মহুয়ার দেশ কবিতার কবি সমর সেন শহরের কবি , কলকাতার কবি , আমাদের আজকালকার জীবনের সমস্ত বিচার বিক্ষোভ ও ক্লান্তির কবি । আলোচনা করছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
আধুনিক নগর জীবনের রুপকার সমর সেন । |
আধুনিক বাংলা কাব্যকলার এক বিশিষ্ট কাব্যকার হলেন সমর সেন । নাগরিক জীবনের অনন্য রুপকার তিনি । জীবনের গল্প সমূহ নাগরিক জীবনে কিভাবে মুখরিত হয় , সেই সকল কথায় স্বকাব্য শরীরে তিনি ধারণ তিনি । প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর আবর্তন , মানুষের গণজীবনের অসুবিধার গলি পথ , বেঁচে থাকবার আপ্রাণ চেষ্টা , যৌবনের উৎফুল্লতা এবং ব্যর্থতার গল্প লিপিবদ্ধ করতেই বাংলা কাব্যকলায় তাঁর আবির্ভাব । ড . দেবেশকুমার আচার্য , তাঁর ' বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ' ( আধুনিক যুগ ) সমর সেন অধ্যায়ে , তাঁর সরস্বত কাব্য প্রতিভূ সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে লিখেছেন , ' প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে তীব্র সংবেদনশীল ও অভিমানী যৌবনের বেদনা নিয়ে বাংলা কাব্যের আসরে আবির্ভূত হয়েছিলেন সমর সেন । যৌবনের স্পর্শকাতরতা , বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ যেন তাঁর কবিতায় ক্লান্তির ম্লান ছায়ায় আচ্ছন্ন । ' আবার কবি বুদ্ধদেব বসু , সমর সেন সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে লিখেছেন , ' নাগরিক জীবনের খণ্ড খণ্ড ছবি বা উল্লেখ কোন কোন আধুনিক কবিতে থাকলেও সমগ্রভাবে আধুনিক নগরজীবন সমর সেনের কবিতাতেই প্রথম ধরা পড়লো । সমর সেন শহরের কবি , কলকাতার কবি , আমাদের আজকালকার জীবনের সমস্ত বিচার বিক্ষোভ ও ক্লান্তির কবি । '
সমর সেন শহুরে কবি । নগর জীবনের কথকতায় পরিপূর্ণ তাঁর কাব্য সম্ভার । ধনতান্ত্রিক যান্ত্রিক সভ্যতার গল্পে সমৃদ্ধ নগর জীবন , ' ঘরে বাইরে ' কবিতায় , তিনি লিখলেন , ' কোন নগরে একদিন যেন ছিল
চারিদিকে মেখলার মতো শালবনের অন্ধকার
পাহাড়ের মতো মেঘবর্ণ প্রসাদ , স্বয়ংবরা প্রেম । ' এমন শহুরে ছবি কাম্য হলেও , নগর জীবনের কুন্ডলি করে ধূলিকণা এবং কলকারখানার ধোঁয়া জীবন হয়ে ওঠে বিষাক্ত । এ ছবি বড্ড মন কেমন করা , অবক্ষয়হীন দুর্দশা , জীবনকে করে তোলে মৃত্যুমুখী ।' ঝড় ' কবিতায় কবি লিখছেন ,
' আকাশে ধোঁয়ার ক্লেশ , চারিদিকে ধোঁয়ার গন্ধ
আর হাওয়ায় অসংখ্য ধুলোর কণা
জীবন্ত বীজাণুর মতো । '
আবার ' শবযাত্রা ' কবিতায় শহরের ধনতন্ত্র লোভী কীটদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন তিনি , অন্য আরও অনেকের মত তিনি বিশ্বাস করেন , শহুরে জীবনকে বিষাক্ত করতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা নেয় পুঁজিবাদী সম্প্রদায়ের লোকজন ।
' আসন্ন প্রসবা অন্ধকারে
ক্ষুরধার নখে মাটিতে অঙ্ক কষে
কারা টাকা গোনে , আর কালো তাস ভাঁজে ,
সমলোভী ঠোঁটে আঁকা
কর্কশ শব্দহীন উৎকণ্ঠা । '
কবি আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো নন , দুঃস্বপ্নময় পৃথিবীর কুৎসিত শরীর দেখে তিনি রুষ্ট হন , ফেটে পড়েন কবিতায় । সমর লিখছেন , ' দিন হতে দিনে , মৃত্যু হতে আর এক মৃত্যুতে এ কী যাত্রা / প্রবল মোড়কে , শেষহীন নরকে তার শেষ যাত্রা । '( নববর্ষের প্রস্তাব )
শহুরে কথকতার গভীর ব্যঞ্জনা , দুঃসহ উৎপীড়ন পূর্ণ জীবনের গল্প তাঁর কবিতা জুড়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো লেপ্টে থাকলেও , প্রথম জীবনে সমর প্রেমের কবিতা লিখেছেন । তবে , সে প্রেম কবির কাছে কোন স্থায়ী রুপ পায়নি , তাঁর মনে হয়েছে প্রেম হল , এক ইন্দ্রিয়দাহী সুতীব্র কামনা মাত্র । প্রেম কবিতায় সমর লিখছেন ,
' বিষাক্ত সাপের মতো আমার রক্তে
তোমাকে পাওয়ার বাসনা । '
এখানে প্রধান্য পেয়েছে , তা কবিতা উচ্চারণেই বোধগম্য হয় । প্রেম সম্পর্কে সমরের ধারণা একটু ভিন্নগোত্রীয় বলে মনে হয় । ধনতান্ত্রিক সভ্যতায় সবই ক্রয় বিক্রয় যোগ্য , প্রেমও এই অবক্ষয় সময়ে পণ্য হিসাবেই প্রকটিত বলে কবির ধারণা জন্মেছে । মেঘদূত কবিতায় সমর লেখেন , অন্যরকম প্রেমের গল্প ।
' হে ম্লান মেয়ে , প্রেমে কি আনন্দ পাও
কী আনন্দ পাও সন্তান ধারণে ? '
সাম্যবাদী ভাবনায় পরিপূর্ণ সমর সেনের হৃদয় নির্মাণ । তিনি ধনতান্ত্রিক সভ্যতার পতন দেখতে চান । একটা সাম্যময় পৃথিবীর স্বপ্নে বিভোর হন তিনি । এই ধনতান্ত্রিক সভ্যতার পতনের জন্য বিপ্লব দরকার । বিপ্লবীদের প্রতি শ্রদ্ধায় নত সমরের অন্তরাত্মা , ' লোকের হাট ' কবিতায় তার প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায় । সমর লিখলেন , ' ওরা যেখানে প্রাণ নেয় , সেখানে প্রাণের সাক্ষর /যেখানে ওরা প্রাণ দেয় , সেখানে জীবন অমর / ওদের বাহুবলে পাশব শত্রুরা পলাতক , ছত্রভঙ্গ , / যুদ্ধের দলিত রক্তাক্ত প্রান্তরে লোহিত পদ্মের গান । '
সমরের কবিতায় নব কাব্যময় আভা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মনিমুক্তার মত । ধ্বংসমুখী মানব জীবনের গল্প তিনি নিজ চোখে দেখেছেন , সমাজ সচেতন তিনি , তাই এড়িয়ে যাননি । শাসন মুক্ত গদ্য ছন্দে অপরুপ আলেখ্য রুপে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেছেন । যা যথার্থই আধুনিক মনন ও চিন্তনের বহি:প্রকাশ ।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন