মধুসূদনের বাংলা সাহিত্য চর্চা বাংলা সাহিত্যের জন্য কল্যাণবহ হয়েছিল । আলোচনা করছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।


মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত । 
মনীষী বিদ্যাসাগর কোচবিহারের মহারাজের কাছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের চাকরির সুপারিশ করেছিলেন । সুপারিশ পত্রে দয়ার সাগর লিখেছিলেন , ' একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ পাঠাইলাম , দেখিও যেন ইহা বাতাসে উড়িয়া না যায় । ' বাঙালির শ্রেষ্ঠতম শিক্ষাগুরু মনীষী বিদ্যাসাগর একটুও বাড়িয়ে বলেননি , মহাকবি মাইকেল মধুসূদন অগ্নিস্ফুলিঙ্গই বটে । প্রথম দিকে কীটস , শেলী প্রমুখ ইংরেজ কবিদের মতো বিশ্বকবি হওয়ার বাসনা ছিল তাঁর , ছাত্রজীবনেই তিনি বলতেন , ' I happen to be A great poet , which I am almost sure I shall be ' , জীবনের প্রথম প্রহরে তাই মাতৃভাষা চর্চা তাঁর কাছে নিন্মগোত্রীয় বলে মনে হয়েছিল । ইংরেজি সাহিত্য সাধনায় নিজেকে পুরোপুরি নিমজ্জিতও করেছিলেন , কিন্তু আক্ষেপের বিষয় , ইংরেজ সমাজ একজন নেটিভ কবির ইংরেজি কাব্য চর্চাকে মন থেকে মেনে নেননি । 

মধুসূদন দত্তের বাংলা সাহিত্য চর্চার প্রাক সময়ে সংস্কৃত ও ইংরেজি অনুবাদ মূলক নাটকের বেশ রমরমা ছিল । একাধিক রঙ্গমঞ্চ গঠনের মধ্য দিয়ে নাট্যমোদী দর্শককুল বিনোদন অনুভব করছিলেন । মৌলিক নাটক রচনার মত দক্ষতা সম্পূর্ণ নাট্যকারের বেশ অভাব ছিল সেই সময় পর্বে । পাইক পাড়ার রাজা ঈশ্বরচন্দ্র প্রতিষ্টিত বেলগাছিয়া নাট্যশালার বিশেষ অবদান রয়েছে বাংলা সাহিত্যের সাবালকত্বয়ানে , রামনারায়ণ তর্কালঙ্কারের নাটক ' রত্নাবলী ' অভিনয়ের জন্য তখন প্রস্তুতি চলছিল , নাটকটির শরীরী গঠন , ভাষার প্রাচীনত্ব , উপস্থাপন গুণ পছন্দ হয়নি মধুসূদন দত্তের । তাঁর মনে হয়েছিল , নাটকটি বড্ড সেকেলে । বন্ধু গৌড়দাস বসাক মধুসূদনকে বাংলা নাট্য জগতে প্রতিভাবান নাট্যকারের অভাব সম্পর্কীত বিষয়ে ওয়াকিবহাল করান । তখন মধুসূদন দত্ত নাটক লেখার প্রস্তাব দেন । প্রথম দিকে বন্ধু গৌড়দাস মধুসূদনকে আমল দেননি , নেপথ্যে যথেষ্ট কারণও ছিল , মধুকবি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের মহাপন্ডিত একথা তাঁর পরম বিরুদ্ধ সমালোচকও স্বীকার করবেন , গৌড়দাসের থেকে এই বিষয়ে উত্তম আর কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয় । এই মহৎ গুণ থাকা সত্ত্বেও , মধুসূদন পূর্বে কখনও বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেননি , এইখানে আশঙ্কা ছিল গৌড়দাসের । কিন্তু যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর মধুকবির বিষ্ময়কর প্রতিভার উপর আস্থা প্রকাশ করেন । তিনি গৌড়দাস বসাককে এক পত্রে লেখেন , ইংরেজি সাহিত্যে যাঁর এমন ভয়ঙ্কর পাণ্ডিত্য , তিনি বাংলা ভাষা চর্চা করলে নিঃসন্দেহে বাঙালি পাঠক উপকৃত হবেন , সমৃদ্ধ হবে মাতৃভাষা । 

মধুসূদন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য দিকবলয়ই পরিবর্তন করে দিলেন । এতদিন যেখানে অনূদিত সাহিত্য সম্ভার দিয়েই চলছিল কাব্য সাহিত্যের মহৎ কর্ম , সেই জায়গাতে মক্ষম আঘাত করলেন তিনি । মৌলিক সাহিত্য  রচনা করা এমন কোন দুঃসাধ্যময় কর্ম নয় , সেটা তিনি প্রমাণ করলেন ১৮৫৯ সালে শর্মিষ্ঠা নাটক প্রণয়নের মধ্য দিয়ে । নাটকটি ব্যপক জনপ্রিয় এবং মঞ্চসফল হয়েছিল । এই অভূতপূর্ব সাফল্য বিষয়ে মহাকবি মধুসূদন বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে এক চিঠিতে লেখেন , ' Should be drama ever again flourish in India posterity will not forget these noble gentlemen , the artist friends of our rising national theatre . ' মধুসূদন নিজ নাটক সম্পর্কে যে মোটেই বাড়িয়ে বলেননি তার প্রমাণ মেলে যতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গৌড়দাস বসাককে লেখা পত্রে । সেই পত্রে যতীন্দ্রনাথ লিখলেন , ' The representation of the drama of Sharmishtha has come off gloriously .Night before last was the sixth of last night of its performances . ' ইংরেজ কবি হওয়ার বাসনায় ছুটে বেড়ানো মধু কবির প্রথম নাটকের অভিনয় সাফল্য তাঁকে স্বস্তি দিয়েছিল , তিনি উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন । হওয়ারই কথা , বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে লেখা চিঠিতে মধুসূদনের উচ্ছ্বাস ধরা পরে , তিনি লিখলেন , ' This Sharmishtha has very neatly put me at the head of all Bengali writers . people talk of its poetry with rapture . ' 

মধুসূদনের বাংলা সাহিত্য চর্চা বাংলা সাহিত্যের জন্য কল্যাণবহ হয়েছিল । মধুসূদন বিশ্বসাহিত্য বিশেষত ইংরেজি সাহিত্যের এক দিকগজ পন্ডিত হওয়ার অভিজ্ঞানই বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে নতুন অক্সিজেন সঞ্চারের কাজ করেছিল । ' মেঘনাদ কাব্য ' ভূমিকা অংশে সমালোচক মহান চক্রবর্তী ভয়ঙ্কর সুন্দর কিছু কথা লিখেছেন , ' মধুসূদন রেনেসাঁসের যজ্ঞকুণ্ড থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন বলেই তার মধ্যে এই যন্ত্রণাবোধ আরো তীব্র , আরো গভীরতর , আরো ঘন । এ যুগের জয়সিংহ মধুসূদন , যাঁর একদিকে লালনকর্তা অতীত সংষ্কার রঘুপতি , অন্যদিকে নবীন মানবতাবাদের প্রতীক গোবিন্দমানিক্য । জয়সিংহকে এ যুগের অস্থিরতার শিকার হতে হয়েছিল , হৃদপিন্ড ছিন্ন করে রক্তপদ্ম অর্ঘ্য উপহারে এ যুগের দেনা মেটাতে হয়েছিল , তেমনি মধুসূদনকেও এ যুগের দেনা মেটাতে হয়েছিল , জীবন সাগর মন্থন করে বিষামৃতকে তুলে আনতে হয়েছিল , কিন্তু বিষের জ্বালায় তিনি নীলকণ্ঠ হয়েছিলেন । যুগের সমস্ত বেদনা বাসনা , স্বপ্ন - ব্যর্থতাকে নিজের মধ্যে গ্রহন করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন যুগন্ধর । ' (মেঘনাদবধ কাব্য ' ভূমিকা অংশ , ১৩৭৭ , পৃষ্টা -৩১ )

মধুসূদনের বাংলা ভাষায় কাব্য ও নাটক চর্চার ফলে বাংলা সাহিত্য যথার্থ দিশা পেয়েছিল । মহাকবির জাদুর স্পর্শেই যুগান্তর আসে বাংলা সাহিত্যে । যা এক আধুনিক ভাব ও মননের সঞ্চার করেছিল অন্যদের মধ্যে । সমালোচক মনি বাগচী মধুসূদনের আবির্ভাব প্রসঙ্গে যথার্থই লিখেছেন , ' এলো সে বাংলার শ্যামল মাটিতে - কপোতাক্ষ নদের তীরে , সাগর দাঁড়ি গ্রামে । কী দাহ সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গের ! সে দাহ মহতী কামনার দাহ - এক বিপ্লবী চিত্তের যন্ত্রণাদাহ । দেহ তাঁকে ধারণ করতে পারেনি । জীবনে নিস্ফল , কিন্তু কাব্যলোকে অমর । ' একেবারেই যথার্থই বলেছেন সমালোচক । ব্যক্তি জীবনে , মানুষ মধুসূদনের অনেক চরিত্রদোষ ছিল । অমিতব্যয়ি , মদ্যপান , নারী সঙ্গ তাঁকে নিঃস্ব করেছে । বলতে গেলে সোনার চামচ মুখে নিয়েই তাঁর জন্ম , যুবক বয়সে সাহেব হওয়ার প্রলোভন তিনি ত্যাগ করতে পারেননি । সেই প্রবল বাসনা পূরন করবার অভিলাষেই ত্যাগ করলেন স্বধর্ম । পিতা রাজনারায়ণ পুত্রের এ অপরাধ মার্জনা করেননি , তাঁকে ত্যাজ্য করলেন । এই পর্বে এসে ভয়ঙ্কর সমস্যার মুখোমুখি হলেন তিনি । সব রকম চেষ্টা করেও জীবনানন্দ দাশের মত কর্ম জীবনে তেমন কিছু অনুভব অর্জন করতে সক্ষম হলেন না । জীবনে তিনি ব্যর্থ হলেন সত্য , তবুও সাহিত্য কর্মের মধ্যে চিরন্তন শাশ্বত ভাবে অমর থাকলেন । বাংলা সাহিত্যের পরম লাভ হল , সাহিত্যের দিকবলয়ই পাল্টে গেল । মধ্যযুগীয় কচকচানির পরিবর্তে এক আধুনিক যুগের সঞ্চার হল মধুকবির পবিত্র হাতে । যে ধারাকে পরবর্তীকালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন বিশ্বদরবারে । 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।