ভাতের যে কী বিপুল মহত্ত্ব এবং দীর্ঘদিন ক্ষুধার অন্ন থেকে বঞ্চিত হলে মানুষের যে মর্মান্তিক আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হয় , এ গল্প সেই চরম সত্যকেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। আলোচক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মহাশ্বেতা দেবী । |
মহাশ্বেতা দেবীর ' ভাত ' এক বিষ্ময়কর গল্পকথন । আসলে ভাতের যে কী বিপুল মহত্ত্ব এবং দীর্ঘদিন ক্ষুধার অন্ন থেকে বঞ্চিত হলে মানুষের যে মর্মান্তিক আর্তনাদ প্রতিধ্বনিত হয় , এ গল্প সেই চরম সত্যকেই প্রতিষ্ঠা দিয়েছে । আমরা ভীষণ অবগত আছি , মানুষের এ পৃথিবী কখনই সাধারণ শ্রমজীবী গণমানবের জন্য বাসযোগ্য ছিল না । সৃষ্টির আদি হতেই এ জীবন ধারণ ও কর্মপ্রবাহের জন্য তাঁদেরকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় । তোমরা যাঁরা এই প্রতিবেদনটি পড়বে , আমি ধরেই নিচ্ছি তোমরা অধিকাংশই আমার স্নেহের ছাত্রছাত্রী , তোমাদেরকে সরাসরি না পড়ালেও আমার ব্লগ তোমরা অনেকেই পড়ে , অনেকেই আমাকে মেইল , ফোন করো , এজন্য বিশেষ কৃতজ্ঞ আমি । যায়হোক , শ্রমজীবী মানুষের কষ্টের জীবন যাপনের গল্পের আলোকপাত করছিলাম , চলো লক্ষ্যে ফিরি । তোমরা অনেকেই দেখেছো , তোমাদের কৃষিক্ষেতে যেসকল শ্রমজীবি মানুষ নিয়োজিত থাকেন সকলেরই আর্থিক অবস্থা কেমন । একবেলা না কাটলে তাঁদের খাওয়ার অন্ন জোটে না । প্রতিমূহূর্ত তাঁদেরকে বেঁচে থাকবার জন্য লড়াই করতে হয় । উৎসব নাইয়া , ওই সকল শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধি , যাঁরা পৃথিবীতে বেঁচেবর্তে থাকার জন্য ইচ্ছের বিরুপে , অনেক সময় শরীরের সাধ্যের বাইরেও পরিশ্রম করে । এবারে তোমরা ভাবো , খেতে বসলে তোমরা অনেক সময় ভাতের থালাতে রেখে বেশ কিছু উচ্ছিষ্ট । কিন্তু , উৎসবদের অন্ন অপচয় তো দূরের কথা , ক্ষুধার অন্ন তিন বেলা অনেক সময় জোটে না ।
এ গল্প উৎসবের , লোক মুখে তাঁর নাম ঘোরে উচ্ছব নাইয়া । আসলে গরীব মানুষ গুলোর ক্ষেত্রে তোমরা দেখবে , তাঁদের নাম গুলো ভেঙে ভেঙে এক ধরনের প্যরোডি নাম দেওয়ার একটা প্রবণতা আমাদের সমাজের অনেকেরই মধ্যে আমরা লক্ষ্য , উচ্ছবের ক্ষেত্রে তার অন্যথা হবে কেন ? উচ্ছবের সংসার ছিল , সন্তান ছিল , বৌ ও ছিল । কিন্তু দুর্ভাগ্য , মাতলার জল তাঁদেরকে নিয়ে গেছে তাঁদের সাথে । সেইহেতুগত কারণেই উচ্ছব পুরো একা হয়ে গেছে তাঁর জীবনে । শোক উচ্ছবকে ভয়ঙ্কর রকম চেপে ধরেছে । খাওয়া , কাজ করার কথা ভুলেই যায় উচ্ছব । মাঝে মাঝে শুধু বলে ওঠে ' ও চুন্ননির মা ' । আমরা জানি , মানুষ কেউ অমর নয় , জন্মালে তাঁকে মরতেই হবে । তোমরা লক্ষ্য করেছো , এই মাত্র জায়গাতে ধনী দরিদ্র সকলেই সমান । তবে , মৃত্যু যদি সঠিক সময় , অর্থাৎ দীর্ঘজীবন লাভের পর যদি মৃত্যু আসে তবে শোক দীর্ঘ স্থায়ী হয় না । কিন্তু মৃত্যু যদি অকালে ঘটে , তবে সেটা বেশ মর্মান্তিক এবং ভুলে থাকা সহজপর হয় না । তোমাদের কেউ যদি প্রিয়জনকে অকালে হারিয়ে ফেল তাহলে উচ্ছবের যন্ত্রণা তোমরা বুঝবে । যায়হোক , কত্তদিন আর শোকে কাতর থাকবে সে । আসলে সন্তান হারানোর শোকের থেকেও বড় যন্ত্রণা ক্ষুধার দহন ।
ভাত খায়নি উচ্ছব বহুদিন । লোক মুখে বাসিনির মালিক বাড়ির ভাতের কথা শুনেছে । উচ্ছব ভাত খাবে , তাই বাসিনির সঙ্গে কলকাতায় পাড়ি দেয় সে । বাসিনির মালিক বাড়ির বড়কর্তার ৮২ বছর বয়স , ডাক্তার হাত তুলে নিয়েছে , তাই যক্ষ করে তাঁকে বাঁচিয়ে তুলবার চেষ্টা হচ্ছে । উচ্ছব সেখানে কাজ নেই , কাঠ কাটার বিনিময়ে সে ভাত খাবে । দীর্ঘদিন ভাত খায়নি সে , তাই বাসিনিকে অল্প কয়েকটা ভাত দেওয়ার কথা বার বার করে সে । কিন্তু যক্ষের আগে ভাত দেওয়া যাবে না বলে উচ্ছবকে জানায় বাসিনি । উৎসবের চোখে এখন ভাত খাওয়ার আনন্দ , উৎসব কত্তদিন পর ভাত খাবে । কিছুটা বোধহয় পুলকিত হয় উৎসব । কিন্তু কাঠ কাটবার পর , বিশ্রাম নিয়ে উঠে উৎসব শোনে সেই বুড়ো কর্তা মারা গেছে । তাই যক্ষের ভাত কেউ খেতে পারবে না । উৎসবের মাথায় যেন বজ্রপাত হয় । এত্ত পরিশ্রম করেও সে আরাধ্য ভাত খেতে পারবে না । এবার উৎসব দুরভিসন্ধি করে , বাসিনির কাছ থেকে একটা ভাতের হাঁড়ি নেয় সে , দূরে কোথাও ভাত গুলো ফেলে দিয়ে আসবে বলে । কিন্তু ভাত ফেলে দেয়নি সে । উচ্ছব ভাত খাবে , ভাত না খেলে বাঁচবে না সে । ভাতের হাঁড়ি নিয়ে পালিয়ে আসে উৎসব । তারপর স্টেশনে এসে পাগলের মত ভাত খেতে শুরু করে সে । সকাল বেলা উৎসবকে গ্রেপ্তার করা পিতলের হাঁড়ি ছুরি করার অপরাধে ।
গল্পটিতে দরিদ্র গণ মানুষের যন্ত্রণার কথা অত্যন্ত জোরালো ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে । ভাত যে কত্তটা মহার্ঘ , যাদের ভাতের যন্ত্রণা রয়েছে , তাঁরাই বুঝবে । এ গল্প সমাজের এক বৈষম্যের ভয়ঙ্কর নগ্ন দিকটিই উপস্থাপন করতে পেরেছে ॥
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন