রবীন্দ্রোত্তর কবিদের চোখে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
রবীন্দ্র সমীপেষু । |
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ সমীপেষু , বাঙালির সর্বকালিক অভিভাবক । তবে শুধু বাংলা ভাষী নন , সমগ্র ভারতবর্ষের গৌরব সূর্য তিনি , অহংকারের পূর্ণচন্দ্র । রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করবার দুঃসাহস বাঙালি আজ অব্দি দেখাতে পারেনি , তবে কি রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করবার আস্ফালন বাংলা সাহিত্যে ঘনীভূত হয়নি ? হয়েছে , তবে সে প্রচেষ্টা নিতান্ত কাঁচা এবং এলেবেলে সদৃশ অপরিপক্কজাত । মোহিতলাল মজুমদার , ডি .এল রায় প্রমুখ সাহিত্য মানস সমালোচকগণ রবীন্দ্র ত্রুটি সমন্বিত ইস্তাহার রচনায় প্রয়াসী হয়েছিলেন , তাঁরা রবীন্দ্রসাহিত্যকে ভাবের সাহিত্য বলেই আখ্যায়িত করেছিলেন , যদিও তাঁদের এ অভিযোগ নিঃসন্দেহভাবে অমূলক কিম্বা ঈর্ষাজনিত হতে পারে । পাঠক , কল্পনা করুন তো , ' চোখের বালির ' বিনোদনী ' নামক চরিত্রটির বিনির্মাণগত আদলের কথা । উল্লেখিত , ওই চরিত্রটির মত বাস্তবের মাটিতে হেঁটে বেড়ানো চরিত্রগত আদল শুধু বাংলা সাহিত্য কেন , বিশ্বসাহিত্যেও বিরলতম । আকাল বৈধব্য বিনোদ , কপাল দোষে পতিপ্রেম জোটেনি তাঁর , তাই মহেন্দ্রের স্ত্রীর পতিপ্রেমকে সে ঈর্ষার চোখে দেখছে । কাহিনীর এমন মনস্তাত্বিক মোচড় সমাজ জীবনের গল্পেও আমরা মুখরিত হতে দেখি । যায়হোক , আলোচনার বহর বিস্তারে কাজ নেই , আসুন মুখ্যকথনে ফিরি । বলবার কথা হল , রবীন্দ্রনাথ অস্বীকার করবার মত ক্ষমতা বলুন , আর ইচ্ছেডানায় বলুন , বাঙালি কবি গল্পকারদের নেই । বরং রবীন্দ্রনুসরণ একপ্রকার ঐতিহ্য বটে ।
জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী ছাত্র । অধ্যাপকও । ইংরেজি সাহিত্যের রথী মহারথী , ইয়েটস , ইলিয়ট , শেলী কীটসে মুগ্ধ হয়েছেন , তবুও ঐতিহ্যগত কারণেই তিনি বটবৃক্ষ রবীন্দ্রনাথ সমীপেষুকে অস্বীকার করেননি । একইভাবে , আমরা সুধীন্দ্রনাথ দত্ত , বিষ্ণু দে' র কথাও বলতে পারি । তাঁরা সকলেই ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র এবং অভিভাবক রবীন্দ্র সমীপেষুর স্মরণ নিয়েছেন । কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের একটি উক্তি প্রসঙ্গগত স্মরণে আসছে , তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে লিখেছিলেন , ' রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের সিদ্ধিদাতা গণেশ । '
এখানে , আর একটি রবীন্দ্রবিরোধী সাহিত্য গোষ্টির কথা বলে নেওয়া উত্তমকাজ হবে বলে অধমের মন সাড়া দিচ্ছে । চল্লিশের দশকে রবীন্দ্রবিরোধীতার জন্যই একটি সাহিত্য গোষ্টির আবির্ভাব হয় । কল্লোল সাহিত্য গোষ্টির সভ্যগণ রবীন্দ্র বিরোধীতায় মুখর হন । প্রথম দিকে মানিক বন্দোপাধ্যায় , তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় সমীপেষুগণ , এই গোষ্টিতে নাম লেখালেও পরবর্তীতে বন্ধন মুক্ত হন স্বভাবজাত সসীমতার কারণে । বলে নেওয়া ভালো , এই কল্লোল গোষ্টির রবীন্দ্রবিরোধী আন্দোলন ফলপ্রসূ হয়নি , মাত্রাতিরিক্ত বাস্তবতার ছবি উপস্থাপনা দিতে গিয়ে সাহিত্যগতগুণের ভারসাম্য তাঁরা বিনষ্ট করে ফেলেছিলেন ।
কিশোর সুকান্ত কবিবর নজরুলের মতোই সাম্যবাদী , বিপ্লবী ও জীবনধর্মী কবি । ছোট অথচ মহৎ এক জীবন নিয়ে তাঁর ধরাভূমিতে আবির্ভাব । সব রকমের অসাম্য এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেতে ভয় পেতেন না কিশোর কবি । আসুন , তাঁর জ্বালাময়ী কবিতার একটু পরখ করি ।
' প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা ,
ভেঙেছিস ঘরবাড়ি ,
সে কথা কি আমি জীবনে মরণে
কখনও ভুলতে পারি ?
আদিম হিংস্র মানবিকতার যদি আমি কেউ হই
স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের
চিতা আমি তুলবই । '
মাত্র একুশ বছরের একটা জীবন , এই স্বল্পআয়ু সময়ে তিনি কোথায় পেলেন এমন বিস্ফোরণে ফেটে পড়বার হুঙ্কার ? নিঃসন্দেহে তাঁর পারিবারিক আবহ , সাম্যবাদী মতাদর্শ এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ । ' রবীন্দ্রনাথের প্রতি ' কবিতায় সুকান্ত লিখে গেছেন সেই অমরকথা ।
' এখনো প্রাণের স্তরে স্তরে
তোমার দানের মাটি সোনার ফসল তুলে ধরে ।
এখনো স্বগত ভাবাবেগে ;
মনের গভীর অন্ধকারে তোমার সৃষ্টিরা থাকে জেগে । '
কবি বুদ্ধদেব বসু , রবীন্দ্রউত্তর কালের এক শ্রেষ্টতম সরস্বত প্রতিভা । একাধারে তিনি কবি , প্রাবন্ধিক , সাহিত্য সংগঠক এবং বিশিষ্ট সম্পাদক ।' কবিতা ' বাংলা সাহিত্যের এক বিশিষ্টতম সাহিত্য প্রত্রিকা । কবি বুদ্ধদেব বসু ছিলেন , এই কবিতা পত্রিকার সম্পাদক । কবি জীবনানন্দ দাশের প্রিয় বন্ধু , বুদ্ধদেব বসুর ' কবিতা ' পত্রিকাকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্য বিশেষভাবে পুনরুজ্জীবিত হতে থাকে । যায়হোক , শিরোনামগত আলোচনার অভিমুখে ফেরা যাক , জীবনানন্দ , সুধীন্দ্রনাথ , বিষ্ণু দের মত শ্রী বুদ্ধদেব বসু ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র । ইংরেজি সাহিত্য পাঠে তাঁর হৃদয় বিনির্মাণ পরিপূর্ণ থাকলেও ঐতিহ্যগত কারণেই তিনি রবীন্দ্র সমীপেষুকে অস্বীকার করতে পারেননি , যদিও প্রথম দিকে রবীন্দ্রবিরোধী হিসাবে নিজেকে উপস্থাপনা দিতে চাইলেও , পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথেই তিনি মুক্তির পথ খোঁজেন ।
রবীন্দ্রনাথ তাঁকে এনে দেয় এক বিমুগ্ধ অভিজ্ঞান । পরম আত্মীকতা বুদ্ধদেবকে লেপ্টে ধরে । রবীন্দ্রনাথ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মত তাঁর হৃদয়ে অবস্থান নিয়েছেন । বুদ্ধদেবের রবীন্দ্রমুগ্ধতা আসুন পরখ করি , : 'আমরা বারে বারে বিস্মিত হই, যখন দেখি তাঁর অধিকৃত ভূমি কী বিস্তীর্ণ, কত ভিন্ন ভিন্ন সুরে ও স্বরে তিনি কথা বলতে পারেন, কী রকম দ্রুত পরিবর্তনশীল তাঁর ভাব ও ভঙ্গি। সহজেই আবিষ্কার করি অনেক ভিন্ন ভিন্ন ধরন, কবিতার বিষয়ে অনেক ভিন্ন ভিন্ন ধারণা। কাব্যকলার কোনো অনন্য আদর্শে রবীন্দ্রনাথ আত্মসমর্পণ করেননি- যেমন করেছিলেন বোদলেয়ার ও ভের্লেন, ইয়েটস ও ইলিয়ট, পরবর্তীকালে সুধীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ (কবি রবীন্দ্রনাথ)।'
আসলে , বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ সমীপেষু , বাঙালি হৃদয়ে একচ্ছত্রভাবেই অধিকার গেড়ে বসে আছেন । সকল , বাঙালির মতো , বুদ্ধদেব বসুও রবীন্দ্রকলায় মুগ্ধ । রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তাঁর চিন্তা এবং চেতনার অভিজ্ঞান সুবিস্তৃত । বুদ্ধদেব বসুর একটি চমক লাগানো উক্তি স্মরণ করার মতো : 'গ্যেটের মতো রবীন্দ্রনাথও একজন নন, এক শ জন মানুষ, আর কাব্যে যিনি ধরা দেন তিনিও একজন নন, অনেক ভিন্ন ভিন্ন কবির সমাহার। কবিতার কাছে যা আমাদের নূ্যনতম প্রত্যাশা শুধু সেটুকু মেটাতে তিনি আপত্তি করেন না; আবার তাঁর কবিতা আমাদের জন্য যা করতে পারে তার বেশি কোনো কবিতারই সাধ্য নেই। এবং দুই চরণের মধ্যবর্তী অনেক স্তরও তাঁর রচনায় প্রাজ্ঞীয়।'
আসলে , রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে একক এক পৃথিবী , এক সমুদ্র জলোচ্ছ্বাস । দিনের প্রখর সূর্য তিনি , আর রাতের পূর্ণ চন্দ্রমা । তাই রবীন্দ্রস্মরণ আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের ভারত আগমনের মত সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে , বাঙালির ললাটে । বুদ্ধদেব লিখছেন , 'তাঁর কবিতা- যা এমন প্রচুর, বিচিত্র ও অবসানহীন, তাঁর কাছে আমরা পেয়েছি- শুধু কবিতা পড়ার আনন্দ নয়, পেয়েছি সেই সোনার বাংলাকে, যার আকাশ-বাতাস আমাদের মনে বাঁশি বাজায়। সেই সঙ্গে অন্য এক ব্যাকুল বাঁশরিও তিনি শুনিয়েছেন, এক সুদূর বিপুল সুদূরের আহ্বান, দেশকালোত্তর বিশ্বের সমাচার।... তারই হাত থেকে জগৎটাকে পেয়েছিলাম, তাই এখন তা নিয়ে যা খুশি তা-ই করতে পারছি।'
পাঠক , আসুন , তাঁর আরও কিছু কথা স্মরণ করি । 'যদি তিনি শুধু স্বল্পসংখ্যক উৎকৃষ্ট কবিতা লিখতেন, তাহলে হয়তো পরবর্তী কবিদের পক্ষে আরো ভালো হতো, কিন্তু তাঁর সমগ্র স্বজাতির মানসিক দারিদ্র্য ঘুচত না। এখানেই তাঁর আতিশয্য ও উচ্চবচতার সার্থকতা।' আরও পড়ুন , : 'রবীন্দ্রনাথ সেই অমরবৃন্দের অন্যতম, যাঁর বিষয়ে নির্ভয়ে বলা যায় যে সাহিত্যের আদর্শে যতই পরিবর্তন ঘটুক, বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন কারণে তিনি সমাদৃত হবেন এবং কোনো না কোনো কারণে প্রতি যুগ তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবে।' (কবি রবীন্দ্রনাথ)।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন