পথের দাবির বাজেয়াপ্তের মধ্যে যৌক্তিকতা দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ , হতাশ হয়েছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ।


আরিফুল ইসলাম সাহাজি 
“আমরা সবাই পথিক। মানুষের মন্যুষত্বের পথে চলবার সর্বপ্রকার দাবি অঙ্গীকার করে আমরা সকল বাধা ভেঙ্গেচুরে চলব”
' পথের দাবি ' শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি উপন্যাস । উপন্যাসটির মধ্য দিয়ে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের দেশপ্রেমের প্রকাশ ঘটেছে । পরাধীন ভারতবর্ষের গণমানবের নিপীড়ন ও মস্তক নত করে থাকার দীর্ঘ ইতিহাস , শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে লজ্জা ও অবমাননার ছিল । কংগ্রেসের সাথে সংযোগ থাকলেও সূর্যসেনদের প্রতি তাঁর ভীষণ মমত্ববোধ ছিল । তিনি একত্রে লিখলেন , ' পথের দাবীর বাস্তব প্রতিফলন ঘটাচ্ছে সূর্যসেন। আমার আশীর্বাদ রইলো তার সাথে।' 
পরাধীন ভারতবর্ষে তখন চলছে ইংরেজ শাসন , শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই ছিন্নমস্তা সময়ে  মোস্ট ওয়ান্টেড বিপ্লবী সূর্যসেন সেন সম্পর্কে এমন দরাজ প্রশংসা করতে ভয় পাননি । সুভাষচন্দ্র তাঁর সম্পর্কে যথার্থই লিখেছিলেন , ' একাধারে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ লেখক, আদর্শ দেশপ্রেমিক ও সর্বোপরি আদর্শ মানব।”
' পথের দাবি ' শরৎচন্দ্রের দেশ মায়ের প্রতি অর্ঘ্য স্বরুপ । ইংরেজ শাসন মুক্ত স্বাধীন জননী জন্মভূমির যে স্বপ্ন তিনি দেখতেন , সেই সংগ্রাম পূর্ণ আলোড়ন রয়েছে গোটা উপন্যাস জুড়ে । 
সব্যসাচী এই উপন্যাসের  নায়ক , যিনি দেশের জন্য সবকিছু উজাড় করে দিয়েছেন , দেশের মুক্তিই তাঁর একমাত্র স্বপ্ন । 

স্বভাবিকভাবেই , উপন্যাসটি শাসকের রোষানলে পড়ল ।  সে বছরের বর্ষপঞ্জিতে বলা হল , বইটির পাতায় পাতায় রয়েছে রাষ্ট্রবিরোধিতা , । কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার বইটি সম্পর্কে  সরকারের চিফ সেক্রেটারির কাছে বিষোদগার করেন । চিফ সেক্রেটারিও বইটিকে 'বিষময়' বলে উল্লেখ করেন। কলকাতার পাবলিক প্রসিকিউটরও বইটিকে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে  'উস্কানিমূলক' বলে মত দেন । উক্ত তিনজনের সুপারিশের উপর ভর করে ব্রিটিশ সরকার  ১৯২৭ সালের ৪ জানুয়ারি উপন্যাসটিকে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে । 

ততদিনে বইটির প্রায় তিন হাজার কপি পৌঁছে গেছে পাঠকের কাছে , ফলে বইটির বাজেয়াপ্ত করবার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে । আইনসভাতেও বইটির বাজেয়াপ্তের বিরুদ্ধে বলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র । 

বইটির বাজেয়াপ্তকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে শরৎচন্দ্রের মনোমালিন্য ঘটে । শরৎচন্দ্র চেয়েছিলেন , বইটির বাজেয়াপ্তের বিরুদ্ধে ইংরেজ পক্ষের উপর চাপ দিক বিশ্বকবি । তবে , এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎচন্দ্রের পাশে দাঁড়ালেন না , বরং কিছুটা ইংরেজ পক্ষই নিলেন তিনি । রবীন্দ্রনাথ লিখলেন , 
“তোমার পথের দাবী পড়ে শেষ করেছি। বইখানি উত্তেজক। মানে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে মনকে অপ্রসন্ন করে তোলে। লেখকের কর্তব্যের হিসাবে এটাকে দোষের নাও মনে হতে পারে, কেননা লেখক যদি ইংরেজরাজকে গর্হণীয় মনে করেন তাহলে চুপ করে থাকতে পারেন না। নানা দেশ ঘুরে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে এই দেখলেম, একমাত্র ইংরেজ গভর্ণমেন্ট ছাড়া স্বদেশী বা বিদেশী প্রজার বাক্যে বা ব্যবহারে এত বিরুদ্ধতা আর কোন গভর্ণমেন্ট সহ্য করবে না।
তোমার বই তারা প্রচার বন্ধ করে না দিত তাহলে বুঝা যেত সাহিত্যে তোমার শক্তি ও দেশে তোমার প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে তার নিরতিশয় অজ্ঞতা। শক্তিকে আঘাত করলে তার প্রতিঘাত সহ্য করার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে”।
বিশ্বকবির এহেন মন্তব্যে ক্ষুণ্ন হলেন দেশপ্রেমিক শরৎচন্দ্র , তিনি উত্তরে লিখলেন , 
' নানা কারণে বাংলা ভাষায় এ ধরনের বই কেউ লিখে না। তাই আমি যখন লিখলাম, তখন সবদিক জেনেই লিখেছি। কিন্তু বাংলাদেশের গ্রন্থকার হিসেবে যদি মিথ্যার আশ্রয় না নিয়ে থাকি এবং তা সত্ত্বেও যদি রাজশাস্তি ভোগ করতে হয় তো করতেই হবে, তা মুখ বুজেই মেনে চলি কিন্তু প্রতিবাদ করা কি উচিত নয়?
আমার প্রতি আপনি এই অবিচার তুলেছেন যেন আমি শাস্তি এড়াবার ভয়েই প্রতিবাদের ঝড় তুলেছি,কিন্তু বাস্তবিক তা নয়। দেশের লোকে যদি প্রতিবাদ না করে তবে আমাকেই করতে হবে তবে হৈ চৈ করে নয়, আরেকখানা গ্রন্থ লিখে”।
অনেকেই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে পরামর্শ দেন  উপন্যাসকে কিছু পরিবর্তন করে প্রকাশ করতে , শরৎচন্দ্র জানিয়েছিলেন , তিনি একটি শব্দও পরিবর্তন করবেন না । 

যায়হোক , উপন্যাস আদ্যপান্ত দেশাত্মবোধক । বইটির প্রতি শব্দই শৃঙ্খল মুক্তির কথাই খোদিত করেছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় । 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।