জীবনানন্দ দাশের কাব্যে অন্ধকার প্রসঙ্গ ও মৃত্যু চেতনার স্বরুপ । বিশ্লেষন করছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।


বাংলা কবিতার বরপুত্র কবি জীবনানন্দ দাশ 
জীবনানন্দ দাশ বিশ শতকের বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠতম কবি । রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় রবীন্দ্র ভিন্ন স্বর দিয়ে বাংলা কবিতার শরীর গঠন করবার কথা যাঁরা ভাবতেন জীবনানন্দ তাঁদের মধ্যে প্রধানতম মুখ । বাংলা কবিতায় নতুন রক্ত প্রবহমান শুধু করেননি তিনি , বাঙালি পাঠককে দিয়েছিলেন ভিন্নতর এক অনন্য কাব্য আস্বাদ । জীবদ্দশায় মাত্র ১৬৭টি কবিতা তাঁর প্রকাশিত হয়েছিল , তাতেই তিনি কাব্য জগতে তুলেছিলেন বিষ্ময়কর এক অভিজ্ঞান । ভাবতে অবাক লাগে , এই সময়কার কাব্যকলায় যাঁরা পদচিহ্ন রাখছেন , তাঁরা কয়েকমাসে তারও অধিক কাব্য রচনা করেন । পাঠকের মনে হতে পারে , মাত্র এই কয়েকটি কবিতা নিয়েই কী সজ্জিত ছিল কবি জীবনানন্দের কাব্য সংসার , এমন ভাবলে ভুল হবে , কেননা জীবনানন্দ নিরন্তর ভাবে কাব্য সাধনায় ব্যাপিত ছিলেন এক প্রকার লোকচক্ষুর অগোচরেই ছিল , তাঁর সেসকল কাব্য সম্ভার । শনিবারের চিঠি পত্রিকার সম্পাদক সজনীকান্ত সেন ছিলেন জীবনানন্দের কাব্যের বিরুপ সমালোচক , কবি কাজী নজরুলের মত সজনী ,  আধুনিক কবিতার বরপুত্র জীবনানন্দের কাব্যময় জীবনের এক বিরাট কাঁটা স্বরুপ ছিলেন  ।  আসলে জীবনানন্দ হলেন বাংলা কবিতার অশ্বমেধের ঘোড়া , তিনি সময়ের থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন , সজনীর মত অনেকেই স্বল্প সাহিত্য বোধ নিয়ে তাঁকে বুঝতে পারেননি , ফলত অকারণে তাঁকে সমলোচনা করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন ।

রবীন্দ্রযুগে জন্ম নিয়ে রবীন্দ্র মায়া কাটিয়ে উঠতে গেলে , তপস্যার সাথে প্রতিভারও প্রয়োজন হয় । বিষয়টি সহজ নয় , অনেকেই রবীন্দ্রনাথের ঈর্ষণীয় প্রতাপে ঝলসে কয়লা হয়েছেন । জীবনানন্দ দাশ ছিলেন  নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী । তিনি একটি নিজস্ব স্বতন্ত্র এবং আলাদা জগৎ তৈরি করতে সচেষ্ট হন এবং সফলতার সঙ্গে তা করতে সক্ষমও হয়েছিলেন । সে জগতে ঈশ্বরের অলিখিত সম্ভ্রম নেই , নেই মায়াবী জগতের হাতছানিও । আসলে জীবনানন্দ যে সময়ে পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেরিয়েছেন ,  সে তো যেমন তেমন সময় নয় , মানুষ সে সময় ' যক্ষ্মায় ধুঁকে মরে মানুষের মন ' , এই মনমরা সময়ে দাঁড়িয়ে জীবনানন্দ কেমন করে বলবেন ' আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে ' , তিনি পারেন না , কেননা ' মাথার ভিতরে / স্বপ্ন নয় - প্রেম নয় - কোন এক বোধ কাজ করে । ' 
এই অনন্য বোধ দ্বারা চালিত হয়েছে জীবনানন্দের কাব্যময় জীবন । জীবনানন্দকে গভীর মনোযোগ সহ নিরীক্ষণ করলে অনুভব হয় , কবির কাব্যশরীরে অন্ধকার প্রসঙ্গ এবং মৃত্যুচেতনার বারবাড়ন্ত যেন একটু গভীর নিকষ কালোর মত লেপ্টে রয়েছে । বিষয়টির নেপথ্যে নিশ্চয় বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে , প্রথমত সময় , জীবনানন্দ যেকালে বেড়ে উঠছেন সেই সময় প্রবাহ মোটেই সাদাসিধে সরল ছিল না , পরাধীন দেশ , বিশ্বযুদ্ধ , ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন , মন্বন্তর মহামারি , গণমানুষের আর্তনাদের সঙ্গে জীবনানন্দের কর্মজীবনের ব্যর্থতার সংযোগ জীবনানন্দ ক্রমশঃ নিরানন্দ মননের অধিকারী করে তুলছিল । আসলে ধ্বংসের পিরামিডে আরোহণ করে সুখের স্বর্গ রচনা করা বেশ কঠিন , অবশ্য সময়কে অস্বীকার করে অনেকেই সন্ধ্যাতারা পেড়ে প্রেমিকার খোঁপায় গুঁজে দেন , জীবনানন্দ তাঁদের দলভুক্ত নন , তিনি নজরুলের মত সরাসরি বিদ্রোহী হুঙ্কার দেননি হয়তো , তবুও দৃঢ়কণ্ঠে সমস্ত নোংরামি ভন্ডামির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন অনন্য ভাষা ও উপমার সহচর্যে । 

কবি হেঁটেছেন অনন্তকাল পৃথিবীর পথ ধরে , ক্লান্ত হয়েছেন , ক্লান্তি আসবারই কথা , এই পৃথিবী কোনকালেই মানুষের বাসযোগ্য ছিল না , একটা রক্তচক্ষু বরাবরই স্বাধীন সম্প্রীতি সৌহার্দ্যপূর্ণ চিন্তন ও মননকে দমন করেছে । গ্যালিলিও , কোপারনিকস বলি হয়েছেন অন্ধত্বের , হিটলার , মুসোলিনীরা বারে বারে ফিরে এসেছে নানা যুগে , নানা রুপে ফলে ক্লান্তি তো আসবেই । কবি ক্লান্ত হয়েছেন , জীবন ধূসর হয়েছে , তা থেকে মুক্তির পথও তিনি খুঁজেছেন নিজস্ব ভঙ্গিমায় । ঈশ্বরের কৃপা তিনি চাননি , তাঁর মানস ঈশ্বর বনলতা , সূচেতনা , সুরঞ্জনা নামীয় আরও বেশ কয়েকজন নারীমুর্ত্তি । জীবনানন্দ তাঁদের কাছেই চেয়েছেন মুক্তির এক পৃথিবী নিশ্বাস আর দুদন্ডের শান্তি । 

রবীন্দ্রনুসারী কবিদের মেকি দর্শন জীবনানন্দকে প্রলুব্ধ করতে পারেনি , যতীন্দ্র সেনগুপ্তের নেতীমূলক জীবন দর্শন তাঁর কাছে আদরনীয় নয় , প্রেমেন্দ্র মিত্রের মত আলাদা করে তাঁকে বলতেই হয়নি , ' আমি কবি যত ইতরের ' । একটা যুগযন্ত্রণা জাত বোধই গঠন করে দিয়েছে তাঁর কাব্যের শরীর , ' মড়ার খুলির মত ধরে / আছাড় মারিতে চাই , জীবন্ত মাথার মত ঘোরে । তবু সে মাথার চারিপাশে ' । যাঁর হৃদয় এমন নির্মাণ দ্বারা পরিব্যপ্ত তিনি কেমন করে রবীন্দ্রনুকারে ভাবকবি হবেন ? তিনি যে স্বতন্ত্র এবং অন্যভাবের কাব্যকলায় মগ্ন হবেন সেটায় তো স্বাভাবিক । 

জীবনানন্দ দাশ রবীন্দ্রউত্তর কালের শ্রেষ্ঠতম কাব্যপুরোহিত শুধু নন , তিনি বাংলা কাব্যের পথপ্রদর্শকও বটে । প্রথম কাব্য '  ঝরা পালক ' (১৯২৭) এ তেমন বিশিষ্ট স্বতন্ত্র কাব্যস্বর গড়ে না উঠলেও ' ধূসর পাণ্ডুলিপি ' (১৯৩৬) , বনলতা সেন (১৯৪২) , ' মহাপৃথিবী ' (১৯৪৪) , ' সাতটি তারার তিমির ' (১৯৪৮) , ' রূপসী বাংলা ' (১৯৫৭) প্রভৃতি কাব্যে জীবনানন্দের নিজস্ব স্বর ও মনন গঠিত হয়েছে । যা থেকে একটু ভিন্নতর কাব্য আস্বাদ , বাকরীতির স্বতন্ত্রতা অনুভব   করলেন । কবি জীবনানন্দ দাশ ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক , বিশ্বসাহিত্য বিশেষত ইংরেজি সাহিত্যের সাথে তাঁর গভীর আত্মযোগ ছিল । এই বিশ্বকাব্য যোগই তাঁর আধুনিক কাব্য মননের নেপথ্যের শক্তি হিসাবে সক্রিয় ছিল । তবে তিনি ঐতিহ্য বিরোধী ছিলেন না , অন্য সকল কবিমানুষের মত তিনি রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করেননি , আসলে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করে কাব্যশরীর গঠন করা বোধহয় সম্ভব নয় । রবীন্দ্র কাব্যের মধ্যে তাঁর গভীর নির্ভরতা ছিল । 

জীবনানন্দের কাব্যকলায় ইতিহাসচেতনা , সময়বোধ , ভৌগোলিক মানচিত্র জ্ঞান প্রধান অবলম্বন হিসাবে বিধৃত থেকেছে । এই অনন্য বোধই জীবনানন্দকে রবীন্দ্র যুগেও বিশিষ্টতা দিয়েছে । সময়ের অন্ধগলিতে তিনি যেমন ঘুরে বেরিয়েছেন , তেমনি ছুটে গেছেন অতীতের রাজপথ থেকে পল্লীপথে । অতীত ও বর্তমানকে তিনি বিচার করেছেন এক হাঁড়িতেই , এই কাজটি জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে পেয়ে থাকতে পারেন , তবে রবীন্দ্রদর্শনের থেকে জীবনানন্দের ভাবনার আকর স্বতন্ত্রতাই উজ্জ্বল । ' কবিতার কথা ' নামক গ্রন্থে কবি কাব্যকলায় কেন ইতিহাসকে অবলম্বন করলেন সে প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন , ' কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার , কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান । ' প্রায় একই উচ্চারণ দেখি , টি .এস এলিয়টের ' The Tradition and the individual Talent ' গ্রন্থে । 


জীবনানন্দের কবিতায় এক ধরনের অন্ধকার কুন্ডলি আকারে বর্তমান থেকেছে প্রায় প্রথম থেকেই । অন্ধকার যেহেতু মৃত্যুর সমগোত্রীয় , ফলে মৃত্যু চেতনাও জীবনানন্দের কবিতায় ব্যঞ্জক আকার নিয়েছে । প্রসঙ্গক্রমে ' ধূসর পাণ্ডুলিপির ' কয়েকটি কবিতার কথা মনে পড়ছে । এই সমস্ত কবিতা পাঠক অন্তলীন আবেগ , নির্জনতার আস্বাদ এবং অনন্য কাব্যময় শব্দ অনুভব করবেন । কাব্য রচনার সময় কবি জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথের সন্ধ্যা সংগীতের নিঃসঙ্গতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারেন । ' হাওয়ার রাত , ' কবিতাটিতে লক্ষ তারার মাঝেও কবি নিজেকে নিঃসঙ্গ অনুভব করেছেন । ইংরেজ কবিরা একে বলেছেন , ' Romantic Melancholy ' । 

জীবনানন্দ প্রেমের কবি । প্রেমই তাঁর জীবনের অবলম্বন হতে পারতো । দুঃখের প্রেমময় হয়নি তাঁর জীবনের গল্প । স্ত্রী লাবণ্য দাশগুপ্তের সঙ্গে কবির তেমন সদ্ভাব ছিল না । কবির জীবন অর্থনুকুল ছিল না , বার বার চাকরি হারানোর যন্ত্রণা তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করেছে । স্ত্রী ও কন্যার দায়িত্ব তিনি নিতে পারেননি , অনেক সময় দাম্পত্য কলহ কবিকে কষ্ট দিয়েছে । জীবনানন্দ গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ কবির ডায়েরিতে কবির বিবাহ পূর্বকালীন প্রেমের কথা লিখেছেন । অতুলচন্দ্র নামীয় কোন এক খুড়তুতো কাকার মেয়েকে ভালবাসতেন যুবক জীবনানন্দ । সেখানেও ব্যর্থ হয়েছেন কবি । কিছুই পাননি কবি , বিধাতা যেন ব্যক্তি জীবনানন্দের জীবনে ব্যর্থতার স্ট্যাম্প মেরে পাঠিয়েছিলেন । কবি লিখলেন , ' আমারে যে ভালোবাসিয়াছে , আসিয়াছে কাছে / উপেক্ষা সে করেছে আমারে /ঘৃণা করে চলে গেছে - যখন ডেকেছি বারে বারে / ভালোবেসে তারে । ' এই বিরহ কবি ভুলতে পারেননি , পরে স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ' বনলতা সেনের ' কাছে কবি দুদন্ডের শান্তি ভিক্ষা করেছেন । 

জীবনানন্দ জীবনের কবি । কেবল নিকষ কালো অন্ধকারকেই তিনি ব্যঞ্জিত করেননি , আশার আলোও দেখিয়েছেন । সুচেতনা কবিতায় জীবনানন্দ লিখলেন , ' সুচেতনা এই পথে আলো জ্বেলে - এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে /.........................................
আমাদের মতো ক্লান্ত ক্লান্তিহীন নাবিকের হাতে 
গড়ে দেবো , আজ নয় , ঢের দূর অন্তিম প্রভাতে । ' 
অন্ধকার কবির কাব্যলয়ের অনন্য সত্তা হলেও অন্ধকার উত্তর সূর্যকিরণের আস্বাদও জীবনানন্দে অপ্রতুল নয় । 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।