বুদ্ধদেব বসু মূলত প্রেমের কবি : পূর্ণ জীবনে তিনি প্রেমের কবিতায় লিখে গেছেন । আলোচক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
বুদ্ধদেব বসুর কিশোর বয়সের লেখা পড়ে মনীষী রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন , ' কেবল কবিত্ব শক্তি নয় , এর মধ্যে কবিতার প্রতিভা রয়েছে , একদিন প্রকাশ পাবে । ' বাংলা সাহিত্যের সর্বকালীন অভিভাবক বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহেই ভবিষ্যদ্রষ্টা ছিলেন , অন্য অনেক ভবিষ্যদ্বাণীর মতো বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কীত তাঁর এ বাণীও সত্যি হয়েছিল । পরবর্তীকালে আমরা বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব ক্ষেত্রেই বুদ্ধদেব বসুকে সাবলীল ভাবে সক্রিয় ভূমিকায় দেখেছি । বিশেষ করে রবীন্দ্রউত্তর বাংলা কবিতার ভূবনে জীবনানন্দ , সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের মতোই তিনি সমৃদ্ধ করেছেন স্বকাব্য সংযোজনের মধ্য দিয়ে । ড . দেবেশ কুমার আচার্য তাঁর ' বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস' , আধুনিক পর্বে , বুদ্ধদেব অধ্যায়ে তাঁর কবি প্রতিভা সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে সুন্দর মন্তব্য করেছেন , ' তাঁর কবিতা একাধারে বিদ্রোহের , ক্লান্তির , সন্ধানের , বিষ্ময়ের , জাগরণের এবং বিশ্ববিধানে চিত্তবৃত্তির । মহাযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর বাস্তব অভিক্ষেপ তাঁর কাব্যে সরাসরি এসে না পড়লেও আধুনিক য়ুরোপীয় ও বাংলা কাব্যকলার প্রভাবপথে অনুপ্রবেশ করেছে প্রতিশ্রুত হয়ে । এবং বুদ্ধদেবের কবি মানসে প্রতিসরণের সেই ত্রীকোণ স্ফটিক খন্ডটির কাজ করেছে তাঁর প্রেমবোধ । প্রেমের অনুভব সীমানাতেই জীবনের রুপ বর্ণালী রেখায় দেখা দিয়েছে বুদ্ধদেবের কল্পনায় । ' আসলে বুদ্ধদেব আজীবন ব্যাতিক্রমহীন ভাবেই প্রেমের কবি । স্বপ্রেম ব্যাখ্যাই কবি নিজেই জনিয়েছেন , ' যা কিছু লিখেছি , সব , সবই ভালবাসার কবিতা , কথা বুনে , ছন্দ গেঁথে , শব্দ ছেনে আমি শুধু ভালোইবেসেছি সবচেয়ে তীব্র , মত্ত , সত্য করে । '
বুদ্ধদেব বসুর উল্লেখযোগ্য কাব্যকলা সমূহের মধ্য নাম যোগ্য কয়েকটি হল , ' বন্দীর বন্দনা ' ১৯৩০ , ' কঙ্কাবতী ' ১৯৩৭ , ' দৌপদীর শাড়ি' ১৯৪৮ , ' শীতের প্রাথনা : বসন্তের উত্তর ' ১৯৫৫ , ' যে আঁধার আলোর অধিক ' ১৯৫৮ , ' মরচে পরা পেরেকের গান ' ১৯৬৬ , ইত্যাদি ।
আধুনিক কবিতার নির্ভেজাল সাক্ষ্য তাঁর প্রথম কাব্যকলা , ' বন্দীর বন্দনা ' । কাব্য গ্রন্থখানি , প্রখ্যাত এক প্রেমের বিদ্রোহ মাখা আলোকঝরনা । প্রেমের কবি বুদ্ধদেব এ কাব্যসংগ্রহে প্রেমের যে অনবদ্য আধুনিক মননজাত রুপ পাঠককে রসাস্বাদন করবার জন্য দিলেন এক কথায় ভিন্ন স্বাদের এবং অবশ্যই আধুনিকতর বার্তাবহ । বুদ্ধদেব নিজেই প্রেম সম্পর্কে তাঁর স্বধারণা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেছেন , ' সৌন্দর্যের উপলব্ধিতে নিজের ভিতরে যত বাধা , যত মানসিক প্রলোভন ও দুর্বলতা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ , একদিকে মহৎ ও রোমাঞ্চকর স্বপ্নসঞ্চার , অন্যদিকে পঙ্কিল ও ক্ষুদ্র কামনা - এই আত্মবিরোধের যন্ত্রণা ও সেই কারণে স্রষ্টার উপর অভিসম্পাত । ' তাঁর সমগ্র কাব্যকলার প্রেমের সংকটময় আবর্ত এবং পরিমাণের এক তীব্র আনন্দ দুঃখময় জীবন নাট্যের ছন্দরুপ ধারণ করেছে । শেষ কাব্যগ্রন্থ ' স্বগত বিদায় ' এর ' সন্ধিলগ্ন ' কবিতায় বুদ্ধদেব লেখেন ,
' যৌবনে ভেবেছিলাম কবিতাই প্রেম ....
কিন্তু অন্য ধারণা সম্প্রতি
মাঝে মাঝে হানা দেয় আমাকে - বিশেষভাবে । ' ' বন্দীর বন্দনা ' ও' কঙ্কাবতী'তে যৌবনউদ্দমতা লক্ষ্য করা গেলেও চল্লিশের দশকে এসে বুদ্ধদেবের কবিতা প্রেম দর্শনের আলেখ্য রুপ নিয়েছে । রোমান্টিক কবি বুদ্ধদেব এ পর্বে শিল্পের চিরন্তন , শ্বাশ্বত চিরজীবি সত্ত্বায় আস্থাশীল হয়ে উঠলেন । বুদ্ধদেব লিখলেন ,
' যার সম্বল কেবল শব্দ , তাকে বাধ্য হয়ে
শব্দেই চালাতে হবে সব কাজ - যতই কঠিন মনে হোক / তাই আমি অবিরল পরিশ্রমী । '
আসলেই , রবীন্দ্রউত্তর আধুনিক কাল পর্বে বুদ্ধদেব বসু সর্বতোভাবেই একজন প্রেমের কবি । যৌবনের পূর্বরাগ পররাগ সমন্বিত কবি বুদ্ধদেব বসু সুদীর্ঘকালব্যাপি প্রেমের কবিতা লেখায় নিমগ্ন ছিলেন । ভাবতে অবাক লাগলেও সত্য তিনি কবিতা লিখেছেন মাত্র একটি বিষয়ে , - সেটি প্রেম । এ বিষয়ে তিনিই নিজেই লিখেছেন , ' যা লিখেছি , সবই ভালবাসার কবিতা । প্রথম যৌবনের উদ্দম উন্মাদনা থেকে শুরু করে বিগত বসন্তের সুতীব্র বেদনা এবং তারপর আবার পরিণত জীবনে বসন্ত স্মৃতির মমতাময় স্পর্শকাতরতা । ' বুদ্ধদেবের সমগ্র কাব্যকলার অলিগলি রাজপথ পর্যায়ক্রমে প্রেমের বিভিন্ন স্তর জুড়ে রয়েছে এক অনন্য বিনির্মাণ । প্রেম ও কল্পনা তাঁর কাব্যকলার দুই সমাহার ।
' কোটি কোটি মৃত সূর্য্যের মতো অন্ধকার
তোমার আমার সময় ছিন্ন বিরহ - ভার । '
একক বিষয় এমন একাগ্র চিত্তে সমগ্র কাব্যময় জীবন জুড়ে অসাধ্য সাধনে বুদ্ধদেব বসু অদ্বিতীয়তম একক স্রষ্টা হিসাবে বাঙালি পাঠককুলের নিকট আদরনীয় থাকবেন ।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন