বিরোধিতার উপর ভর করে , প্যরোডি বা ব্যঙ্গ কবিতার এক অদ্ভূত জগাখিচুড়ি পাকাতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন পত্রিকার লেখকগণ । লিখেছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।
শনিবারের চিঠি ' সাময়িকপত্র বাংলা সাহিত্যের এক বিশিষ্ট সংযোজন । ২৬ শে জুলাই , ১৯২৪ ইংরেজি , বাংলা ১০ ই শ্রাবণ ১৩৩১ খৃঃ পত্রিকাটির পথ চলা শুরু হয় । পরে , সাল ১৩৩৪ এর ৯ ই ভাদ্র নবপর্যায়ে পত্রিকাটি মাসিক সাহিত্য পত্র রুপে প্রকাশিত হতে থাকে । পত্রিকাটির সম্পাদক নীরদ চন্দ্র চৌধুরী হলেও , এর মূল পরিচালক ছিলেন সজনীকান্ত দাশ ।পত্রিকাটির কোন বিশেষ আদর্শ ছিল না কিম্বা কোন মহৎ উদ্দেশ্যমুখীও ছিল না এর গতিপথ । মূলত , বিরোধিতার উপর ভর করে , প্যরোডি বা ব্যঙ্গ কবিতার এক অদ্ভূত জগাখিচুড়ি পাকাতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন পত্রিকার লেখকগণ । সমকালীন প্রতিভাধর কবি মানুষদের টার্গেট করতো শনিবারের চিঠি , পরবর্তীতে তাঁর রচনার ব্যঙ্গ প্যরোডি কবিতা রচনা করে , সেই কবি আত্মার কবিত্ব হরণ করবার অপচেষ্টায় শনিবার গোষ্টি ব্যাপিত হতেন । যদিও , বলে নেওয়া উত্তম শনিবারের সজনীরা যে সকল মহাজীবনের পথ রুদ্ধ করবার চেষ্টা করেছিলেন , তাতে তাঁরা বিন্দুমাত্র সফলতা অর্জন করতে পারেননি , বরং এই বিরোধিতায় তাঁদের কবিত্বশক্তিকে আরও বলিষ্ঠ করে তুলেছিল । এই জায়গাতেই সজনীকান্তরা কিছুটা হলেও বাংলা সাহিত্যে অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন ।
আসলে , মহৎ কোন আদর্শের বশবর্তী হননি শনিবারপন্থীরা । অন্যান্য সাহিত্য পত্রিকা ও সাহিত্য সাধকদের বিরোধীতা করার মধ্যেই তাঁরা আনন্দ খুঁজতেন । কাজী নজরুল ইসলাম সমীপেষু , জীবনানন্দ দাশ , চিত্তরঞ্জন দাশ , মানিক বন্দোপাধ্যায় , এঁদের বিরোধিতার শিকার কবিবর ও কথক তালিকা বড্ড দীর্ঘ । ' বিদ্রোহী ' কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২১ সালে , কবি কাজী তখন অপেক্ষাকৃত তরুণ । বাংলা সাহিত্যের এই মহতী কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর কাজী নজরুল ইসলাম শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠায় পেলেন না , সাথে পেলেন চিরবিদ্রোহী তকমা । বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে সারা বাংলার বাঙালি পাঠক যখন নজরুলে মুগ্ধ , তখন সজনীকন্তের নেতৃত্বে একদল অকালপক্ক কবি নামের অকবি নজরুল বিরোধিতায় উঠে পরে লাগলেন । তাঁরা নজরুলের অমর বিখ্যাত কবিতা ' বিদ্রোহী 'র প্যরোডি কবিতা লিখলেন , নাম দিলেন ' ব্যাঙ ' । কবিতার একটি চরণ এমন ,
' আমি ব্যাঙ ,
আমার লম্বা লম্বা ঠ্যাং । '
শনিবারীদের অত্যাচরে হয়তো কষ্ট পেয়েছিলেন নজরুল , তবুও এই বিরোধিতায় তাঁকে বাংলার দ্বিতীয় জনপ্রিয়তম কবিতে উন্নীতকরণ ঘটাতে সহায়তা করেছিল , এ বিষয়টি নিঃসন্দেহতীত ভাবে বলা যায় ।
কবি জীবনানন্দ দাশ , রবীন্দ্রউত্তর বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি কণ্ঠ । কবি জীবনানন্দও সজনীকান্ত দাশের প্রবল বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছিলেন । এই সমস্ত বিরোধীতার জন্যই হয়তো কবি তাঁর জীবদ্দশায় মাত্র ১৬৭ টি কবিতা প্রকাশিত হতে দিয়েছিলেন । দীর্ঘজীবন তিনি কবিতা লিখেছেন , গল্প লিখেছেন , উপন্যাস লিখেছেন কিন্তু প্রকাশ করবার চেষ্টা মাত্র করেননি , বাক্স বন্দি করে রেখেছিলেন , ভাবিকালের পাঠকদের জন্য । এর নেপথ্যে অবশ্যই , এই সকল প্রবল বিরোধিতা কারণ হতে পারে । ব্যক্তিজীবন ,কর্মজীবন প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ব্যর্থ জীবনানন্দ কবি জীবনের এই বিরোধিতা মেনে নিতে পারেননি । শনিবারের চিঠি ব্যঙ্গের শিকার হয়েছেন এমন আরও অনেকেই ।
পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যায় পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্যের কথা বলতে গিয়ে পত্রিকার প্রাবন্ধিক লেখক অশোক চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন , ' উপায়ের ক্ষেত্রে আমরা মুগুরকে হাতছড়ির উপরে জায়গা দেব , চাবুককে চাপড়ের চেয়ে বড় বলেই ধরবো । ' শনিবারের চিঠি , ' তার দীর্ঘ প্রকাশনার কাল পর্যন্ত চাবুককে চাপড়ের অধিক জ্ঞানই করেছে । তবে , শুধু এতেই তাঁরা শান্ত হয়নি , সন্তষ্ট হয়নি , পরবর্তীতে কাতুকুতু বা সুড়সুড়ি দেওয়ার লোভ তাঁরা ছাড়তে পারেননি । যায়হোক , সমাজিক দায়িত্ব এড়িয়ে , সমাজ বাস্তবতার চিত্র অঙ্কনের পরিবর্তে ব্যঙ্গ , প্যরোডি , কদর্যতাকে পাখির চোখ করে সজনীকান্ত সদলবলে এবং শনিবারের চিঠি বাংলা সাহিত্যে তাঁদের আসন পাকা করতে সক্ষম হয়েছেন , একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই ॥
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন