দুর্ভিক্ষ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে , সেই সময় পর্বের গল্প এটি । গল্পটি মৃত্যুঞ্জয়ের গল্প । লিখছেন আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।
মানিক বন্দোপাধ্যায় সমীপেষু । |
লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সমীপেষুর একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোট গল্পের নাম , ' কে বাঁচে , কে বাঁচায়' । গল্পটির প্রেক্ষাপট দুর্ভিক্ষ পীড়িত সময়ের । আমরা জানি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সাম্যবাদী ভাবধারার মানুষ । সমাজের যেকোনো অন্যায় এবং বৈষম্যের বিপক্ষেই বরাবরই তার অবস্থান । এ গল্পটি একটি মৃত্যু কালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে রচিত । দুর্ভিক্ষ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে , সেই সময় পর্বের গল্পটি এটি । গল্পটি মৃত্যুঞ্জয়ের গল্প । গল্পটির বিষয়ের মধ্যে যদি আমরা প্রবেশ করি , সেখানে দেখব গল্পের এক্কেবারে প্রথমেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় , লিখলেন ' সেদিন আপিস যাওয়ার পথে মৃত্যুঞ্জয় প্রথম মৃত্যু দেখল । ' বলাই বাহুল্য , এ মৃত্যু অনাহারে মৃত্যু । যদিও এতদিন এমন সামনাসামনি ফুটপাতে মৃত্যু দেখেনি সে , ফুটপাত দিয়ে হাটা তার বেশি হয় না । বাড়ি থেকে দু পা গেলেই ট্রাম , সেখান থেকে একেবারে অফিসের দরজায় নামে সে । আজ যে মৃত্যুটা মৃত্যুঞ্জয় দেখল , সে মৃত্যুর কথা ভুলতে পারে না সে । কয়েক মিনিটের মধ্যেই মৃত্যুঞ্জয়ের সুস্থ শরীরটা অসুস্থ হয়ে ওঠে । একটা মানসিক বেদনাবোধ , তাঁর হৃদয়কেই ক্ষত-বিক্ষত করে তুলল । অফিসে পৌঁছে তাই , নিজের ছোট ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে পড়ে সে । তখন রীতিমত তাকে ক্লান্ত মনে হচ্ছে । একটু বসে আবার কল ঘরে উঠে যায় , বমি করে দেয় নিজের ভিতরের সবটুকুই । মৃত্যুঞ্জয়ের এমন অবস্থা দেখে পাশের কেবিন থেকে ছুটে আসে বন্ধু নিখিল । মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে জলের গেলাস বাড়িয়ে দেয় সে । মৃত্যুঞ্জয় তখন দেওয়ালের দিকে ফিরে আছেন নির্লিপ্তভাবে । অফিসে এবং মৃত্যুঞ্জয় সমপদস্থ । মাইনে দুজনের সমান । তবে মৃত্যুঞ্জয় একটা বাড়তি দায়িত্ব পালন জন্য । তারজন্য পঞ্চাশ টাকা বেশি পায় ।
অন্য সকলের মত নিখিলও
মৃত্যুঞ্জয় কে পছন্দ করে। তার নিরীহ শান্ত দরদী মনোভাবের জন্য । আসলে মানব সভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন ও সবচেয়ে পচা আদর্শের কল্পনা তাপস মৃত্যুঞ্জয় । মৃত্যুঞ্জয় দুর্বল চিত্র ভাগ্যবান আদর্শবাদী হলে কোনো কথা ছিল না । কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়ের মানসিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া শ্লথ , তবে নিস্তেজ নয় । শক্তির উৎস আছে তার মধ্যে , তাই নিখিল মনে করে সে যদি মৃত্যুঞ্জয় হতে পারত মন্দ হতো না। মৃত্যুঞ্জয় এরকম অবস্থা দেখেই নিখিলের মনে হলো , নিশ্চয়ই কোন সমস্যা হয়েছে । তাই সে মৃত্যুঞ্জয়
কে জিজ্ঞাসা করল , কি হয়েছে তোমার ? মৃত্যুঞ্জয় চেঁচিয়ে উঠল , একটা আর্তনাদ করে বললো , ' মরে গেল না খেয়ে মরে গেল ' । এই না খেয়ে মরে যাওয়ার ঘটনা মৃত্যুঞ্জয়কে ভিতর থেকে একেবারেই দুর্বল করে তুলল । তার মনে হলো আমরা রোজ দুবেলা পেট ভরে খাচ্ছি , অথচ রাস্তায় ফুটপাতে অজস্র মানুষ , তাঁরা না খেয়ে একে একে মারা যাচ্ছে ! দুর্ভিক্ষের এই প্রবল করালগ্রাস মৃত্যুঞ্জয় কে আচ্ছন্ন করে তুলল । মৃত্যুঞ্জয়ের সংসার মাইনে টাকা দিয়েও ঠিকঠাক চলে না । প্রতিমাসে তাকে ধার করতে হয় । সেই মৃত্যুঞ্জয় নিজের মাইনের সবটুকু টাকা দান করে দিল অসহায় মানুষগুলোর খাওয়ার জন্য । তাঁর মনে প্রশ্ন উঠল , এই দুর্ভিক্ষ সময়ে সে সুস্থ মানুষের মত খেয়ে পরে বেঁচে আছে , এটা ঠিক নয় ! তাই তার মনে হয় , আমি বেঁচে থাকতে , যে লোকটা না খেয়ে মরে গেল , এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত কি ? জেনেশুনেও এতোকাল চারবেলা খেয়েছি পেট ভরে ! যথেষ্ট রিলিফ হচ্ছে না লোকের অভাবে , আর এদিকে ভেবে পাই নেই কি করে সময় কাটাবো ? ধিক ধিক ধিক আমাকে ! মৃত্যুঞ্জয়ের চোখ ছলছল করে ওঠে অসহায় মানুষগুলোর দুখে কাতর হয়ে । তাদের প্রতি দরদ উথলে উঠল তাঁর । সে বেঁচে থাকতে পেট ভরে খাওয়া সত্ত্বেও , মানুষের এই দুঃখ মোচনের জন্য সে কিছুই করতে পারে না , এই বোধ তাকে কুরে কুরে খেতে লাগল । মৃত্যুঞ্জয় কেমন যেন অবশ হয়ে যেতে লাগলো এরপর । অফিস কামাই হতে লাগলো তাঁর । সে ঘুরে বেড়ায় অসহায় মানুষ গুলোর সাথে । তাঁদের সেবায় নিজেকে উজাড় করে দিতে চায় সে । গল্পের একেবারে শেষ মুহূর্তে আমরা মৃত্যুঞ্জয়কে দেখতে পাই দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষ গুলোর মধ্যে । গল্পের শেষ চরণটি লক্ষ্য করবার মত , ' গাঁ থেকে এইছি । খেতে পায়নে বাবা । আমায় খেতে দাও । '
আসলে , এ গল্পে মানিক বাবু দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের অসহায় অবস্থার কথা তুলে ধরেছেন , সঙ্গে মৃত্যুঞ্জয়ের হৃদয় নির্মাণের মধ্য দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন , দুর্ভিক্ষ আনহার সময়ে নিজেদের কথা না ভেবে , যদি সমাজের সভ্য ভদ্র শ্রেণীভুক্ত গণ মানবগণ অসহায় দরিদ্র মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান , তবে এ খাদ্যভাবের অবসান ঘটানো যেতে পারে । প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তেই আমরা , কত্ত খাদ্য নষ্ট করি , অথচ কত্ত মানুষ আছে , যাঁরা দুই বেলা সমান্য একটু খাবারের জন্য ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করে ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন