কবিবর জীবনানন্দ দাশ সমীপেষু কোথায় পেয়েছিলেন , তাঁর আদরনীয় বনলতা সেনকে ? একটি অনুসন্ধান মূলক আলোকপাত করছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি ॥



' বনলতা সেন ' কবিতাটি শুধুমাত্র কবি জীবনানন্দ দাশের জনপ্রিয়তম কবিতা , এই আপ্তবাক্যে থেমে থাকা চলে না ।'  বনলতা সেন ' প্রেমের কবিতা হিসাবে বিশ্বসাহিত্যের ভূমন্ডলে এক অনন্য সংযোজন । স্যার , আর্থার কেনান ডয়েলের  ' শার্লক হোমস ' বিশ্ব গোয়েন্দা সাহিত্যের  প্রপিতামহ সদৃশ চরিত্র , অর্থাৎ বিশ্ব সাহিত্যের প্রায় সব গোয়েন্দা চরিত্র গুলোর নির্মাণ রহস্যের নেপথ্যে ' শার্লক হোমস ' দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়ার দৃষ্টান্ত সূর্য উদয়ের মত নির্ভেজাল সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে । চরিত্রটি এত্তটা ভয়ঙ্কর রকম জীবন্ত , তা নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই , অর্থাৎ শার্লক বাস্তব কোন চরিত্র কীনা তার ঠিকুজি বার করতে এখনও গবেষক পাঠকদের মধ্যে  হিমালয় প্রতীম প্রচেষ্টা লক্ষ্যগোচর হয় । এখনও অনেক পাঠকই বেকার স্ট্রীটে চিঠি পাঠান , যেখানে গল্পের চরিত্র শার্লক এবং ওয়াটসন থাকতেন । পাঠকের ভ্রম হতে পারে , হঠাৎ করেই বিষয় থেকে বেরিয়ে গেলাম কীনা ? পাঠক আশ্বস্ত হন , বোঝানোর ঋজুতা নিয়ে আসবার নিমিত্তে শার্লক প্রসঙ্গের অবতারণা করেছি মাত্র । জীবনানন্দ দাশের ' বনলতা সেন ' চরিত্রটিও অসম্ভব জনপ্রিয় একটি চরিত্র । ফলত , কবিবর জীবনানন্দ কোথায় পেলেন নাটোরের বনলতা সেনকে ? তিনি কী কবির পূর্বপরিচিত কোন প্রিয়জন ?  এমনতর বিষয় সমূহের উপস্থাপনা আমরা গবেষক মহলে ভীষণ রকম আলোচিত হতে দেখি ।

প্রশ্নটি অবান্তর নয় মোটেও , সত্যই কোথায় পেলেন প্রিয় কবি জীবনানন্দ তাঁর অমর সৃষ্টি বনলতা সেনকে ? পাঠক বুঝবেন , কবি মানুষগণ তো মঙ্গল গ্রহ থেকে নেমে আসেন না , এই মর্ত্য পৃথিবীর প্রতিভূ হিসাবে তাঁরা সক্রিয় থাকেন । ফলত , সমাজ রাষ্ট্র ও অনন্য পরিআবহিক ঘটনা পরম্পরা থেকে তাঁরা সাহিত্যের মনিমুক্তা সংগ্রহে ব্রতী হন । তাহলে , বললে খুব একটা অযৌক্তিক হয় না , বনলতাও কবির সমাজগত উচ্চারণ , অর্থাৎ তাঁর দেখা কোন সমাজিক চরিত্র , যিনি কবিবরের হৃদয় নির্মাণকে আলোড়িত করেছিল , এমন প্রশ্ন বার বার পাঠকের হৃদয়ে উঁকি দিয়েছে ।

আলোচনার বহর প্রসারণ করবার পূর্বে প্রখ্যাত কবিতাখানি আসুন পাঠক পাঠ করি ।
' ' হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”

' বনলতা সেন ' কবিতাটি বিশ্বসাহিত্যের সন্দেহাতীত ভাবে এক বিষ্ময়কর সৃস্টি । যদিও রচনার পরপরই ' শনিবারের চিঠির ' সম্পাদক , সজনীকান্ত দাশের মতো চরিত্রগণ এর বিরুপ সমালোচনা করেছিলেন । পাঠক নিশ্চয় ভোলেননি , এই সজনী বাবুই কাজী নজরুল ইসলামের ' বিদ্রোহী ' , কবিতার  অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার পরপরই একাধিক প্যরোডি কবিতা লিখে কাজী কবির মানসিক শান্তির বিঘ্ন ঘটিয়েছিলেন । আসুন সজনী বাবু , কী লিখেছিলেন পড়ি । তিনি লিখলেন , ' এই প্রতিভাবান কবিদের আর একটি কৌশল কবিতা লিখিতে লিখিতে অকস্মাৎ অকারণ এক একজন ভদ্রমহিলার নাম করিয়া আমাদিগকে উৎসুক আর উৎসাহিত করিয়া তোলা । ' যায়হোক , সজনী বাবুরা প্রায় সকল যুগউত্তীর্ণ কবিবর্গের সমালোচনা করা একপ্রকার প্রতিদিনকার কর্ম বলে জ্ঞান করেছিলেন , জীবনানন্দ সমালোচনাও তারই পরম্পরা ।

পূর্বেই বলেছি '  বনলতা সেন ' প্রেমের কবিতা হিসাবে বিশ্বসাহিত্যে ভীষণ রকম সামাদিত । কবি নিজে কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন , ' Banalota Sen Of Natore .' কবিবর জীবনানন্দ দাশ সমীপেষু , কোথায় পেলেন এমন আদরনীয় চরিত্রকে , এই বিষয়টি জানবার কৌতূহল পাঠকের শাশ্বতভাবেই রয়েছে কবিতাটি সৃষ্টিলগ্ন হতেই ।  সুদূর ইউরোপে ভিঞ্চির মোনালিসা, শেক্সপিয়রের ডার্ক লেডি’কে মানুষ যেভাবে খুঁজে বেরিয়েছে ঠিক সেভাবেই আমাদের বাংলা সাহিত্যের বনলতা সেনকেও খুঁজছে মানুষ।

জীবনানন্দ দাশের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক প্রদ্যুম্ন মিত্র । তিনি  তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ‘জীবনানন্দের চেতনাজগৎ’ এ বনলতা সেন চরিত্র সৃষ্টির নেপথ্যে তাঁর কোন পূর্ব পরিচিত মহীয়সী নারী থাকতে পারেন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন । আসুন , তিনি কী লিখেছেন পড়ি ।  “বনলতা সেন নাটোরের-হয়তো সে কবির প্রিয় পরিচিত নাটোরেরই। প্রিয় পরিচিত অথচ বিস্মৃত; কিন্তু নবীন আবিষ্কারে মহনীয় সত্তায় সে যেন উদ্ভাসিত।”নাটোরের মেয়ে জয়শ্রী সেনের সঙ্গে কবির পূর্ব পরিচিতি ছিল । বিবাহের পর জয়শ্রী কলকাতায় স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন । কবিও কলকাতাতে ছিলেন , ফলত জয়শ্রীর সঙ্গে কবির বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে , অনেক সমালোচক মনে করেন , জয়শ্রীর আদলে কবি বনলতা বিনির্মাণ করতে পারেন ।

 কবি  জীবনানন্দ দাশের মাত্র ১৬৭ টি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল । তাঁর সিংহভাগ সাহিত্য সম্ভারই ছিল অপ্রকাশিত । ড . ভূমেন্দ্র গুহ , জীবনানন্দ দাশের পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার এবং তা গবেষণার ক্ষেত্রে প্রশংসা করবার মত কাজ করেছেন ।  ড .গুহ কবির 'লিটেরেরি নোটস' গবেষণা করে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন , যে কবির জীবনে নিঃসন্দেহে ভাবেই প্রেম এসেছিল । দিনলিপি বা লিটেরেরি নোটস-এ ওয়াই (Y) হিসেবে উল্লিখিত মেয়েটিই কবির কাঙ্ক্ষিত নারী। ভূমেন্দ্র গুহ উল্লেখ করেছেন , মেয়েটির নাম  শোভনা । কবির এক কাকা ছিলেন , নাম অতুলান্ত দাশ । শোভনা , তাঁরই মেয়ে । যার ডাক নাম ছিল  বেবী। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে লাবণ্য দাশকে বিয়ে করেছিলেন । বিয়ের পূর্বে যুবক জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে শোভনার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল । যদিও তা বিয়ে পর্যন্ত পৌঁছোয়নি । একটি উপন্যাসে শোভনাকে   শচী নামেও উপস্থাপন করেছিলেন কথক জীবনানন্দ ।  শোভনার সঙ্গে বিচ্ছেদ কবি বহুদিন ভুলতে পারেননি । পরে লাবণ্য দাশের সঙ্গেও কবির সম্পর্কের তেমন বনিবনা না হওয়ায় , শোভনার স্মৃতি কবিকে পীড়িত করতে পারে , সেই পীড়ন থেকেই বনলতা জন্ম হতেই পারে , বিষয়টি অবান্তর নয় ।

বনলতা সেন কবিতার পঁচাত্তর বছর পূর্তিতে উপলক্ষে শ্রী অশোক মিত্র লিখেছেন, “এক নিভৃত সন্ধ্যায় জীবনানন্দের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, বনলতা সেন নামটি কবিতায় ব্যবহারের জন্য তাঁর কী করে মনে এল; সেইসঙ্গে এটা জিজ্ঞেস করেছিলাম, কবিতাটির অন্তঃস্থিত অন্ধকারের প্রসঙ্গ তাঁর কি আগে থেকেই ভাবা ছিল, না কি বনলতা সেন নামটি বেছে নেওয়ার পর কবিতাটি নিজের নিয়তি নির্ধারণ করেছে। দ্বিতীয় প্রশ্নের কোনও জবাব পাইনি। জীবনানন্দ শুধু জানিয়েছেন, সেই সময় আনন্দবাজার পত্রিকায় মাঝে মাঝে নিবর্তক আইনে বন্দিরা কে কোন কারাগারে আছেন, বা কোন জেল থেকে কোন জেলে স্থানান্তরিত হলেন, সে-সমস্ত খবর বেরোত। হয়তো ১৯৩২ সাল হবে, নয়তো তার পরের বছর, বনলতা সেন নাম্নী এক রাজবন্দি রাজশাহি জেলে আছেন, খবরটা তাঁর চোখে পড়েছিল, রাজশাহি থেকে নাটোর তো একচিলতে পথ। ইতবৃত্তের এখানেই শেষ। প্রাকস্বাধীনতা যুগে রাজবন্দিনী সেই মহিলা পরে গণিতের অধ্যাপিকা হয়েছিলেন, কলকাতার কলেজেও পড়িয়েছেন। বিবাহোত্তর পর্বে অন্য পদবি ব্যবহার করতেন, তাঁর সামান্য আলাপ হয়েছিল। ভব্যতাবশতই জিজ্ঞেস করা হয়নি তিনি কবিতাটির সঙ্গে আদৌ পরিচিত কি না। কিছু কিছু রহস্যকে অন্ধকারে ঢেকে রাখাই সম্ভবত শ্রেয়। (পৃ:-৫, বনলতা সেন/বিক্ষিপ্ত অর্ধশতক/অশোক মিত্র)। কবি শ্রী অশোক মিত্রের প্রশ্নের সব উত্তর দেননি । এই নীরবতায় বনলতা সেন গবেষণায় গবেষকদের মধ্যে হুড়োহুড়ি বাধিয়েছে , এ বিষয়ে সন্দেহ নেই ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।