ঊনিশ শতকের সেরা বাঙালি । আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
হে বিদ্যাসাগর , পূর্ব দিগন্তের বনে উপবনে
নব উদ্বোধন গাথা উচ্ছ্বসিল বিস্মিত গগনে ।
যে বাণী আনিলে বহি নিষ্কলুষ তাহা শুভ্র রুচি ,
সকরুণ মাহাত্মের পূণ্য গঙ্গাস্নানে তাহা শুচি । '
মনীষী রবীন্দ্রনাথ উপরে উদ্ধৃত অমিয় বাণীখানি উচ্চারণ করেছিলেন বাঙালি জনগোষ্টির পরম আদরনীয় প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব মহৎপ্রাণ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমীপেষুকে স্মরণ করে ।
আসলে , বিদ্যাসাগর কেবল একক একটি নামমাত্র নয় তো , তিনি বাঙালি জাতিসত্তার অনন্য পরিচয় , তিনি বাঙালি জাতির একবুক অহংকার । ঋষি বিদ্যাসাগর শুধুমাত্র বাঙালি জাতির প্রথম শিক্ষাগুরু মাত্র নন , তিনি বাঙালি রেনেসাঁর প্রথম যুগপুরুষও বটে । বঙ্কিম তাঁকে আড়চোখে দেখলেও , তিনিই বাঙালির আদিগুরু হিসাবে আজও বাঙালি হৃদয়ে পূঁজিত । বিদ্যাসাগরকে স্বীকার করতে বঙ্কিমচন্দ্রের অসুবিধা কেন ছিল , এ বিষয়টি গবেষণার বিষয় হতে পারে , আগামীতে কোন গবেষকের নিকট তা আদরনীয় বিষয় হয়ে উঠতে পারে । যায়হোক , ছদ্মবেশের অন্তরাল থেকে বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে কষাঘাতে বিদ্ধ করেছেন ।
' If successfully transalations from other languages constitue any claim to a high place as an author , we admit them in Vidyasagars case ; and if the compilation of very good primers for infants can in any way strengthen his claim , is strong . But we deny that either translation or primer making evinces A high order of genius ; and beyond translation and primer making Vidyasagar has done nothing .'
বঙ্কিমচন্দ্র অনুবাদকর্মকে শিল্পই মনে করতেন না , সেইজন্যই তিনি লিখতে পারলেন , ' Vidyasagar has done nothing .' এমন মারাত্মক বিভ্রান্তিমূলক মন্তব্য ।
বিদ্যাসাগর এবং বঙ্কিমচন্দ্র সমকালীন সময়েই জন্ম নেওয়া দুইজন প্রবাদপ্রতীম বাঙালি ব্যক্তিত্ব । সব জাতি এবং ধর্মমতের মানুষের মধ্যে বিদ্যাসাগরের গ্রহণযোগ্যতা ছিল । মানবতাই মানব ধর্ম , সকল মানুষ সমান , এমন মহৎ আপ্তবাক্যে পরিপূর্ণ ছিল ঈশ্বরচন্দ্রের হৃদয় বিনির্মাণ , অন্যদিকে বঙ্কিমচন্দ্র এক বিশেষ ধর্মমতের (পড়ুন মুসলমান ) মানুষদের ইতরগোত্রীয় বলে মনে করতেন । বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সাহিত্যের বেসাতভূমিতে ইসলাম ধর্মনুসারীদের প্রতি হৃদয়ের সবটুকু ঘৃণার উদ্গীরণ ঘটিয়েছেন অত্যন্ত সাবলীলভাবে । এমন কী পরাধীন ভারতবর্ষে যখন পরাক্রমশালী ইংরেজ ভারতীয়দের জীবনকে বিধ্বস্ত করছে প্রতিমূহূর্ত , সেই কালপর্বে বঙ্কিমচন্দ্রের ধারণা মতে লড়াইটা গোরাদের সঙ্গে নয় , যবনদের সঙ্গে । তাঁর দূর্গেশনন্দিনী , চন্দ্রশেখর , রাজসিংহ প্রভৃতি একাধিক উপন্যাস বঙ্কিমচন্দ্রের মুসলিম বিদ্বেষের সাক্ষ্য বহন করে । রমেশচন্দ্র দত্ত বঙ্কিমচন্দ্রকে ঊনিশ শতকের বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বলে উল্লেখ করলেও প্রখ্যাত ভাষাবিদ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে অন্যসুর ধরা পড়েছে । ড . চট্টোপাধ্যায় তাঁর ' বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত ' অষ্টম খন্ডে লিখেছেন , ' রমেশচন্দ্র দত্ত বঙ্কিমচন্দ্রকে বলেছিলেন ঊনিশ শতকের বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি , কিন্তু এই উপাধিটি বোধহয় বিদ্যাসাগরেই অধিকতর সুষ্ঠভাবে প্রযুক্ত হতে পারে । বঙ্কিমচন্দ্র শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক , ক্ষুরধার বুদ্ধির নিবন্ধকার , জাতীয়তাবোধের উদগাতা , কিন্তু হিমাচলশুভ্র মহিমায় বিদ্যাসাগর এখনও অতুলনীয় । যাঁর শৈশব কেটেছে সুদূর গ্রামের পুরাতন শিক্ষাপ্রণালীতে , যৌবন অতিবাহিত হয়েছে কলকাতার সংস্কৃত কলেজে - সেই তিনি আচার আচরণ ও চিন্তাপ্রণালীতে প্রচলিত সংস্কার বিসর্জন দিয়ে কিভাবে যে নব্যমানবতার ঋজু পথ ধরলেন , তা এক বিষ্মিত প্রশ্ন । সেকালের অনেক আধুনিক শিক্ষিতরাও পুরাতন সংস্কারের গুটি কাটাতে পারেননি , বঙ্কিমচন্দ্রও না । কিন্তু প্রাচীন সংস্কৃত শিক্ষায় আজীবন লালিত এক দরিদ্র ব্রাক্ষ্মন সহজেই ভূমি ছেড়ে ভূমার দিকে নিজেকে সম্প্রসারিত করেছিলেন । যে ভূমা হচ্ছে দরিদ্র অবহেলিত অসহায়ের প্রতি - দয়া নয় , করুণা নয় - অন্তহীন ভালোবাসা ও অপরিমেয় শ্রদ্ধাবোধ । '
যথার্থই বলেছেন শ্রদ্ধেয় সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় । ঊনিশ শতকে বঙ্কিমচন্দ্র যখন তাঁর লেখনীর মধ্য দিয়ে উগ্র ধর্মবাদের গোড়াপত্তনে ব্যস্ত ছিলেন , সেই সময় কালপর্বে ঋষি বিদ্যাসাগর সমাজের সর্বস্তর , সর্বজাত , ধর্মের মানুষের মুক্তির জন্য সমাজ সংস্কারকেই ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেন । বঙ্কিমচন্দ্র যেহেতু , এক বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের বিরুপে তাঁর কলম প্রসারিত করেছিলেন উক্তহেতুগত কারণেই সমাজের সর্বস্তরে তাঁর গ্রহণ যোগ্যতা বিষয়ে প্রশ্নচিহ্ন বিদ্যমান ছিল ।' আনন্দমঠ ' উপন্যসের বিখ্যাত দেশাত্মবোধক সঙ্গীত ' বন্দেমাতরম ' নিয়ে সমকালীন সময়ে কম বিতর্ক হয়নি । যায়হোক , নিঃসন্দেহভাবে বিদ্যাসাগর ছিলেন ঊনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি , এ বিষয়ে সন্দিহান হওয়া খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয় ।
বিদ্যাসাগর তাঁর দয়া দাক্ষিণ্যে দরিদ্র অবহেলিত মানুষের পরম আপনজন হয়ে উঠেছিলেন । একেবারেই সংস্কার বর্জিত খাঁটি বাঙালি তিনি । জীবদ্দশায়ই তাঁর ছবি ছাপিয়ে বিক্রি হত । তাঁর সম্পর্কে শিক্ষিত অশিক্ষিত , ধনী দরিদ্রের এক পৃথিবী কৌতূহল ছিল । পরিচারিকারা পর্যন্ত তাঁকে দেখবার জন্য রাস্তায় এসে জমায়েত হতো । কেউ কেউ হতাশ হতেন ঈশ্বরচন্দ্রের বেশভূষা দেখে । অতি সাধারণ বাঙালি পোশাক পড়তেন তিনি । বাড়িতে পূজাপাঠের বালাই নেই , সন্ধ্যা আহ্নিক করেন না , ভোজনকালে কায়স্থ বন্ধুর পাত্র থেকে মাছের মুড়ো তুলে নেন ইচ্ছে হলেই । হিন্দুর সমাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্টানে তাঁর আস্থা নেই , এমন প্রচারও ছিল সেই সময়ের কলকাতায় । অনেকেই তাঁকে নাস্তিক পর্যন্ত বলতে ছাড়েননি । ধর্মের থেকে সমাজিক বৈষম্য দূরীকরণই তাঁর কাছে উত্তম কাজ বলে বোধ হয়েছে ।
পতি গত বিধবাদের অসহায় কালযাপন দয়ার সাগর ঈশ্বরচন্দ্রকে ব্যথিত করলো । অনেক সমাজপতি ও ধর্মনেতার চরম বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি বিধবা বিবাহ প্রচলন করতে সচেষ্ট হলেন ।
' বিধবাবিবাহ প্রচলিত প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব ' শিরোনামের নিবন্ধে বিদ্যাসাগর লিখলেন , ' তোমরা মনে কর , পতিবিয়োগ হইলেই , স্ত্রীজাতির শরীর পাষাণময় হইয়া যায় ; দুঃখ আর দুঃখ বলিয়া বোধ হয় না ; যন্ত্রণা বলিয়া বোধ হয় না । দুর্জয় রিপুবর্গ এককালে নির্মূল হইয়া যায় । ...হায় , কি পরিতাপের বিষয় ! যে দেশের পুরুষজাতির দয়া নাই , ন্যায় অন্যায় বিচার নাই , হিতাহিত বোধ নাই , সদসদ্বিবেচনা নাই , কেবল লৌকিক রক্ষাই প্রধান কর্ম ও পরম ধর্ম ; আর যেন সে দেশে হতভাগা অবলাজাতি জন্মগ্রহণ না করে । হা অবলাগণ ! তোমরা কি পাপে , ভারতবর্ষে আসিয়া , জন্মগ্রহণ কর , বলিতে পারি না । '
কেশবচন্দ্র বাল্য বিবাহের বিরোধিতা করেছিলেন , অথচ নিজের বালিকা কন্যাকে বিয়ে দিলেন কোচবিহারের মহারাজার সঙ্গে । বিদ্যাসাগর মহাশয় করলেন ঠিক তার উল্টো , নিজের পুত্রের সঙ্গে বিয়ে দিলেন একজন বিধবার ।
শুধু বিধবা বিবাহ কেন , বহুবিবাহের মত সমাজিক ব্যধিও তৎকালিন সমাজে প্রচলিত ছিল । ঈশ্বরচন্দ্র এই ভ্রষ্ট প্রথার বিরুদ্ধেও লড়লেন সর্বশক্তি দিয়ে ।
শিক্ষার প্রসারে তাঁর অবদান বাঙালি কখনও ভুলতে পারবে না । রাজা রামমোহনের গদ্যকে তিনি মাধুর্য্য দান করলেন । বঙ্কিমচন্দ্রের ' Vidyasagar has done nothing .' এহেন মন্তব্য তাই ভীষণ অবাক করে । পাঠ্যপুস্তকের নিমিত্ত মনীষী ঈশ্বরচন্দ্র অনুবাদকেই অবলম্বন করেছিলেন । প্রত্যক বাঙালির শিক্ষাপ্রবাহের নেপথ্যে বিদ্যাসাগরের অবদান সর্বাধিক । বর্ণপরিচয় পড়েননি এমন বাঙালি একজন খুঁজে মেলা ভার । নারী শিক্ষার প্রসারে তাঁর অবদান হিমালয় প্রতীম । তৎকালীন সময়ে হিন্দু মুসলমান উভয় ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষজন মেয়েদের রেখেছিলেন অন্তঃপুরের বাসিনি করে । আধুনা মনের অধিকারী বিদ্যাসাগর মেনে নিতে পারলেন না এই অপব্যবস্থা । অসংখ্য বিদ্যালয় স্থাপন করলেন তিনি । নারী শিক্ষার প্রসার ঘটল । মুক্ত হল নারী মননের বদ্ধকুটি ।
অশনে বসনে তিনি পুরোপুরি খাঁটি বাঙালি । অসহায় মানবের প্রতি তাঁর অন্তহীন ভালোবাসা । এই মানবপ্রেম তাঁর সহজাত , ইয়ংবেঙ্গলদের মত মিল , কোৎ , টমাস পেইন পড়ে শিখতে হয়নি । একদিকে তিনি ছিলেন পৌরুষ বীর্যের প্রতীক , অন্যদিকে তিনি দয়ার সসীম সমুদ্র । মাইকেল মধুসূদন দত্তের মত সহস্র বাঙালি তাঁর দয়ায় বিমুগ্ধ হয়েছেন । দরিদ্র তাঁর ভূষণ , নিন্দুকের গাল মন্দ চলার পাথেয় । স্রোতের বিপরীতেই হাঁটতেন তিনি , মিছিলের অংশ হতেন না , বরং মিছিলকেই টানতেন নিজের দিকে । অষ্টাদশ - ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় মানবতাবাদীদের মতো মেকি মানবপ্রেম নয় , তিনি পথে নেমে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন । সমাজ সংস্কারের মহান ব্রতে তৎকালীন সমাজের শিক্ষিত অশিক্ষিত কোন দলপতির সাহায্য তিনি পাননি , বরং হয়েছে ঠিক তার উল্টোটা । সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের একটি উদ্ধৃতির সংযোজন করবো , পড়ুন - ' ঊনিশ শতকের পন্ডিত অপন্ডিত , ইংরেজি - ওয়ালা এবং টুলোপন্ডিত , সাহিত্যিক (বঙ্কিমচন্দ্র ) , সমাজের নব্যনেতা (রামগোপাল ঘোষ ) - সকলেই ছিলেন লোকাচারের দাস । কেউ - ই কঠোর সত্যের মুখোমুখি হতে চাননি । এমন কি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথও বিধবা বিবাহের যৌক্তিকতা স্বীকার করতেন না , তত্ত্ববোধনী পত্রিকায় বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহের যৌক্তিকতা বিষয়ে প্রবন্ধ মুদ্রিত করতে চাননি । ' এত বিরোধিতা সত্ত্বেও বিদ্যাসাগর সমীপেষু পিছপা হননি । অন্যায় অসাম্যের বিরুদ্ধে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি লড়েছেন বীর সিংহের মত । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে ভাবপ্রবাহকে বিরাম দিই ।
' তাঁহার মহৎ চরিত্রের যে অক্ষয়বট তিনি বঙ্গভূমিতে রোপণ করিয়া গিয়াছেন তাহার তলদেশ সমস্ত বাঙালিজাতির তীর্থস্থান হইয়াছে । '
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন