শতবর্ষ পরেও দেবদাস সমান জনপ্রিয় । আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।


' দেবদাস ' কেবল শরৎ সাহিত্যে নয় , সমগ্র বিশ্ব সাহিত্যের এক অনন্য সংযোজন । প্রেমের রোমান্টিকতা এবং বিচ্ছেদের নিগূঢ়তা উপন্যাসটির প্রাণ । অসম্ভব পাঠক আদরনীয় উপন্যাস এটি । প্রায় সকল ভারতীয় ভাষা এবং অনেক বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে গ্রন্থখানি । ভারত , বাংলাদেশ এবং পকিস্তানে উপন্যাসটি অবলম্বন করে একাধিক বার চলচিত্র তৈরি হয়েছে ।'  দেবদাস '  কাহিনী অবলম্বনে প্রথম চলচিত্র রুপায়ন ঘটে  ১৯২৮ সালে। যদিও এটি একটি নির্বাক  ছবি। আবার  ১৯৩৫ ও ৩৬ সালে নির্মিত হয়। অবশ্য এ ছবি  দুটিই সবাক। প্রথমটি বাংলায়  , অন্যটি হিন্দিতে । বাংলা হিন্দি ছাড়াও ' দেবদাস ' অবলম্বনে তামিল , তেলেগু , উর্দু , মালয়ালম , অসমীয়া সহ ভারতীয় উপমহাদেশের একাধিক ভাষায় চলচিত্র হয়েছে । যা উপন্যাসটি জনপ্রিয়তা আকাশচূম্বি হতে সহয়তা করেছে । 
বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন , ' বাল্য প্রেমে অভিসম্পাত আছে ' , কথাখানি সত্য মিথ্যা কীনা ঈশ্বর জানেন । তবে , এই বাল্যপ্রেমের অভিসম্পাত জীবন্ত আলেখ্য রুপ নিয়েছে ' দেবদাস ' উপন্যাসে । উপন্যাসটির প্রকাশকাল ১৯১৭ , তবে তারও অনেক আগে ১৯০০ সালের প্রথম দিকে এটি লেখা । উপন্যাসটি সম্পর্কে শরৎচন্দ্রের কিছুটা দ্বিধা ছিল , সেজন্যই উপন্যাস প্রকাশে তিনি দেরি করেন । ১৯১৩ সালে ' দেবদাস ' উপন্যাস সম্পর্কে বন্ধু প্রমথনাথ ভট্টাচার্যকে তিনি লিখেছিলেন , ' ওই বইটা (দেবদাস ) একেবারে মাতাল হইয়া বোতল খাইয়া লেখা । ' 
কেন্দ্রীয় চরিত্র দেবদাস , নায়িকা পার্বতী । এই দুই পাত্র পাত্রীর হৃদয়ের বিভিন্ন প্রেমস্পদ মোচড় , এই উপন্যসের প্রাণ শক্তি । উপন্যাসের কাহিনী ঘর এইরুপ , দেবদাস তৎকালীন জমিদার পরিবারের সন্তান । পার্বতী সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের প্রতিনিধি । তালসোনা নামক জনপদে উভয়ের পরিবার পাশাপাশি বাস করতো । সেইসূত্রে , দেব ও পার্বতী বাল্যবন্ধু । এক সময় এই বন্ধুত্বই প্রণয়ের রুপ নেয় । বাল্যকালে অভিসম্পাত আছে হয়তো । ধনী গরীব , সমাজিক রীতি নীতির হাজার দোহায় , কার্যত উপন্যাসের দুই পাত্র পাত্রীর মিলনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় । 
এদিকে , পার্বতী পিতা মাতা বিবাহযোগ্য মেয়েকে বেশিদিন ঘরে না রেখে বিবাহ দেওয়ার জন্য সচেষ্ট হন । হাতিপোতা গ্রামের ভূবন চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হয় পার্বতীর । ভুবন চৌধুরী জমিদার , স্ত্রী বিয়োগের পর পার্বতীকে বিয়ে করেন , ঘরে তাঁর ছেলে মেয়ে রয়েছে , যাঁরা পার্বতীর বয়সীই । 
পার্বতীর এই বিয়ে মেনে নিতে পারে না দেবদাস । অভিমান আর দুঃখে জীবনের সব আনন্দ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয় সে । পরিবারের সঙ্গেও সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে দেবদাস , হয়তো এক প্রকার অভিমান তাঁকে পাথর করে ফেলেছিল । কলকাতায় চলে আসল দেবদাস , এখানেই চুনীলালের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয় । চুনিলালের সৌজন্যেই চন্দ্রমুখীর সঙ্গে পরিচয় হয় দেবদাসের । চন্দ্রমুখী বাইজি , আসরে নাচ করে সে । ভদ্র ঘরের ছেলে দেবদাসকে সে পছন্দ করে । উপন্যাসের একেবারে শেষপর্যন্ত , অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তর প্রহর অব্দি দেবদাস পার্বতীকে ভুলতে পারেনি । মদ্যপান করেছে আকণ্ঠ , চুনিলাল - চন্দ্রমুখী সচেষ্ট হয়েও তাঁকে শেষ হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারেনি । মৃত্যুর পূর্বে , পার্বতীকে দেওয়া কথা পূরন করতে দেবদাস হাতিপোতা গ্রামের দিকে অগ্রসর হয় , পার্বতীর বাড়ির সামনেই দেবদাস করুণ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে উপন্যাসটি সমাপ্ত হয় । 
উপন্যাসটি দুটি হৃদয়ের অপূর্ণতার কথন । বিরহের মধ্যও যে অনন্য আনন্দ আছে , এই উপন্যাসটি তার উৎকর্ষ দৃষ্টান্ত । পাঠক মাত্রই উপন্যাসটির পাঠে বিহ্বল হয়ে ওঠে , বিরহের বেদনায় শিহরণ জাগায় শরীরময় । একটা অব্যক্ত প্রেম দেবদাস ও পার্বতীর জন্য হৃদয়ে পুঞ্জিভূত হয় পাঠককুলের । শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাসটির সমাপ্তি দিয়েছেন , এইভাবে , শুধু দেবদাসের জন্য বড় কষ্ট হয়৷ তোমরা যে-কেহ এ কাহিনী পড়িবে, হয়ত আমাদেরই মত দুঃখ পাইবে৷ তবু যদি কখনও দেবদাসের মত এমন হতভাগ্য, অসংযমী পাপিষ্ঠের সহিত পরিচয় ঘটে, তাহার জন্য একটু প্রার্থনা করিও৷ প্রার্থনা করিও, আর যাহাই হউক, যেন তাহার মত এমন করিয়া কাহারও মৃত্যু না ঘটে৷ মরণে ক্ষতি নাই, কিন্তু সে সময়ে যেন একটি স্নেহকরস্পর্শ তাহার ললাটে পৌঁছে- যেন একটিও করুনার্দ্র স্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতে এ জীবনের অন্ত হয়৷ মরিবার সময় যেন কাহারও একফোঁটা চোখের জল দেখিয়া সে মরিতে পারে৷’

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।