জীবন ও সাহিত্যে মানিক বন্দোপাধ্যায় । আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
কেন লিখি ? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে উপরের কথা গুলো বলেছিলেন অমর কথা শিল্পী মানিক বন্দোপাধ্যায় সমীপেষু । একজন লেখকের , তিনি যদি সত্যিকার অর্থে লেখক হন তবে অবশ্যই , তাঁর মতাদর্শ এমন নির্ভেজাল হবে বইকী । অন্য কারও দ্বারা প্রভাবিত হওয়া তাঁর শোভা পায় না , কবি নির্মেল্দু গুণের একটি চরণবদ্ধ পদের কথা প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ছে , ' আমি আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মত নই । ' আসল কথা , সাহিত্য স্রষ্টা কখনই সাধারণ মানুষের মত নন , সব ঠিক বলে হাই তুলে তাঁদের ঘুমাতে যাওয়া হয় না । আধুনিক যুগেও আমরা তাই কবিকে জেলের ঘানি টানতে দেখি , অসাম্যের বিপ্রতীপে দাঁড়ানোর অপরাধে । মানিক বন্দোপাধ্যায়েরও নিজস্ব এক অনন্য মনন ও দৃষ্টিজাত ভঙ্গি ছিল । অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছিলেন , ' কল্লোলের কুলবর্ধন ' , আবার বুদ্ধদেব বসু , মানিক বন্দোপাধ্যায় সম্পর্কে লিখলেন , ' Belated Kollolian ' । শ্রদ্ধেয় উভয় কবি ও গবেষকের মানিক বন্দোপাধ্যায় সম্পর্কিত এই সম্ভাষণ পুরোপুরি যুক্তযুক্ত ছিল না । অবশ্য কল্লোলীয় আদর্শ তিনি গ্রহণ করেছিলেন , তবে তা সংযম এবং চিন্তার বিকিরণে ।
মানিক বন্দোপাধ্যায় তথাকথিত রোমান্টিসিজম পরিত্যাগ করে , জীবনকে দেখেছেন বাস্তবভূমিতে পদচরণা করে । বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি , জীবন জগৎকে তিনি বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখবেন সেটায় স্বাভাবিক । সমাজিক নানাবিধ সমস্যার গভীরে গ্রথিত তাঁর সাহিত্যের বেসাতি । গণমানবের ছোট বড় সব রকমের সমস্যার আবহের আস্বাদ রয়েছে তাঁর ছোটগল্প , উপন্যাস খনিতে । পরাজয়ের গ্লানি মানিক মানতে পারেন না , তাঁর গল্প উপন্যাসের চরিত্ররা দুঃখ কষ্টের সাথে লড়াই করে , নিয়তির কাছে নিজের ভাগ্য বেঁধে তাদের হা হুতাশ নেই , বরং সংগ্রামী কঠিন মানুষে পরিণত হওয়ার এক অনবদ্য গল্পের মুখোমুখি পাঠককে দাঁড় করান শিল্পী । আসলে , মানিকের মুখ ও মুখোশ আলাদা ছিল না , তিনি কখনও মুখোশই পড়েননি । অকবি লেখকদের মত আদর্শের পচা বুলি সাহিত্যে খাতায় লিপিবদ্ধ করতে তিনি আসেননি , ছাত্রাবস্থায়ই সমাজিক জীবন সমস্যা তাঁকে লিখতে অনুপ্রাণিত করতো ।' গল্প লেখার গল্পতে ' তিনি লিখলেন , ' ক্লাসে বসে মুগ্ধ হয়ে লেকচার শুনি , ল্যাবরেটরিতে মশগুল হয়ে এক্সপেরিমেন্ট করি , নতুন এক রহস্যময় জগতের হাজার সংকেত মনের মধ্যে ঝিকমিকিয়ে যায় । হাজার নতুন প্রশ্নের ভারে মন টলমল করে । ছেলেবেলা থেকে ' কেন ' ? মানসিক রোগে ভুগছি , ছোটবড় সববিষয়েই মর্মভেদ করার অদম্য আগ্রহ যে রোগের প্রধান লক্ষণ । '
মানিক বন্দোপাধ্যায় এই ' কেন 'র ? সমাধান দিতেই সাহিত্যে পদচারনা করলেন । গবেষক অরুণকুমার মুখোপাধ্যায় শিল্পীর মানস প্রতিমার স্বরুপ নির্ণয় করতে গিয়ে ' কালের পুত্তলিকা ' নামক গ্রন্থে লিখেছেন , ' মানিক বন্দোপাধ্যায় সংশয় , হতাশা , ব্যর্থতাবোধ ও অসহায়তাবোধের কাছে পরাজয় মেনে নেননি । মানিকের গল্প পাঠককে কুলহারা জীবন রহস্যের দিকে ঠেলে দেয় না , সংগ্রামী সংকল্প কঠিন মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি করিয়ে দেয় । বিজ্ঞানবুদ্ধি , সত্য এষণা , বস্ত্ত জিজ্ঞাসা মানিকের শিল্পী মানসকে গোড়া থেকেই ভাবালুতার হাত থেকে রক্ষা করেছে । '
আসলে , মানিক আদিম , মেকি কৃত্তিমতাকে একেবারেই গ্রাহ্য করেননি , তাঁর দৃষ্টিজাত ভঙ্গি বাস্তবের মাটিতে একেবারেই শরীর ঘেঁষে দাঁড়ানো । চরিত্রদের সুখ দুঃখ , মানসিক দ্বন্দের ওঠা নামা স্বদৃষ্টিজাত ভঙ্গিতে অবলোকন করেছেন তিনি । সমাজ , পরিবার প্রেম , মানুষ মাটি সব কিছু দেখবার একটা আলাদা ধরন ছিল মানিকের । সমালোচক কথাশিল্পী সন্তোষকুমার ঘোষ মানিক বন্দোপাধ্যায়ের দৃষ্টিজাত ভঙ্গি বিষয়ে যথার্থই বলেছেন , ' মানিক বন্দোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গে আসল ব্যাপার হল তাঁর নিজের চোখ । একেবারে জ্বলজ্বলে ড্যাবডেবে এক জোড়া চোখ । বোধ হয় তার রঞ্জনরশ্মিও ছিল । এমন আনকোরা নতুন চোখে জীবনকে তাঁর আগে কেউ দীর্ঘকাল দেখেননি । '
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের লেখ্যসময় মূলত দুই বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরাধীন ভারত । সমকালীন যুগ ও প্রেক্ষাপট কোনটাই খুব সাবলীল সচল ছিল না । বরং আনহার , শোষণ অত্যাচার এবং দুর্ভিক্ষ পীড়িত সে সময় । ফলত , গণমানবের জীবনের বড্ড দুঃসময় মানিককে স্বচোখে দেখতে হয়েছে । মধ্যবিত্ত জীবনের সংকীর্ণতা , দরিদ্রের আকুতি , স্বপ্নভঙ্গের পাহাড়প্রমাণ সব দৃষ্টান্ত , নিঃসঙ্গতাবোধ , হতাশা সমকালের জীবনকে বিকারগ্রস্থ অসহায় করে তুলেছিল । মানিক এই অসহায় জীবনের গল্প বলেছেন তাঁর সাহিত্যে । প্রয়োজনেই তিনি মার্কস কিম্বা ফ্রয়েডের স্মরণ নিয়েছেন । এই বাস্তবধর্মী মনন দ্বারা পরিচালিত হওয়ার অভিজ্ঞানই তাঁকে কল্লোলীয়দের থেকে পৃথক সত্ত্বায় দাঁড় করালো । কল্লোল গোষ্টির আবেগের আতিশয্য এবং বিদ্রোহের নামে যৌবন ধর্মের অপচয়কে মান্যতা দিতে পারলেন না মানিক । সরে দাঁড়ালেন ওঁদের নির্দেশিত পথ থেকে , তৈরি করলেন স্বঘরানা ।
রবীন্দ্র শরৎ উত্তর কথাসাহিত্যে মানিক বন্দোপাধ্যায় নব রক্ত বহন করে আনলেন । সমকালের অন্য দুই বন্দোপাধ্যায় বিভূতিভূষণ ও তারাশঙ্করের মত একক স্বতন্ত্র সাহিত্য বোধের আস্বাদ পেলেন বাঙালি পাঠক তাঁর সাহিত্য বেসাতিতে । বাস্তবের গভীরে অনায়াস যাতায়ত তাঁর , ডুব দিলেন জীবন জটিলতার পরদে । সমাজিক সমস্যা সমূহ এবং ব্যক্তির পতনের নেপথ্যের কথন লিখতে এলেন তিনি । ব্যক্তিজীবনের অন্তঃসারশূন্যতা , নীচতা , অস্তির পাশবিকতা , ভদ্রতার আড়ালে মুখোশের ছবি অবলীলায় উন্মোচিত করলেন মানিক । আসলে সমাজ ও গণমানবের কঙ্কালসার রুপ তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন , উপলব্ধি করেছেন । তিনি নিজে লিখেছেন , ' যে জীবনকে ঘনিষ্ঠভাবে জেনেছি বুঝেছি সেই জীবনটাই সাহিত্যে কিভাবে কতখানি রূপায়িত হয়েছে এবং হচ্ছে সেটাও সাহিত্যিককে স্পষ্টভাবে জানতে ও বুঝতে হবে , নইলে নতুন সৃষ্টির প্রেরণাও জাগবে না , পথও মুক্ত হবে না । ' ( সাহিত্য করার আগে)
কথাশিল্পী সন্তোষ কুমার ঘোষ যথার্থই উল্লেখ করেছিলেন , সমাজ জীবনকে দেখবার ' একেবারে জ্বলজ্বলে , ড্যাবডেবে চোখ ' আছে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের । এই স্বসমাজ দর্শন , সমাজ ও গণমানবের উপর অপরিসীম মমত্ববোধ মানিক বন্দোপাধ্যায়কে স্বতন্ত্রতা দান করেছে । ছোটগল্প , উপন্যাস প্রায় সর্বত্রই তিনি ন্যায় নীতির পক্ষ অবলম্বন করেছেন । অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিজাত ভঙ্গিতেই দেখেছেন দেশ কালের মানুষকে । গল্প উপন্যাসে উপস্থাপন কৌশলতা , গল্পের বিষয় নির্বাচন , শব্দের পরিমিত ব্যবহার মানিক বন্দোপাধ্যায়কে জনপ্রিয় করে তুলেছে । সমালোচক ভূদেব চৌধুরী মানিক বন্দোপাধ্যায়ের গুরুত্ব নিরূপন করতে গিয়ে তাঁর ' বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্প ও গল্পকার ' নামক গ্রন্থে লিখেছেন , ' আমাদের কথাসাহিত্যে মানিক বন্দোপাধ্যায় নতুন আগুনের এক মস্ত মশাল ; বুঝি দেশকালের প্রতিকূলতার ফলেই সে মশাল আকাশে ঊর্ধ্বশিখা মেলে জ্বলবার সাধনায় অনেকখানি ধোঁয়া আর ছাই হয়ে নিঃশেষিত হয়ে গেল । এই মহৎ বিনষ্টি ইতিহাসের পরম জিজ্ঞাসার উপকরণ , একদিন তার উত্তর নিজের প্রয়োজনেই খুঁজে পেতে হবে দেশকে - দেশের সাহিত্যকে । '
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন