবে । যাতে ভবিষ্যতে তাঁরা বাংলা ভাষার চর্চাকে আরও সুদূরপ্রসারী ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয় । বাংলা ভাষাকে বাঁচানোর এছাড়া আলাদা কোনো পথ ও পন্থা আছে বলে মনে হয় না । শুধুমাত্র একটি দিন , বাংলা ভাষার প্রতি হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা উজাড় করে দেওয়ার নামই মাতৃভাষা প্রীতি নয় , বছরের প্রতিটি দিন বাংলা ভাষাচর্চা, বাংলা ভাষায় কথা বলা , বাংলা ভাষার বই পড়ার যে কর্ম , তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যদিয়েই বাংলা ভাষাকে রক্ষা করবার গুরুদায়িত্ব আমাদেরকে তুলে নিতে হবে। এমনটি করা না গেলে , আগামী দিন অবশ্যই শিরঃপীড়ার কারন হবে । বাঙালির ছেলে সাহেব হয়ে মানুষ হবে, বাংলা জানা সত্যকার শুদ্ধ বাঙালি , তাঁরা পিছিয়ে পড়বে । চাকরির ক্ষেত্রে প্রশাসনিক দপ্তর থেকে বাংলার অলি-গলির সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে অবাঙালিরা ছড়ি ঘোরাবে। বাংলা ভাষাকে হেয় প্রতিপন্ন করবে । অবাঙালিরা প্রবল ভাবে বাংলায় প্রবেশ করে শিখর ছাড়বে , বাঙালি গণ মানব সংখ্যায় বেশি হলেও, যেহেতু কর্মদক্ষতায় পিছিয়ে পড়বে , তাঁরা বাংলাভাষায় কথা বলতে লজ্জাবোধ করবে , এমনটি স্বপ্নেও সত্যি হওয়া কাম্য নয় । ঘুরে দাঁড়ানোর সময় এখন , গর্বিতভাবে বলুন,
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন