নজরুলের কবিতার মত ভয়ঙ্কর হুঙ্কার না থাকলেও সুভাষের কবিতায় রয়েছে বিদ্রোহী মনন এবং ভাবনাজাত অভিজ্ঞান । লিখেছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।



রবীন্দ্রউত্তর কাব্য কলার এক বিশিষ্ট সরস্বত কবিপ্রতিভা সুভাষ মুখোপাধ্যায় । বাংলা কবিতার ভূবনে যে কজন কাব্যকার রবীন্দ্র সমকালীন যুগপ্রহরে আবির্ভূত হওয়ার পর এক স্বঘরানা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন কবি সুভাষ , তাঁদের প্রধানতম । তিনি স্বহৃদয়ের কাব্যিক অনুভূতির সংবেদ বৃহত্তর মানব সমাজের জন্য বরাদ্দ করেছিলেন । ব্যক্তিজীবনে সাম্যবাদী ভাবদর্শনে অভিভূত কবি সকল রকমের অসাম্যের বিপক্ষে নিজেকে দাঁড় করাতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত হননি । একজন আদর্শ কাব্যকারের এই মহৎ গুণ থাকা একান্ত অবশ্যই । কেননা , সময়কে অবজ্ঞা করে কবিতার শরীর গঠন করা প্রায় অসম্ভব । যদিও অনেক কবি নামের অকবি গণ ধ্বংশের পিরামিডে বসে সুখের প্রসাদ অঙ্কনে ব্রতী হন । সমকালীন অত্যচারি নিষ্টুর শাসকের রক্তচক্ষু তাঁদেরকে কাপুরুষ মোসাহেবে পরিণত করে । ঝুলিতে উপছে পড়ে পুরুষ্কার আর শিরোপা । সুভাষ মুখোপাধ্যায় সেই কবি নামের অকবিদের সরণিতে স্বনাম লিপিবদ্ধ করেননি । অসাম্যর বিপক্ষে রুখে দাঁড়িয়েছেন বুকের ছাতি ফুলিয়েই  ,
             ' প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য 
                ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা , 
                 চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য 
                  কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া । ' 
নজরুলের কবিতার মত ভয়ঙ্কর হুঙ্কার না থাকলেও সুভাষের কবিতায় রয়েছে বিদ্রোহী মনন এবং ভাবনাজাত অভিজ্ঞান । সুভাষ ' পাথরের ফুল '  কবিতায় লেখেন , 
                   ' ফুল দিয়ে 
                   মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই
          ফুলের ওপর কোনদিনই আমার টান নেই 
           তার চেয়ে আমার পছন্দ 
                 আগুনের ফুলকি -
       যা দিয়ে কোনদিন কারো মুখোশ হয় না ।' 
মানুষের মুখোশ , নীতিহীন জপমালা , চারপায়ী আচরণ , শাসকের ছলনা , শোষণের হিমালয় প্রতীম নিষ্টুরতা সুভাষকে বিদ্রোহী করে তোলে । সুভাষ লেখেন , ' 
             ' মৃত্যুর ভয়ে ভীরু বসে থাকা আর না - 
               পরো পরো যুদ্ধের সজ্জা । ' 


১৯১৯ সালে ১২ই ফেব্রুয়ারি নদীয়ার কৃষ্ণনগরে মামার বাড়িতে  এই মহান কবি মানুষের জন্ম হয় । পিতা ক্ষিতিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় , জননী যামিনী দেবী । পিতার বদলির চাকরি হওয়ায় কবির শৈশব কেটেছে নানা জায়গায় । কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশান থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন । ছাত্রজীবনেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন । সাম্যবাদী মতাদর্শ ভাবুক সুভাষকে আকৃষ্ট করে । সাল ১৯৩২ - ৩৩ নাগাদ তিনি যুক্ত হন ' বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিশোর ছাত্রদলে । আবার ১৯৩৯ সালে তিনি লেবার পার্টিতে যোগ দেন । সাম্যবাদী ভাবধারার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণ সুভাষ মানুষ মাত্রই সকলের সম অধিকার ভাবনা দ্বারা পরিচালিত ছিল তাঁর জীবন ও দর্শনের গল্পগুলি । সাল ১৯৪২ এ তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন । ১৯৪৬ সালে দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকার সাংবাদিক হিসাবে কর্মজীবনের সূচনা করেন । সাল ১৯৪৮ নাগাদ কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হওয়ায় অনেকের সঙ্গে কবিকেও কারাবরণ করতে হয় । দুই বছর পর ১৯৫০ সালে কবি কারামুক্ত হন । ১৯৫১ সালে ' পরিচয় ' পত্রিকার সম্পাদনার কাজে তিনি ব্যাপিত হন । ওই বছরই তিনি গীতা বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । ১৯৬৭ সালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার অপরাধে দ্বিতীয় বারের মত তাঁকে কারাবরণ করতে হয় । ১৯৮১ সালে স্বজীবনের শেষ পর্বে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে তিনি অব্যহতি নেন এবং দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সমর্থক হয়ে ওঠেন । 

কবির প্রধান কাব্যকলা সমূহের মধ্যে উল্লেখ্য , ' পদাতিক ' ১৯৪০ , ' অগ্নিকোন ' ১৯৪৮ ,' চিরকুট ' ১৯৫০ , ' ফুল ফুটুক ' ১৯৫৭ , ' যত দূরে যাই ' ১৯৬২ , ' কাল মধুমাস ' ১৯৬৬ , ' এই ভাই ' ১৯৭১ , ' ছেলে গেছে বনে ' ১৯৭২ , ' একটু পা চালিয়ে ' ১৯৭৯ , ' জল সইতে ' ১৯৮১ ,   ' চইচই চইচই' ১৯৮৩ ,'  বাঘ ডেকেছিল ' ১৯৮৫ , ' যা রে কাগজের নৌকা ' ১৯৮৯ , ' ধর্মের কল ' ১৯৯১ ,  ইত্যাদি । 

জীবনের প্রথম দিকে কবি সুভাষ সাম্যবাদে বিশ্বাসী ছিলেন । তিনি মনে করতেন কমিউনিজমই পারে সমাজগত বিভেদ বিনষ্ট করতে । ' মানবতা ও দেশাত্মবোধ থেকে রাজনীতি পৃথক নয় ' এমন ভাবনায় তাঁর হৃদয়ে পূর্ণ ছিল । তাই বন্ধু সুকান্তের মত , পূর্ণিমার চাঁদকে তাঁর কাছেও মনে হত ' ঝলসানো রুটি ' । আকাশের চাঁদ তাঁকে প্রলুব্ধ করতে পারেনি , তাঁর মনে হয়েছে , ' ওসব কেবল বুর্জোয়াদের মায়া ' । যেকালে সুভাষ মুখোপাধ্যায় পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেড়াচ্ছেন , তখন তো ' অদ্ভূত এক আঁধার নেমে এসেছে ' ধরণীর শরীর ঘেঁষে । তাই সন্ধ্যাতারা পেড়ে প্রেমিকার খোঁপায় গোঁজার মত বিলাসিতা তাঁর ছিল না , ফুল প্রিয় হলেও সময়ের যুগযন্ত্রণা আর প্রসববেদনার বিচ্ছুরণ তাঁকে ফুলের বদলে আগুনের ফুলকি নিতে বাধ্য করে । কবি লেখেন , 
' স্ট্রাইক ! স্ট্রাইক !  একপাও পিছু হাটবো না কেউ , করুক রক্তারক্তি /স্ট্রাইক ! স্ট্রাইক ! পথে পথে আজ মোকাবিলা হোক , কার দিকে কত শক্তি । ' 
আসলে গণমানবের দুঃখবেদনার গল্পগুলো অস্বীকার করতে পারেননি কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় । সেইসব হাহাকারের আর্তনাদই হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতার মূল অবলম্বন । সাহিত্যিকের মতাদর্শ কী হবে ? এ বিষয়ে তাঁর ধারণা অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং পবিত্রই বটে । তিনি তাঁর মানস গঠনের আবহিক দিকবলয় সম্পর্কে লিখলেন , 
      ' সেই শিল্পই খাঁটি শিল্প , যাঁর দর্পণে জীবন প্রতিফলিত । তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে - যা কিছু সংঘাত সংগ্রাম আর প্রেরণা , জয় পরাজয় আর জীবনের ভালবাসা - খুঁজে পাওয়া যাবে একটি মানুষের সব কটি দিক । ' 
যাঁর হৃদয় এমন মহৎ আদর্শে বিনির্মাণে সুমন্ডিত তিনি অসাম্যের বিপক্ষে দাঁড়াবেন , সেটায় তো স্বাভাবিক । 

পরাধীন ভারত তাঁর বিচরণ ক্ষেত্র , শাসকের উৎপীড়নের সাথে বিশ্বযুদ্ধ , মহামারী মন্বন্তর সবই দেখেছেন স্বচোখে , গণ মানবের হাহাকার শুনেছেন স্বকর্ণে । এই সব অবক্ষয় তাঁর হৃদয়ে সুনামির সঞ্চার করে । কবি সুভাষ সেই সব গণমানুষের অংশ হয়ে ওঠেন । মিছিলের মুখ যেন তিনি । কবি ' কাব্য জিজ্ঞাসা '  কবিতায় লিখছেন , 
' ভেঙেছে সংসার স্বর্গ ; কণ্টকিত স্বপ্নের বিছানা
  পাঠালো মৃত্যুর সূর্য গলিত মৃত্যুর পরোয়ানা , 
  আমাদের মোমের টুপিতে । '  

' মিছিলের মুখ ' কবির কবির প্রথম প্রেমের কবিতা । প্রেমের কবিতা হলেও , রোমাঞ্চ নেই একেবারেই । 
  ' মিছিলে দেখেছিলাম একটি মুখ 
    মুষ্টিবদ্ধ একটি শাণিত হাত 
    আকাশের দিকে নিক্ষিপ্ত ;
    বিস্রস্ত কয়েকটি কেশাগ্র 
আগুনের শিখার মতো হাওয়ায় কম্পমান । ' 
মিছিলের সেই শাণিত মুখের দিকে তাকিয়ে কবি সুভাষ আপ্লুত , এক অনন্য আকর্ষন অনুভব করলেন কবি , তা প্রেমেরই স্বরুপ । কবির চোখে সেই মুখ স্বপ্ন বোনে । 
   ' ময়দানে মিশে গেলেও 
    ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ জনসমুদ্রের ফেনিল চূড়ায় 
  ফসফরাসের মত জ্বল জ্বল করতে থাকল
  মিছিলের সেই মুখ । ' 
সমুদ্রের উচ্ছ্বাস দিল কবিকে  মিছিলের সেই মুষ্টিবদ্ধ হাত আর মিছিলের শাণিত মুখ । আসলে এক অনন্য বিদ্রোহী ভাবনা কবির মননকে সমৃদ্ধ করছিল , যা কবিতা হয়ে পাঠকের হৃদয়ে ঝড়সম অভিজ্ঞান সঞ্চার করতে সহায়তা করছিল । কবি সুভাষের কবিতার কয়েকটি উদ্ধৃতি সহযোগে এই লেখার সমাপন করি , যা আজও পাঠক হৃদয়কে উদ্বেলিত করে , অসাম্যের বিপক্ষে দাঁড়াতে ভীষণ রকম উৎসাহ দেয় । 
' কিন্তু মোটেই খুশি হচ্ছি না যখন দেখছি 
যার হাত আছে তার কাজ নেই 
যার কাজ আছে তার ভাত নেই 
আর যার ভাত আছে তার হাত নেই । ' 
আবার অন্যত্র তিনি লিখলেন , 
' পৃথিবীটা যেন রাস্তার খেঁকি কুকুরের মত 
পোকার জ্বালায় 
নিজের লেজ কামড়ে ধরে 
কেবলি পাক খাচ্ছে । ' 
আবার ঈশ্বরের প্রতিও তাঁর কটাক্ষ , 
' উদাসিন ঈশ্বর কেঁপে উঠবে না কি 
আমাদের পদাতিক পদক্ষেপে ? ' 
সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর কবিতা এবং স্বজীবনে মানুষের ন্যায় পাওয়ার জন্য লড়াই জারি রেখেছিলেন । মানুষের বিপদে গৃহে লকডাউন করেননি , পৌঁছে গেছেন দুর্ভিক্ষ পীড়িত মহল্লাই । মৃত্যুর এতদিন পরও তাই সুভাষ আজও আদরনীয় হয়ে আছেন । 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।