নোঙর কবিতার কবি অজিত দত্ত : সমকালীন জীবনের মেঘকৃষ্ণ বন্ধ্যা অন্ধকারের জন্য কবির আক্ষেপ । নৈরাশ্যপীড়িত পৃথিবীতে কবি ক্লান্ত হলেও কবির মনে ছিল রোমান্টিক মনের স্বপ্ন । আলোচনা করেছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি


রবীন্দ্রউত্তর কবি অজিত দত্ত , কল্লোল যুগের সাহিত্যিক হওয়া পরও রবীন্দ্র বিরোধী হিসাবে স্বপরিচয় প্রতিস্থাপনে সচেষ্ট হননি । বাংলা কাব্যে তিনি বুদ্ধদেব বসুর সহযোগী হিসাবে আবির্ভূত হন । সমকালীন যুগ যন্ত্রণা , নৈরশ্যের হাহাকার তাঁকে পীড়িত করলেও জীবন বিমুখ করেনি , বরং দুঃখ তাপে পুড়িয়ে তাঁকে জীবনবাদী কবি হিসাবে গড়ে তুলেছে । স্বরস্বত এবং চিরন্তন শ্বাশ্বত কাব্যিক উপাদানকেই তিনি স্বকাব্য শরীরে উপস্থাপনা দিয়েছেন । কবি হিসাবে তিনি ছিলেন ভাবুক এবং রোমান্টিক ।  কাব্য ভঙ্গিমায় তাঁর কথন ছিল ঋজু চালে বিদ্ধ , সহজ সরলতাই আবদ্ধ । ১৯৩০ সালে প্রকাশিত ' কুসুমের মাস ' , তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ । ' কুসুমের মাস ' ছাড়াও তাঁর অন্যান্য নামযোগ্য কাব্যগ্রন্থ সমূহ হল , ' পাতাল কন্যা ' , ' নষ্টচাঁদ ' ,'  পুনণবা ' , ' ছায়ার আলপনা ' , ইত্যাদি । 

হতাশা , নৈরাশ্য ও জীবন গল্পের অন্যান্য অপদিক কবিতায় আনয়নের পাশাপাশি তিনি অন্য সকল রবীন্দ্রউত্তর কবিদের মত প্রেমের কবিতা লিখেছেন । প্রেম , রোমান্টিকতা ও সৌন্দর্যের বাস্তব ও পরাবাস্তবতা তাঁর কবিতার প্রাণ । প্রত্যেক কবি মানুষের স্বমানস প্রতিমা থাকে , যাঁর কাছে কবিবরগণ প্রেম , ভালোবাসা , ফরিয়াদ কিম্বা অভাবের ফুলঝুরি আনয়ন করেন । কবি জীবনানন্দ দাশের যেমন ' বনলতা সেন ' , কবি বুদ্ধদেব বসুর '  কঙ্কাবতী ' , তেমনি কবি অজিত দত্তের মানস প্রতিমার নাম'  মালতী ' । এই মালতীকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেই অজিত দত্ত , প্রেমমূলক কাব্য রচনায় ব্রতী হয়েছেন । 
' তুমি ছাড়া এ জীবনে দুঃখের নাহিক মোর পার
একথা কহিবো আমি লক্ষ বার আকাশের কানে  একথা ছড়ায়ে দিবো আজ রাত্রে প্রত্যেক তারায়
বাতাসে ভাসাবো আমি এই সত্য সমস্ত ধরায় । ' 

তাঁর রচিত ' সনেট ' সমূহ প্রশংসার দাবি রাখে । সমালোচক কবি বুদ্ধদেব বসু , তাঁর '  কুসুমের মাস ' কাব্যগ্রন্থের আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছেন , ' অজিতকুমারের সনেটগুলো অনবদ্য , বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ । ' আবার ড . দেবেশকুমার আচার্য , তাঁর ' বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ' আধুনিক পর্বে অজিত দত্ত বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন , ' এই সনেট যেন ভালবাসার বিভিন্নভাবের এক একটি ছবি । .... ভাষার মিতব্যয়িতা , ব্যঞ্জনার সংযম , ভাবের কঠোরতা অজিত দত্তের সনেটের অন্যতম বৈশিষ্ট । তাঁর সনেটে লক্ষ করা যায় , সমকালীন জীবনের মেঘকৃষ্ণ বন্ধ্যা অন্ধকারের জন্য কবির আক্ষেপ । নৈরাশ্যপীড়িত পৃথিবীতে কবি ক্লান্ত হলেও কবির মনে ছিল রোমান্টিক মনের স্বপ্ন - সিন্ধুতলে মৎস্যকন্যা , গিরিশিরে গন্ধর্ব - নগরী । ' 

অজিত দত্ত তাঁর কবিতায় জীবন গল্পের পঙ্কিলতা , বিষাদের পারদগত বিস্ফোরণের রুপ বাকময় করলেও , হতাশায় কখনই নিমজ্জিত হয়নি তাঁর কবিমন । সৃষ্টিসুখের গানে তিনি গেয়ে উঠেছেন পুনর্জীবনের গান । এখানে রবীন্দ্রউত্তর কবিদের মাঝে নিজের স্বতন্ত্রতা বজায় রাখতে তিনি সক্ষম হয়েছেন । 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।