লকডাউনে বন্ধ সবজি হাট ! কৃষিজ ফসল নিয়ে উদ্বিগ্ন কৃষক সমাজ ।
গ্রামীণ সমাজের মানুষ হওয়ার অভিজ্ঞান থেকেই ' ভারতবর্ষ 'কে খুব ভালো করে চিনতে শিখেছি । যাঁরা শুধুমাত্র শহুরে রাস্তার আলোক ঝলকানিকে দেশ বোঝেন , তাঁরা ভারতবর্ষের আসল রুপ দেখেননি বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না । গ্রামের মাঠ ঘাট , নদী নালা , পশুপাখির ঐক্যতান ব্যতীত দেশের আসল রুপ কখনই ভাস্বর হতে পারে না , এ কথা জোর দিয়ে বলতে গবেষণার ছাত্র হওয়ার দরকার নেই । গ্রামীণ ভারতের কথা বলতে গেলেই মাঠভরা সবুজের ছয়লাপ ধানজমি , সরষে খেতের হলুদ ফুল বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে প্রকৃতিক সৌন্দর্যের কাছে নত মস্তক হওয়া , দুই মানুষ সমান পাটখেতের মধ্যে লুকোচুরি খেলবার আস্বাদ , রহিম চাচার পান্তাভাত থেকে শুকনো লঙ্কা নিয়ে সোনা বাগদীর পান্তা খাওয়া । একটি দেশের মধ্যে এ যেন আলাদা আরও একটা স্বদেশ , এখানে আলোর ঝলকানি নেই , আছে কৃষক বাবার মাটি মাখা বুকে সন্তানকে জড়িয়ে ধরার ঈশ্বরিক প্রশান্তি ।
গ্রামীণ সমাজের এই প্রশান্তময় চিত্ররুপের আদলগত কিছুটা বদল লক্ষ্য করা যাচ্ছে । নব্যপ্রজন্ম যাঁরা কৃষক বাবার প্রতিনিধি হিসাবে উত্তরাধিকার বহন করার তাগিদে হালের বলদ নিয়ে ছুটবেন মাঠে , সেই নতুন প্রজন্মের যুবকদের মধ্যে কিন্তু পিতার পেশায় আসবার কোনরকম কৌতুহল দেখা যাচ্ছে না । কৃষক পরিবারের নব যুবকগণ কোন স্বাধীন ব্যবসা , চাকরি সরকারি কিম্বা বেসরকারি যায়হোক , আবার এগুলো সম্ভব না হলে সেলাই বা অনন্য ক্ষেত্রের শ্রমের সঙ্গে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করে নিচ্ছেন । এইরুপ অবস্থার নেপথ্যের কারণের গভীরে তলিয়ে যাওয়ার পূর্বে বিষয়খানি ঋজু করে পরিবেশন করা প্রয়োজন । আমার বাবা একজন কৃষক , আমি কৃষক পরিবারের সন্তান , এই পরিচয়টা আমার কাছে অত্যন্ত গর্বের , অহংকারের । শিক্ষকতা ,চিকিৎসা পেশার মতোই কৃষিকাজ একটি পবিত্রতম পেশা । এই দেশ গঠনে আমার বাবার মতো কোটি কোটি কৃষক বাবা প্রতিমূহূর্ত অবদান রাখছেন । জটিলতা বাড়ানো ঠিক হবে না , মূল বিষয়ে আসি । বাবা পিতার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া দশ বারো বিঘা জমি চাষ আবাদ করতেন । কৃষিজমির অঙ্কের দিক থেকে দেখলে জমির পরিমাণ অনেকটা দেখালেও আমাদের সংসার স্বচ্ছল ছিল না কখনই । খাওয়া ও পোশাকের ব্যাপারটা কোন রকমে মিটলেও পড়াশুনার খরচ চালাতে বাবাকে হোঁচট খেতে হতো । মনে পড়ে একবার ,( তখন বেশ ছোট আমি )দাদার পরীক্ষার ফি দেওয়া হয়নি । ফি না দিলে পরীক্ষা দেওয়া হবে না , ফি তো মকুব হওয়ারও প্রশ্ন নেই । বাইরে থেকে গ্রামের মধ্যে বেশ বড়লোক আমরা । মা ব্যঙ্গ করে প্রায় বলতেন , নামে তাল পুকুর , ঘটি ডোবে না । যায়হোক , বাবার কাছে নেই একটাও ফুটো কড়ি । আমার এক কাকা , একটি স্কুলের শিক্ষক , মা হাত পাতলেন তাঁর কাছে । কিছুটা অপমানই তিনি করেছিলেন মাকে । বাইরে থেকে ধার করাও ভালো দেখায় না , আমাদের বাড়ির পাশে একজন বিত্তবান মানুষ ছিলেন , রাতের অন্ধকারে হাতে পায়ে ধরে টাকা এনে মা দাদার পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন । মায়ের একটাই মাত্র কানের রিং ছিল , আমাদের পরীক্ষার ফি দেওয়ার জন্য প্রতিবারই সেটা বন্ধক দিতে হতো ।
ছোটবেলা থেকেই খুব কাছ থেকে কৃষকদের দুঃখ অভাব দেখতে দেখতে বড়ো হয়েছি । ভিতরে ভিতরে কেমন একটা অনুভব তৈরি হয়েছিল , কৃষক বাবার সন্তান হলেও চাষা হবো না । আমার মা'ও কখনও চাননি তাঁর সন্তানরা কৃষক হয়ে তাঁর ও বাবার মতো কষ্ট পাক । বলে রাখা দরকার , কৃষক হতে না চাইলেও ওই পেশা এবং পেশার মানুষদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা রয়েছে । কিন্তু শ্রদ্ধা সম্ভ্রম এসব দিয়ে তো পেট চলে না । আমরা দুই ভাই , কেউই কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত নয় আজ । দাদা স্বাধীন ব্যবসায় এবং আমি শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে বরন করেছি ।
বিশ্বাস করুন , কৃষক সমাজ ভালো নেই আজ । কোন রকম উদরপূর্তিটুকুই হয় । একটা মারাত্মক রোগে পড়লে হাটে মাঠে চাঁদাই ভরসা । অথচ অনেক জমির মালিক হয়ত তিনি । জমি জায়গা নিয়ে করবেন টা কী ? ভাতে দিয়ে খাবেন ? সারা বছর উদয়াস্ত পরিশ্রম করে ফসল ফলান কৃষক , কতটুকু দাম পান তাঁরা ! এই যে পেঁয়াজের দাম এখন আকাশচুম্বী , কৃষকের পেয়াঁজ যখন ওঠে ঘরে তখন কত টাকা দাম থাকে , সেটা সকলেই জানেন - দুটাকা - আড়াই টাকা । বিঘা বিঘা চাষ করেন , অথচ দাম পান না । অনেক কৃষককে দেখেছি , উপড়ান না । গরীবগুর্বারা বস্তা বস্তা নিয়ে যান । আলু সাধারণত সারা বছরই আমাদের চড়া দামে কিনে খেতে হয় , অথচ যখনই কৃষকের আলু ওঠে তখন আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায় আলুর দাম । অনেক কৃষককে মহাজন , গ্রামের দিকে যাদের বলা হয় সুদখোর । এই সুদখোরদের কাছ থেকে সুদে টাকা নিয়ে আলু চাষ করেন , কেন যে করেন ? এই বিষয়টা মাথায় আসা কঠিন , কেননা আলুর দাম কোন বছরেই আশানুরুপ থাকে না , বাবা একটি কথা বলেন প্রায় , চাষা মরে আশায় । কথাটি মিথ্যা নয় একেবারেই । আরও একটি চাষের কথা বলতে হয় , পাট চাষ । একটা সময় পাট ছিল গ্রামীণ কৃষক সমাজের প্রধানতম অর্থকরী ফসল । এককালীন একটা ভালো টাকা পেতেন কৃষকগণ । তবে সে সব এখন অতীত । কৃষক বাবার ছেলে তো , আসুন পাট চাষের লাভের হিসাব দিই , এক বিঘা পাট কাটতে শ্রমিকরা নেয় ছয় হাজার টাকা , পাট ধুতে দুই হাজার টাকার মত খরচ হয় । এই এক বিঘা জমির পাট বিক্রি করলে যদি খুব ভালো পাট হয় , তাহলে দশ হাজার টাকার মত কৃষক হাতে পেতে পারেন । পাট খারাপ হলে অনেকেই পাট কাটেন না । তিনি জানেন লাভ তো হবে না বরং গাঁটের কড়ি যাবে কতগুলো । ধান চাষের গল্পটাও একই । নিজে কাটা , সিদ্ধ করে ভাঙাতে পারলে অল্প কিছু লভ্যাংশ থাকে । এই কম লভ্যাংশের জন্য সরিষা , মূসূর , ধনিয়া , তিল প্রভৃতি একাধিক কৃষিজ দ্রব্যের চাষ প্রায় আর দেখায় যায় না ।
আমাদের দেশে কৃষকরা কোন কালেই ভালো ছিলেন না । আত্মহনন , অভাব , অশান্তি কৃষক নামটির পাশেই লেপ্টে ছিল চিরকাল । কৃষিজ ফসলের দাম কোন কালেই আশানুরুপ ছিল না । কৃষিজ ফসলের দাম না থাকলেও ক্রেতাকে উচ্চহারেই কিনতে হয় । মাঝখানের মধ্যস্বত্বভোগীগণই খান লাভের সবটুকু গুড় । উৎপাদিত ফসলের দাম না থাকায় , কৃষক পরিবারের অর্থভান্ডার সব সময় অর্ধপূর্ণ হয়েই থাকে । অথচ অন্যান্য দ্রব্যদির দাম আকাশছোঁয়া , মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে । ফলে কৃষক পরিবারে হেঁচকীটান লেগে থাকে সারা বছর । নব প্রজন্মের কৃষিজ জমিমুখী না হওয়ার এটাই সবচেয়ে বড় কারণ । তাঁরা সরাসরিই বলছেন , হবে টা কী চাষ করে ? সারা বছর তো হাঁড়িতে বিরাজ করবেন মা ভবানী । মিথ্যা নয় , তাঁদের এই আক্ষেপ । দূর থেকে তাঁদের এই আক্ষেপ অনুধাবন করাও বোধহয় কঠিন । যাঁরা কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত , কৃষক পরিবারের সঙ্গে যুক্ত তাঁরাই একমাত্র বুঝবেন কৃষকদের যন্ত্রণা । আসলে সব কিছু এই দামের বাজারে , কৃষকের ফসলই একমাত্র কমদামি । নব প্রজন্ম তাই কৃষিকাজে আগ্রহ হারালে তাঁদের দোষ দেওয়া খুব একটা যুক্তিযুক্ত ব্যাপার নয় । অবস্থার উন্নতি না হলে আগামী দিন কৃষিসংকটের মুখে পড়তে হবে , একথা বলতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন