চর্যাপদ আবিষ্কার হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মহান কৃতিত্ব হলেও তাঁর সব সিদ্ধান্ত অভ্রান্ত নয় । আলোচক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।
চর্যাগীতির আবিষ্কার বাংলা ভাষা সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিশিষ্টতম ঘটনা । বৌদ্ধ সহজিয়াদের স্বজীবনের আলাপ গাঁথা , এই আবিষ্কৃত পুঁথি বহু প্রশ্নের সমাধান যেমন দিয়েছিল , তেমনি পূর্ব প্রচলিত অনেক সিদ্ধান্তকেও আবার বিচলিত করে তুলেছিল । পুরো ঊনিশ শতক তো বটেই , বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেও এই মূল্যবান নথি সম্পর্কে গবেষক মহলে তেমন কোন খবর ছিল না । চর্যাগীতিকোষ আবিষ্কার পূর্বে ১৮৫৮ সালে রাজেন্দ্রলাল মিত্র ' বিধিধার্থ সংগ্রহ ' পত্রিকায় ' বঙ্গভাষার উৎপত্তি ' নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন । উক্ত প্রবন্ধে শ্রী মিত্র , বাংলাকে হিন্দির পূর্ব শাখা থেকে উৎপন্ন বলে অভিমত প্রকাশ করেন । তিনি আরও লেখেন , বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন বিদ্যাপতি রচনাবলী । একটি বিষয় , এখানে পরিষ্কার ভাবে বলে নেওয়া উত্তম , শ্রী মিত্র এই প্রবন্ধটি যে সময় ' বিধিধার্থ সংগ্রহ' পত্রিকায় লিখছেন , সেই সময়পর্বে উৎকৃষ্টতম ভাষা সাহিত্য উপাদান এক প্রকার অপ্রতুল ছিল । ফলত , শ্রী মিত্রের সিদ্ধান্ত পুরোপুরি অনুমান মূলক , এ বিষয়ে সন্দেহ নেই । আবার , ১৯১১ সালে প্রকাশিত হল , দীনেশচন্দ্র সেনের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ' The History of Bengali Language and Literature ' । এই গ্রন্থে ড . সেন বাংলা ভাষার প্রাচীনত্ব প্রসঙ্গে বাংলা সাহিত্যের আদি পর্বে বৌদ্ধ প্রভাবের কথা উল্লেখ করলেও , তিনি মূলত আলোচনা করেছেন , গোপিচন্দ্রের গান , ডাক খনার বচনের মত লৌকিক উপাদান সমূহ । বলে রাখা উত্তম , উক্ত আলোচনা সমূহে যুক্তির অধিক অনুমান দ্বারাই চালিত হয়েছেন ড . সেন ।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রেক্ষিতে' চর্যাপদ ' নিঃসন্দেহে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন । পুঁথিটি বাংলার বাইরে এক প্রকার লোকচক্ষুর অন্তরালে দীর্ঘদিন নেপালের রাজদরবারে সংরক্ষিত ছিল । নেপাল এবং তিব্বতে রক্ষিত এই সকল পুঁথি সংগ্রহের ব্যপারে তৎপরতা দেখান বিদেশি গবেষকগণ , প্রসঙ্গক্রমে Brian Hodgson , Eugene Burnouf , Daniel Wright এবং Cecil Bendall এর নাম আমরা উল্লেখ করতে পারি । বাঙালি গবেষকদের মধ্যেও এ ব্যপারে আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় । ১৮৮২ খৃঃ রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপাল যান এবং সংস্কৃত ভাষায় লিখিত বিভিন্ন বৌদ্ধ পুঁথি সংগ্রহ করেন । ১৮৮২ সালে সেই সব পুঁথি সমূহ তিনি ' Sanskrit Buddhist Literature in Nepal ' নামে প্রকাশ করেন । রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মৃত্যুর পর সরকার পুঁথি সংগ্রহের দায়ভার অর্পণ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের উপর । পুঁথি সংগ্রহের নিমিত্তেই শ্রী শাস্ত্রী , ১৮৯৭ - ৯৮ দুই বার নেপাল যান এবং বেশ কিছু সংস্কৃত পুঁথি সংগ্রহ করে আনেন । ১৯০৭ সালে তিনি তৃতীয় বারের জন্য নেপাল যান । পন্ডিত শাস্ত্রীর এই তৃতীয় বার নেপাল যাত্রা বাংলা সাহিত্যের উদ্ভবের নেপথ্যের লক্ষণ এবং চিহ্ন সমূহ জানবার জন্য কল্যাণবহ হয়েছিল । যায়হোক , ড . শাস্ত্রী এই পর্বে অনেকগুলো পুঁথি আবিষ্কার করেন , তার মধ্যে ছিল ' চর্যাচর্যবিনিশ্চয় ' , ' সরহপাদের দোহা ' , অদ্বয়বজ্রের সংস্কৃতে রচিত ' সহজামনায়পঞ্জিকা ' , নামক টীকা এবং কৃষ্ণাচার্য এর ' দোহা ' ও আচার্যপাদের রচিত ' মেখলা ' নামীয় টীকার পুঁথি সমূহ । বাংলা ১৩২৩ সনে , ইং ১৯১৬ সালে ' বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ' থেকে হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা ' নামে আবিষ্কার হওয়া পুঁথি সমূহ প্রকাশ করেন । গ্রন্থটি প্রকাশের পরেই পুরো দেশময় আলোড়ন সঞ্চার হয় । বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উদ্ভব ও বিবর্তনের পূর্ব যে সিদ্ধান্তগুলো এতদিন আদরনীয় ছিল , সেগুলো বিচলিত হয়ে পড়ল । আলোড়ন শুধু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেই নয় , অনন্য ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তা অনেক গুলো প্রশ্ন চিহ্নের মুখে উপস্থাপনা দিয়েছিল ।
পুঁথি সমূহের আবিষ্কার এবং শাস্ত্রী মহাশয় দ্বারা তার গ্রন্থবদ্ধ রুপ আলোড়িত হলেও , বলে নেওয়া উত্তম , উক্ত গ্রন্থে শাস্ত্রীকৃত সব সিদ্ধান্ত কিন্তু অভ্রান্ত ছিল না । প্রথমত , তাঁর আবিষ্কৃত পুঁথি সমূহকে তিনি বাংলা ভাষা আদিরুপ বলে জ্ঞান করলেও আদতে সেগুলো সব বাংলায় রচিত নয় । শুধুমাত্র , প্রথম পুঁথিটির ভাষ্যরুপই বাংলা , অন্য তিনটি পশ্চিমা অপভ্রংশে রচিত । দ্বিতীয়ত , হরপ্রসাদ মনে করেছিলেন , তাঁর আবিষ্কৃত পুঁথিটিই চর্যার মূলকোষ এবং সেই পুঁথির নাম ' চর্যাচর্যবিনিশ্চয় ' , উক্তহেতুগত কারণে তিনি পুঁথির নামকরণও করেন সেইরূপ । কিন্তু শ্রদ্ধেয় , ড . সুনীতিকুমার বাবুর আবিষ্কৃত তথ্যের উপর নির্ভর করে ড . প্রবোধচন্দ্র বাগচী চর্যার যে তিব্বতী অনুবাদ সংগ্রহ করেছিলেন , তাতে দেখা মেলে চর্যার মূল গীতি সংগ্রহের নাম ' চর্যাগীতি কোষ ' । এক্ষেত্রেও শাস্ত্রীর অনুমান ভ্রান্ত প্রমাণিত হয় ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন