প্রণাম নিন , কবি কাজী নজরুল ইসলাম সমীপেষু , আপনি হুজুগ কেটে যাওয়ার পরও ভীষণ রকম বেঁচে আছেন , বাঙালির হৃদয়ে ॥ আলোচনা করছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

কাজী নজরুল ইসলাম
 সমীপেষু । 


' পরোয়া করি না , বাঁচি বা না বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে / মাথার উপর জ্বলিছেন রবি , রয়েছে সোনার শত ছেলে ! / প্রাথনা করো - যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মানুষের মুখের গ্রাস / যেন লেখা হয় , আমার রক্ত - লেখায় তাদের সর্বনাশ । ' 

চরণবদ্ধ কাব্যপদটি কার লেখা ? না বললেও পাঠক সমীপেষুগণের খুব একটা অসুবিধা হবে বলে মনে করি না । চরণসমূহের অন্তদেশ থেকে যে মুখোশ উন্মোচনের বিদ্রোহ প্রকট হয়ে পড়ছে , তা একমাত্র কাজী নজরুল ইসলাম মহোদয়ের কাব্যশরীরী গঠনের কথায় হৃদয়জাত হয় । পাঠক , প্রথম চরণটি নিশ্চয় আপনাদের নজর এড়ায়নি , কবি লিখছেন , ' পরোয়া করি না , বাঁচি বা না বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে' , কবিবর নিজেই উপলব্ধি করতে পারছেন , ভাব -ই প্রজন্মের কাছে হয়তো তিনি তেমন একটা আদরনীয় হবেন না । এর নেপথ্যে হয়তো তিনি ভেবেছেন , তিনি মূলত তাঁর সমকালকেই কাব্য শরীরে লেপ্টে দিয়েছেন , অন্য অনেকেই যখন সন্ধ্যাতারা পেড়ে গুঁজে দিচ্ছেন প্রেমিকার খোঁপায় , সেই কালপর্বে তিনি লিখছেন , ' কারার ওই লৌহকপাট , ভেঙে ফেল কররে লোপাট । ' তাঁর চিন্তা অমূলক না হলেও , কাজী সাহেবের কাব্য কিন্তু যুগউর্ত্তীণ হতে সক্ষম হয়েছে । আসলে , সর্বদেশের একটা একক স্বস্বাধীনতা আন্দোলন রয়েছে , সেই আন্দোলনের অমর গাঁথা কিন্তু অমলিন , তা শাশ্বত , একই সঙ্গে চিরন্তনও বটে । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন লিখেছিলেন , ' আজি হতে শতবর্ষ পরে , কে তুমি পড়িতেছ আমার কবিতাখানি । ' না , কবিবর নজরুলের এমন সৎসাহস বোধহয় ছিল না , তিনি কখনও ভাবতেনও না , যুগ অতিক্রম করবার কথা । তিনি মূলত , সময়ের দাবির মাথা নত করা , একজন বিদ্রোহী নায়ক , মানবিকতার এক মহান পুরোহিত । 

কাজী নজরুল সমীপেষু , যে সময় পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেড়াচ্ছেন , সে সময়টি মোটেও সুবিধার নয় । দেশ পরাধীন , ইংরেজ তখন পরাক্রমশালী শক্তি । পুরো পৃথিবীময় তাঁদের দাপট । ভারতীয় সাধারণ গণমানবের বেঁচে থাকার ন্যূনতম দাবিগুলোও তাঁরা কর্ণপাত করেন না । একদিকে মহাত্মা গান্ধীর নরমনীতি , অন্যদিকে বিপ্লবীদে সহিংস্র আন্দোলন পৌঁছে গেছে দেশের গলি মহল্লায় । নজরুল মূলত চরমপন্থী মতাদর্শের প্রতি আস্থাশীল ছিল । যে কোন অন্যায়ের বিরুপেই তিনি যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিতেন , অকুতভয় তিনি , এক আপোষহীন যোদ্ধা । কবি লিখলেন , একের পর এক বিপ্লব গাঁথা । প্রিয় দেশ নেতা সুভাষ চন্দ্র বললেন , আমরা যখন যুদ্ধে যাবো , তখন নজরুলের গান গাইব । নজরুলের কবিতা , গান , নাটক সব জায়গাতেই ছিল এমন বিদ্রোহী হুঙ্কার । ' বিদ্রোহী ' কবিতায় যে আগুন গাঁথা কুন্ডলি পাকালেন কবি , তা কবি নজরুলের বিপ্লবী মনকেই চাক্ষুস করায় । 

জীবন ও কাব্যে সব জায়গাতেই তিনি বিদ্রোহী মননজাত ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন । ইংরেজ সরকারের দমন পীড়ন তাঁকে কখনই দমাতে পারেনি । নজরুল লিখেই চলেছেন , মহা বিপ্লব গাঁথা । দেবী দূর্গাকে আহ্বান করে তিনি লিখলেন , 
' দেবশিশুদের মারছে চাবুক , বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি / ভূ - ভারত আজ কসাইখানা , - আসবি কখন সর্বনাশী ? / দেব - সেনা আজ টানছে ঘানি তেপান্তরের দ্বীপান্তরে / রণাঙ্গনে নামবে কে আর তুই না এলে কৃপাণ ধরে ? ' 
কবিতাটি (আনন্দময়ীর আগমনে ) লিখবার অপরাধে কবি কাজীর এক বছরের কারাবাস জুটলো । ভারতীয় জেলবন্দিদের উপর ইংরেজরা কখনই সদয় ছিল না । নানা রকমের পীড়ন এবং নির্যাতনের শিকার হতেন তাঁরা । কাজী নজরুল তো সাধারণ জেলবন্দি নন , যাঁর জীবনই এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ , তিনি কেন সইবেন , এহেন অপমান ? আমরণ অনশনে বসলেন কবি কাজী । সারা দেশ জুড়ে প্রবল আলোড়ন উঠল । এল গুরু রবীন্দ্রনাথের সেই ঐতিহাসিক বার্তা ' Give up Hunger Strike . our literature claims you .' সঙ্গে পাঠালেন ' বসন্ত ' গীতিনাট্য খানি । অবশেষে ১৯২৩ সালে অনশন প্রত্যাহার করেন কাজী নজরুল । পরে , বাঙালি বিপ্লবী যতীন দাশ অনশনরত অবস্থায় লাহোর জেলে ১৯২৯ সালের ১৩ সেপ্টম্বর মৃত্যুবরণের ঘটনা , নজরুল ইসলাম সমীপেষুকে আলোড়িত করে । কবিবর যতীন দাশ স্মরণ করে লিখলেন , ' যতীন দাস ' নাম কবিতা । 

কাজী কবি মূলত মানবতাবাদী , তাঁর চরিত্রের এই বৈশিষ্টই তাঁকে ইংরেজ বিরোধী করে তোলে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন , প্রশ্ন উঠতেই পারে , প্রবল ইংরেজ বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও কবি কেন , ইংরেজ সেনাদলে নাম লেখালেন ? এ নেপথ্যে অবশ্য কবির এক দুরভিসন্ধি ছিল । ইংরেজ রণকৌশল আয়ত্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি । পরবর্তীতে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার মানসে । শুধু স্বজাতির মুক্তির কামনায় তাঁর চিন্তা চেতনা মগ্ন ছিল এমনটি নয় , পৃথিবীর সব নিপীড়িত জাতি ও মানুষের জন্য তাঁর ভালোবাসা ছিল । তুরষ্কের জননেতা কামাল পাশার বিজয়কে কবি সত্যের জয় হিসাবে দেখলেন , লিখলেন ' কামাল পাশা ' নাম কবিতা । 

নজরুল ইসলামের কবিতার পুরো শরীর জুড়ে রয়েছে মানুষের জয়গান , মানব মুক্তির আহ্বান । অসহায় , অবহেলিত , নিপীড়িত সব গণমানুষই তাঁর আপনজন । ধর্ম তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয় , ধর্মীয় গোঁড়ামিকে তিনি মন থেকেই ঘৃণা করেন । ক্ষুধাতুর মানুষের তুচ্ছ জীবনের বিপ্লবী রুপকার তিনি । ধর্মের বেড়া তাই বাঁধতে পারেনি তাঁকে । 
' হায় রে ভজনালয় , 
তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয় ! 
মানুষেরে ঘৃণা করি 
ও ' কারা কোরাণ , বেদ , বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি ! 
.............
পুজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল ! - মূর্খরা সব শোনো 
মানুষ এনেছে গ্রন্থ , - গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন ! ' 

যেখানেই মানুষের উপর অন্যায় হয়েছে , মানুষ কষ্ট পেয়েছেন , সেখানেই অত্যাচারি যতই শক্তিশালী হোক না , কবিবর নজরুল ফেটে পড়েছেন বিদ্রোহী আস্ফালনে । প্রণাম নিন ,   নজরুল সমীপেষু , আপনি হুজুগ কেটে যাওয়ার পর ভীষণ রকম বেঁচে আছেন , বাঙালির হৃদয়ে ॥ 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।