' মনসা মঙ্গল 'কাব্য মনসার পূজা প্রতিষ্ঠার হলেও , গল্পে নায়কোচিত ভূমিকায় প্রতিষ্টিত চন্দ্রধর বণিক । লিখেছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি ॥
বাংলা সাহিত্যের আদিমতম নিদর্শন চর্যাপদ , এ বিষয়ে এই মুহূর্ত তেমন কোন সন্দেহ নেই । সাহিত্যের গতিপথ এই যে মানুষের গণভাবনা ও সুখ দুখের গল্পে আবর্তিত হচ্ছিল , সেই আদলের কিছুটা বদল আমরা মধ্যযুগে এসে লক্ষ্য করি । অর্থাৎ গণ মানুষের গণ ভাবনা , স্বজীবনের গল্পকথন পূর্ব বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্টিত থাকলেও , মধ্যযুগে এসে তা রাতারাতি দেব ভাবনার রুপ নিল । বিষয়টি আরও ঋজু করে উপস্থাপন করা দরকার । চর্যার সময় এবং তৎসমকালীন সময় পর্বে বাংলা সাহিত্যকারগণ মানুষের কথা বললেও , এ পর্বে মানুষ হঠাৎ করে গৌণত্বে পরিণত হল । দেবতারা এ পর্বে মুখ্যরুপে আবর্তীত হলেন । মানুষের গল্প নেই , এমন বললে সত্যের অপলাপ হবে । হাঁ , মানুষের গল্প আছে , তবে যৎসামান্যই । সে মানুষ স্বস্বাধীন সত্ত্বার অধিকারী নন , তাঁরা ঈশ্বরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত । ঈশ্বরের মর্জিমাফিক যেমন রুদ্ধ হয় তার পথ চলা , তেমনি আবার ঈশ্বরের মতেই উন্মুক্ত হয় তাঁর গতিপথ ।
যায়হোক , মধ্যযুগীয় এই যে ধারা , যেখানে দেব প্রধান , এই ধারা সাধারণত' মঙ্গল কাব্য ' নামে সমধিক পরিচিত । মঙ্গল কাব্যের যে দেবগণের নামকীর্তন কবিগণ করেছেন , তাঁরা মূলত মর্ত্যভূমিতে স্বপূজা প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে ব্যাকুল , ঈর্ষাপরায়ন , এমনকি খলনায়কের ভূমিকা নিতে দ্বিধাগ্রস্থ হননি । স্বর্গেরই কোন স্বল্প বলবান দেবদেবীকে অভিশাপ দিয়ে মানব রুপে মর্ত্য প্রেরণ করেছেন এবং তাঁদের দ্বারাই স্বপূজা করবার পথ প্রশস্ত করেছেন ।
মঙ্গল কাব্যের একটি প্রধানতম ধারা হল ' মনসা মঙ্গল ' । মঙ্গল কাব্য সমূহের মধ্যে প্রাচীনতমও বটে । ' মনসা মঙ্গল ' দেবী মনসা , সর্পের দেবী । মর্ত্যভূমিতে তাঁর পূজা প্রচলনের গল্পের নেপথ্যের কারসাজি ,চন্দ্রধরের অনমনীয় মনোভাব মুখ্য দ্বন্দ্ব হিসাবে প্রকটিত হয়েছে । অবার্চীণ পুরানে মনসাকে শিবের ' মানসকন্যা ' রুপে অভিধা দেওয়া হয়েছে । যদিও প্রাচীন পুরাণে শিবের কোন মানসকন্যার উল্লেখ সেই অর্থে মেলে না । আবার ' বিনয়বস্ত্ত ' ও ' সাধনমালা ' নামক দুখানি বৌদ্ধগ্রন্থে মনসাকে ' জাঙ্গুলি ' বা ' জাঙ্গুলিতারা ' নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে । ' পদ্মপুরাণ ' ,' দেবী - ভাগবত ' এও মনসার কথা মেলে । বাংলাদেশে দশম - একাদশ শতাব্দী থেকে মনসার মূর্তির কথা পাওয়া যায় । দক্ষিণ ভারতে মঞ্চমা ' নামের এক সর্পদেবীর উল্লেখ পাওয়া যায় ।
' মনসা মঙ্গল ' মূলত মনসার পূজা মর্ত্ত্যে কিভাবে প্রতিষ্টিত হল তার গল্প । গল্পটি মনসার পূজা প্রতিষ্ঠার হলেও , গল্পে নায়কোচিত ভূমিকায় প্রতিষ্টিত চন্দ্রধর বণিক । চাঁদ সদাগর নামে সমধিক পরিচিত চরিত্রটি বাংলা কাব্য সাহিত্যের অন্যতম আদরনীয় চরিত্র । চাঁদ চরিত্রগত দিক দিয়ে অসম্ভব বলিষ্ঠ , তিনি শিব ভক্ত । যে হাতে তিনি শিবকে পূজা দিয়েছেন , সেই হাত দিয়ে মনসাকে পূজা দিতে তিনি ভীষণ রকম নারাজ । এদিকে মনসার দুরভিসন্ধি হল , চাঁদ সমাজের মান্যবর ব্যক্তিত্ব , তাঁর হাত থেকে পূজা নিতে পারলেই , তাঁর পূজা সমাজগত ভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে ।
এই দ্বন্দগত পরিআবহিকতায় মনসা মঙ্গল কাব্যের প্রাণ । মনসা চাঁদের হাত থেকে পূজা নিতে বদ্ধপরিকর , অন্যদিকে চাঁদও জীবন থাকতে মনসার পূজা করবেন না , এই ভাবনায় অনড় রইলেন । শেষমেষ , মনসা হিংস্র হয়ে উঠলেন । একে একে সর্পদর্শনে হত্যা করলেন , চাঁদের ছয় পুত্রকে । শেষপুত্র লক্ষীন্দর , যাঁর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল বেহুলার । কিন্তু এ বিবাহ সুখের হল না , বসর ঘরেই মনসা লক্ষীন্দর হত্যা করলো । তারপরের গল্প বেশ নাটকীয় , সতী বেহুলা মৃত স্বামী লক্ষীন্দরের মৃতদেহ ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে চললো অজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে । নেতায় ঘাটের কাছে এক ধোপার সাহায্যে বেহুলা দেবলোকে পৌঁছোয় , তাঁর পতিপ্রেমে আকৃষ্ট হন দেবগণ । শিবের নিদেশে মনসা ফিরিয়ে দেন লক্ষীন্দর সহ চাঁদের অন্য ছয় পুত্রকে । তবে , শর্ত একটা চাঁদকে মনসার পূজা করতে হবে । শেষমেষ , বেহুলা এবং স্ত্রী সনকার অনুরোধে পিছন ফিরিয়ে বাঁ হাতে চাঁদ মনসার পূজা দিলে মনসা তা গ্রহণ করে । এই হল মনসা মঙ্গল কাব্যের কাহিনীগত ইতিবৃত্ত ॥
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন