মানুষ প্রকৃতি এবং ঈশ্বর বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ত্রিবিধ আশ্রয় । আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
শরৎ পরবর্তী বাংলা কথা সাহিত্যের যুগপুরুষ , তাঁর যুগের অন্যতম কথাকার বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় । বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল তারকা তিনি । তাঁর স্বহৃদয় বীণা নিজস্ব গতিতে বহমান , যা বাংলা সাহিত্য দিয়েছে , এক স্বতন্ত্র প্রবাহ । তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় , মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মতই এক স্বতন্ত্র ধারা সৃস্টিতে প্রবলভাবে সফল হলেন বিভূতি , তার নেপথ্যে রয়েছে , তাঁর অনুভবমুখর মনন , প্রকৃতিকে তিনি দুচোখ ভরে ভোগ করেছেন । গণমানবের জীবনের সুখ দুঃখ লেপনের সাথে সাথে তাঁর প্রকৃতিক বর্ণনা ভীষণ রকম জীবন্ত । ' অরণ্যক ' উপন্যসের কথা পাঠক নিশ্চয় বিস্মৃত হননি । ওই উপন্যাসে ভানুমতি , রাজু পাঁড়ে দের সাথে প্রকৃতিকও এক অনন্য চরিত্র হিসাবে উঠে এসেছিল । এবার একটু , চাঁদের পাহাড়ের প্রসঙ্গ টানি । উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্য , সাথে বিশ্বসাহিত্যের অনন্য সংযোজন , এ বিষয়ে আশাকরি কেউ দ্বিমত হবেন না । পাঠক , আমার বিশ্বাস আপনারা প্রায় সকলেই পড়েছেন এই অমর লাজবাব উপন্যাসখানি , এইবার একটু ভাবুন , শংকরের ভয়ঙ্কর রোমাঞ্চময় অভিযানের সঙ্গে আমাজনের কি অপূর্ব বর্ণনা শ্রদ্ধেয় বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় দিয়েছেন । শুনলে অবাক হওয়ার মতই বিষয় , বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় কখনও আফ্রিকা যাননি , এমনকি ভারতবর্ষের বাইরেও তিনি কখনও যাননি । আপনারা নিশ্চয় অবগত আছেন , এই ধরাভূমি তখনও গ্লোবাল ভিলেজে রূপান্তরিত হয়নি । অর্থাৎ , বলবার বিষয় হল , গুগলিং কিম্বা ইউটিউবে সার্চ দিয়ে আমাজনের গভীর অরণ্যে বিভূতিভূষণের ঘুরে আসবার সুযোগ ছিল না , তিনি যতটুকু তথ্য সংগ্রহ করেছেন তার পুরোটাই পুস্তক পাঠের দৌলতে এবং তাঁর বিস্ময়কর দক্ষতার বলেই' চাঁদের পাহাড়ের ' বর্ণনা ঘটনা পরস্পরা এত্তটা জীবন্ত হয়ে উঠেছে ।
কথক বিভূতিভূষণ তাঁর অনুভবমুখর মনন সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে দিনলিপির পাতায় লিখেছেন , ' দূর জীবনের পার হতে আমি আমার যে পাখিডাকা , তেলকুচো ফুল ফোটা , ছায়াভরা মাটির ভিটেকে অভিনন্দন করে শুধু জানাতে চাই , - ভুলিনি ! ভুলিনি ! যেখানেই থাকি ভুলিনি ! - তোমার কথায় লিখে যাব - সুদীর্ঘ অনাগত দিনের বিচিত্র সুর সংযোগের মধ্যে তোমার মেঠো একতারার উদার , অনাহত ঝংকারটুকু যেন অক্ষুন্ন থাকে । '
কবিবর জীবনানন্দ দাশ সমীপেষু মৃত্যুর পরের জীবনেও প্রিয় জননী জন্মভূমি এই বাংলায় ফিরে আসবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন , বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ও বাংলাভূমির সৌন্দর্যময় রুপবাহারকে ভুলতে পারেন না , এই না পারার আস্ফালনই তাঁকে বাংলা সাহিত্যের উইকিপিডিয়ায় দিয়েছে বিশেষ স্থান ।
বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ' পথের পাঁচালী ' । পাঠক আপনাদের অবশ্যই স্মরণে আছে , জগৎখ্যাত চলচিত্র স্রষ্টা শ্রী সত্যজিৎ রায় সমীপেষু , বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের এই অমর সৃষ্টির চিত্ররুপ দেওয়ার কৃতিত্ব স্বরূপ ' অস্কার ' দ্বারা সন্মানিত হয়েছিলেন । উপন্যাসটিতে বিভূতিভূষণ দারিদ্রের ছবি দেখিয়েছেন , কিন্তু ব্যতিক্রমীভাবেই তা নিয়ে তিনি কণ্ঠ উচ্চ করেননি , বিদ্রোহের সুর প্রকটিত হয়নি তাঁর কথন ভঙ্গিমায় । বরং দুঃখকে তিনি অনুভব করেছেন , উপভোগও করেছেন । বিভূতিভূষণ লিখলেন , ' যে জগৎকে আমরা প্রতিদিনের কাজকর্মে হাটে ঘাটে হাতের কাছে পাইতেছি জীবন তাহা নয় , এই কর্মব্যস্ত অগভীর একঘেয়ে জীবনের পিছনে একটি সুন্দর পরিপূর্ণ , আনন্দভরা সৌম্য জীবন লুকানো আছে - সে এক শাশ্বত রহস্যভরা গহন গভীর জীবন - মন্দাকিনী , যাহার গতি কল্প হইতে কল্পান্তরে ; দুঃখে তাহা করিয়াছে অমৃতত্বের পাথেয় , অশ্রুকে করিয়াছে অনন্ত জীবনের উৎসধারা । '
এই অনন্য ভাবনায় বিভূতিভূষণকে বিশিষ্টতা দিয়েছে , তাঁর সাহিত্যে জীবনের প্রতি তেমন কোন অভিযোগ নেই । বরং প্রাত্যহিক জীবনের দুঃখ বেদনাকে তিনি সাদরে গ্রহণ করেছেন , তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেননি ।
বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের কথাসাহিত্যের উপাদান এবং বিষয়বস্ত্ত সামান্যই , সাধারণ , চমকপ্রদ নয় একেবারেই । সেখানে বঙ্কিমের মত পান্ডিত্যের আস্ফালন নেই , সহজ সরল গ্রামীণ গণ মানুষের জীবন তাঁর আশ্রয় । ব্যক্তিজীবনে তাঁর পৃথিবী যাপন ছিল সাধারণ মানের । জীবনের শেষ দশবছর কিছুটা আর্থিক স্বচ্ছলতা এলেও , জীবনের সিংহভাগটাই দারিদ্র সঙ্গী ছিল তাঁর । শিক্ষক হিসাবেই তিনি ছাত্র পড়িয়েছেন কিছুটা কলকাতায় এবং বেশিরভাগ সময় গ্রামবাংলার বিদ্যালয়ে । তাঁকে টানত ঈশ্বর এবং প্রকৃতি । ভ্রমন ছিল নেশা । বাংলার গ্রামে শিক্ষকতা করবার অভিজ্ঞানেই তিনি সাধারণ দারিদ্র গণমানবের জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখবার সুযোগ পেয়েছিলেন । বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন , ' বাংলাদেশের সাহিত্যের উপাদান বাংলার নরনারী , তাঁদের দুঃখ - দারিদ্রময় জীবন , তাদের আশা - নিরাশা , হাসি - কান্না - পুলক - বহির্জাগতের সঙ্গে তাদের রচিত ক্ষুদ্র জগৎগুলির ঘাত প্রতিঘাত , বাংলার ঋতুচক্র , বাংলার সন্ধ্যা - সকাল , আকাশ - বাতাস , ফুল - ফল , - বাঁশবনের , আমবাগানের নিভৃত ছায়ায় ভরা সজনে ফুল বিছানো পথের ধারে যেসব জীবন অখ্যাতির আড়ালে আত্মগোপন করে আছে - তাদের কথায় বলতে হবে । তাদের সে গোপন সুখ - দুঃখকে রুপ দিতে হবে । '
বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের এই পবিত্র হৃদয় নির্মাণ তাঁর সাহিত্যকে মহনীয়তা প্রদান করেছে । মানুষ , প্রকৃতি এবং ঈশ্বর , এই তিন উপাদান মিলে গড়ে উঠেছে তাঁর মানসলোক , যা তাঁর সাহিত্যকথনকে দিয়েছে বিশ্বময় আলোকদ্যুতি ।
----------
আরিফুল ইসলাম সাহাজি
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন