নজরুলের কবিতার মত ভয়ঙ্কর হুঙ্কার না থাকলেও সুভাষের কবিতায় রয়েছে বিদ্রোহী মনন এবং ভাবনাজাত অভিজ্ঞান । লিখেছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
' প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা ,
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া । '
নজরুলের কবিতার মত ভয়ঙ্কর হুঙ্কার না থাকলেও সুভাষের কবিতায় রয়েছে বিদ্রোহী মনন এবং ভাবনাজাত অভিজ্ঞান । সুভাষ ' পাথরের ফুল ' কবিতায় লেখেন ,
' ফুল দিয়ে
মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই
ফুলের ওপর কোনদিনই আমার টান নেই
তার চেয়ে আমার পছন্দ
আগুনের ফুলকি -
যা দিয়ে কোনদিন কারো মুখোশ হয় না ।'
মানুষের মুখোশ , নীতিহীন জপমালা , চারপায়ী আচরণ , শাসকের ছলনা , শোষণের হিমালয় প্রতীম নিষ্টুরতা সুভাষকে বিদ্রোহী করে তোলে । সুভাষ লেখেন , '
' মৃত্যুর ভয়ে ভীরু বসে থাকা আর না -
পরো পরো যুদ্ধের সজ্জা । '
১৯১৯ সালে ১২ই ফেব্রুয়ারি নদীয়ার কৃষ্ণনগরে মামার বাড়িতে এই মহান কবি মানুষের জন্ম হয় । পিতা ক্ষিতিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় , জননী যামিনী দেবী । পিতার বদলির চাকরি হওয়ায় কবির শৈশব কেটেছে নানা জায়গায় । কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশান থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন । ছাত্রজীবনেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন । সাম্যবাদী মতাদর্শ ভাবুক সুভাষকে আকৃষ্ট করে । সাল ১৯৩২ - ৩৩ নাগাদ তিনি যুক্ত হন ' বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিশোর ছাত্রদলে । আবার ১৯৩৯ সালে তিনি লেবার পার্টিতে যোগ দেন । সাম্যবাদী ভাবধারার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণ সুভাষ মানুষ মাত্রই সকলের সম অধিকার ভাবনা দ্বারা পরিচালিত ছিল তাঁর জীবন ও দর্শনের গল্পগুলি । সাল ১৯৪২ এ তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন । ১৯৪৬ সালে দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকার সাংবাদিক হিসাবে কর্মজীবনের সূচনা করেন । সাল ১৯৪৮ নাগাদ কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হওয়ায় অনেকের সঙ্গে কবিকেও কারাবরণ করতে হয় । দুই বছর পর ১৯৫০ সালে কবি কারামুক্ত হন । ১৯৫১ সালে ' পরিচয় ' পত্রিকার সম্পাদনার কাজে তিনি ব্যাপিত হন । ওই বছরই তিনি গীতা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । ১৯৬৭ সালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার অপরাধে দ্বিতীয় বারের মত তাঁকে কারাবরণ করতে হয় । ১৯৮১ সালে স্বজীবনের শেষ পর্বে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে তিনি অব্যহতি নেন এবং দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সমর্থক হয়ে ওঠেন ।
কবির প্রধান কাব্যকলা সমূহের মধ্যে উল্লেখ্য , ' পদাতিক ' ১৯৪০ , ' অগ্নিকোন ' ১৯৪৮ ,' চিরকুট ' ১৯৫০ , ' ফুল ফুটুক ' ১৯৫৭ , ' যত দূরে যাই ' ১৯৬২ , ' কাল মধুমাস ' ১৯৬৬ , ' এই ভাই ' ১৯৭১ , ' ছেলে গেছে বনে ' ১৯৭২ , ' একটু পা চালিয়ে ' ১৯৭৯ , ' জল সইতে ' ১৯৮১ , ' চইচই চইচই' ১৯৮৩ ,' বাঘ ডেকেছিল ' ১৯৮৫ , ' যা রে কাগজের নৌকা ' ১৯৮৯ , ' ধর্মের কল ' ১৯৯১ , ইত্যাদি ।
জীবনের প্রথম দিকে কবি সুভাষ সাম্যবাদে বিশ্বাসী ছিলেন । তিনি মনে করতেন কমিউনিজমই পারে সমাজগত বিভেদ বিনষ্ট করতে । ' মানবতা ও দেশাত্মবোধ থেকে রাজনীতি পৃথক নয় ' এমন ভাবনায় তাঁর হৃদয়ে পূর্ণ ছিল । তাই বন্ধু সুকান্তের মত , পূর্ণিমার চাঁদকে তাঁর কাছেও মনে হত ' ঝলসানো রুটি ' । আকাশের চাঁদ তাঁকে প্রলুব্ধ করতে পারেনি , তাঁর মনে হয়েছে , ' ওসব কেবল বুর্জোয়াদের মায়া ' । যেকালে সুভাষ মুখোপাধ্যায় পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেড়াচ্ছেন , তখন তো ' অদ্ভূত এক আঁধার নেমে এসেছে ' ধরণীর শরীর ঘেঁষে । তাই সন্ধ্যাতারা পেড়ে প্রেমিকার খোঁপায় গোঁজার মত বিলাসিতা তাঁর ছিল না , ফুল প্রিয় হলেও সময়ের যুগযন্ত্রণা আর প্রসববেদনার বিচ্ছুরণ তাঁকে ফুলের বদলে আগুনের ফুলকি নিতে বাধ্য করে । কবি লেখেন ,
' স্ট্রাইক ! স্ট্রাইক ! একপাও পিছু হাটবো না কেউ , করুক রক্তারক্তি /স্ট্রাইক ! স্ট্রাইক ! পথে পথে আজ মোকাবিলা হোক , কার দিকে কত শক্তি । '
আসলে গণমানবের দুঃখবেদনার গল্পগুলো অস্বীকার করতে পারেননি কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় । সেইসব হাহাকারের আর্তনাদই হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতার মূল অবলম্বন । সাহিত্যিকের মতাদর্শ কী হবে ? এ বিষয়ে তাঁর ধারণা অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং পবিত্রই বটে । তিনি তাঁর মানস গঠনের আবহিক দিকবলয় সম্পর্কে লিখলেন ,
' সেই শিল্পই খাঁটি শিল্প , যাঁর দর্পণে জীবন প্রতিফলিত । তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে - যা কিছু সংঘাত সংগ্রাম আর প্রেরণা , জয় পরাজয় আর জীবনের ভালবাসা - খুঁজে পাওয়া যাবে একটি মানুষের সব কটি দিক । '
যাঁর হৃদয় এমন মহৎ আদর্শে বিনির্মাণে সুমন্ডিত তিনি অসাম্যের বিপক্ষে দাঁড়াবেন , সেটায় তো স্বাভাবিক ।
পরাধীন ভারত তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র , শাসকের উৎপীড়নের সাথে বিশ্বযুদ্ধ , মহামারী মন্বন্তর সবই দেখেছেন স্বচোখে , গণ মানবের হাহাকার শুনেছেন স্বকর্ণে । এই সব অবক্ষয় তাঁর হৃদয়ে সুনামির সঞ্চার করে । কবি সুভাষ সেই সব গণমানুষের অংশ হয়ে ওঠেন । মিছিলের মুখ যেন তিনি । কবি ' কাব্য জিজ্ঞাসা ' কবিতায় লিখছেন ,
' ভেঙেছে সংসার স্বর্গ ; কণ্টকিত স্বপ্নের বিছানা
পাঠালো মৃত্যুর সূর্য গলিত মৃত্যুর পরোয়ানা ,
আমাদের মোমের টুপিতে । '
' মিছিলের মুখ ' কবির কবির প্রথম প্রেমের কবিতা । প্রেমের কবিতা হলেও , রোমাঞ্চ নেই একেবারেই ।
' মিছিলে দেখেছিলাম একটি মুখ
মুষ্টিবদ্ধ একটি শাণিত হাত
আকাশের দিকে নিক্ষিপ্ত ;
বিস্রস্ত কয়েকটি কেশাগ্র
আগুনের শিখার মতো হাওয়ায় কম্পমান । '
মিছিলের সেই শাণিত মুখের দিকে তাকিয়ে কবি সুভাষ আপ্লুত , এক অনন্য আকর্ষন অনুভব করলেন কবি , তা প্রেমেরই স্বরুপ । কবির চোখে সেই মুখ স্বপ্ন বোনে ।
' ময়দানে মিশে গেলেও
ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ জনসমুদ্রের ফেনিল চূড়ায়
ফসফরাসের মত জ্বল জ্বল করতে থাকল
মিছিলের সেই মুখ । '
সমুদ্রের উচ্ছ্বাস দিল কবিকে মিছিলের সেই মুষ্টিবদ্ধ হাত আর মিছিলের শাণিত মুখ । আসলে এক অনন্য বিদ্রোহী ভাবনা কবির মননকে সমৃদ্ধ করছিল , যা কবিতা হয়ে পাঠকের হৃদয়ে ঝড়সম অভিজ্ঞান সঞ্চার করতে সহায়তা করছিল । কবি সুভাষের কবিতার কয়েকটি উদ্ধৃতি সহযোগে এই লেখার সমাপন করি , যা আজও পাঠক হৃদয়কে উদ্বেলিত করে , অসাম্যের বিপক্ষে দাঁড়াতে ভীষণ রকম উৎসাহ দেয় ।
' কিন্তু মোটেই খুশি হচ্ছি না যখন দেখছি
যার হাত আছে তার কাজ নেই
যার কাজ আছে তার ভাত নেই
আর যার ভাত আছে তার হাত নেই । '
আবার অন্যত্র তিনি লিখলেন ,
' পৃথিবীটা যেন রাস্তার খেঁকি কুকুরের মত
পোকার জ্বালায়
নিজের লেজ কামড়ে ধরে
কেবলি পাক খাচ্ছে । '
আবার ঈশ্বরের প্রতিও তাঁর কটাক্ষ ,
' উদাসিন ঈশ্বর কেঁপে উঠবে না কি
আমাদের পদাতিক পদক্ষেপে ? '
সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর কবিতা এবং স্বজীবনে মানুষের ন্যায় পাওয়ার জন্য লড়াই জারি রেখেছিলেন । মানুষের বিপদে গৃহে লকডাউন করেননি , পৌঁছে গেছেন দুর্ভিক্ষ পীড়িত মহল্লাই । মৃত্যুর এতদিন পরও তাই সুভাষ আজও আদরনীয় হয়ে আছেন ।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন