মুসলিম গণসমাজ শিক্ষার আলোকে প্রজ্বলিত হোক । আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।




একটি জাতির উন্নয়নের পরিআবহিক মন্ডল কেমন হবে , সেই বিষয়টি নির্ভর করে সেই জাতির গণমানুষরা নিজেদেরকে সত্যকার অর্থেই কতখানি মানবসম্পদে পরিণত করতে পারছে । মানবসম্পদ শব্দবন্ধটির উপস্থাপন করলাম যেহেতু , এর একটা ব্যাখ্যাপূর্ণ পরিআবহ সৃষ্টি করলে পাঠক বুঝবেন । মানবসম্পদ বললে সকল মানবকেই সম্পদ হিসাবে ধারণা করা হচ্ছে , এমন ভাবলে ভুল করা হবে । মানবসম্পদ সেই মানবগোষ্টিকে বলা হবে যাঁরা মানব সভ্যতার কল্যাণের নেপথ্যে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন । যে জাতি ধর্ম রাষ্ট্রের মানসম্পূর্ণ মানবের সংখ্যা অধিক হবে , তাঁরা নিঃসন্দেহে অগ্রগতির সোপান ধরে পর্বতের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে সবার আগে অবতরন করবে , সে বিষয়ে দ্বিমত নেই । এখন প্রশ্ন উঠতেই মুসলিম গণসমাজ ক্রমে অধঃপতিত সভ্যতার প্রতিভূর প্রতিনিধিত্ব কেন করছে ? উপরের ব্যাখ্যানুযায়ি বলতে হয় , মুসলিম গণসমাজ নিজেদেরকে মানবসম্পদে পরিগণিত করতে অক্ষম হচ্ছেন । বিষয়টি একেবারেই সেইরকম । মুসলিম সমাজ ক্রমশঃ শিক্ষাদীক্ষায় নিজেদেরকে দৈন্য করে তুলছেন । নারীদের শিক্ষার প্রচলন কিছুটা হলেও এখনও টিকে আছে , কিন্তু দুঃখের বিষয় মুসলিম গণসমাজে পুরুষ শিক্ষার হার আশঙ্কাজনক কম । গ্রামে  কিম্বা মেটিয়াব্রুুজ কিম্বা দিল্লি চেন্নাই এ সেলাই কাজ , রাজমিস্ত্রি , কৃষিশ্রমিক , ক্ষুদ্রব্যবসার সঙ্গেই বেশিরভাগ নিয়োজিত । আমার সহকর্মী একদিন ঠাট্টার সুরে বলেছিলেন , শিশু শ্রমিকদের ৯৫ শতাংশ আপনাদের সম্প্রদায়ভুক্ত । কোন উত্তর দিতে পারেনি , দেবো কিভাবে , উত্তরই তো নেই ।  

জাতির অধঃপতনকে রুখে দিতে যোগ্য নেতার ভীষণই প্রয়োজন । দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার পর থেকে সংখ্যালঘুরা একপ্রকার নেতৃত্বহীন হয়েই কালযাপন করছেন । দেশবিভাগের পর পাটের উৎকর্ষময় কৃষিজমি পড়েছিল ওপার বাংলায় , আর এপার বাংলার ভাগে  পড়েছিল কারখানা । মুসলমানদের অবস্থাও তেমনি হয়েছিল , দেশভাগের পর মুসলিম নেতাগণ পাড়ি জমান ওপার বাংলায় , আর এপার বাংলায় থেকে যান সিংহভাগ মুসলমান । ফলে মেধাশূন্য এ জাতির কতটুকু উন্নয়ন সম্ভব ? ফলে মুসলমানদের আশানুরুপ উন্নয়নও লক্ষ্যগোচর হয়নি কোনকালেই । বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যায় , মুসলমান পাড়া , মহল্লা দিয়ে গেলে । চাকরি নেই , বৈভবপূর্ণ ব্যবসায়িক প্রতিষ্টান নেই । সমাজিক ভাবে অপেক্ষাকৃত কমদামী কাজের সঙ্গেই সম্পৃক্ততা মুসলমান সমাজের অধিকাংশ গণমানবের । 

প্রথম থেকেই , অর্থাৎ স্বাধীনতা পরবর্তীকাল থেকেই মুসলমান জনজাতি যে যোগ্য নেতার অভাববোধ করেনি এমনটি কিন্তু নয় । লিডার ক্রাইসিসের মধ্যে মুসলমান সমাজের মুখ হয়ে উঠেছেন মৌলবি মৌলানাগণ । এদের মধ্যে অনেকেই (ব্যাতিক্রম আছেন অবশ্যই ) জাতির উন্নয়ন বিষয়ে খুব একটা ভাবিত ছিলেন না কোন কালেই । তাঁরা নিজেদের পেটপূজার দিকটাই দেখে গেছেন সর্বক্ষণ । অথচ ইসলামে অর্থ , ভোগবিলাসকে তেমন প্রধান্যই দেওয়া হয়নি । এই উন্নাসিক মানসিকতাও মুসলমানদেরকে ক্রমে অনগ্রসরতার দিকে এগিয়ে দিয়েছে , এবিষয়ে তেমন সন্দিহান হওয়ার দরকার আছে বলে মনে হয়না । জাতির নেতাদের মধ্যে সে স্বঘোষিত কিম্বা অন্য কোন নেতাগণ যদি সমাজিক উন্নয়নের পরিবর্তে ব্যক্তিক উন্নয়নের আপ্তবাক্যে আস্থাশীল হয়ে পড়েন , সেই জাতির পক্ষে সেটা মোটেও মঙ্গলময় আবহ গড়ে দিতে পারে না । 

মুসলিম সমাজের উন্নয়নে অনেক সুহৃদ কাজ করছেন , তবে একটি জাতির উন্নয়নের জন্য যে ব্যাপক কর্মোদ্দমের প্রয়োজন সেটা মুসলমান সমাজের মধ্যে কোনদিনই ছিল না , বললে খুব একটা ভুল বলা হবে বলে মনে হয় না । শিক্ষার অভাব নিঃসন্দেহে এ জাতির অনগ্রসরতার মূল কারণ , বিষয়টি সূর্যোদয়ের মত সত্য । ছোট থেকেই একটা ভুল কথার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছি আমরা , বিদ্যা বড় না বুদ্ধি বড় । এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হলেই মা কাকিমাদের দেওয়া উত্তরটি ছিল , না বিদ্যা নয় , বুদ্ধি বড় । একটু বড় হয়ে , বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারি , উত্তরখানি সম্পূর্ণ ভুল । বিদ্যার থেকে বুদ্ধি কখনও বড় হতে পারে না । আসল কথা হল , বিদ্যা যদি আপনার মধ্যে না থাকে , তাহলে বুদ্ধিটা জন্মাবে কিভাবে ? বুদ্ধি এবং বিদ্যা তো একে অপরের পরিপূরক । একটির অভাব অন্যটির উৎকর্ষতায় বাধার সৃষ্টি করে , বিষয়টি ছোটবেলায় অনুধাবন করতে পারিনি ।


মুসলমান যুবাপুরুষদের মধ্যে শিক্ষার বহরগত আগ্রহ ক্রমে ভয়ঙ্কররকম কমে আসছে । মুসলমান সংখ্যাধিক্য এলাকায় অবস্থিত বিদ্যালয়গুলির ছাত্র ও ছাত্রীর অনুপাতগত পার্থক্য দেখলে বিষয়টি বেশ সহজেই অনুমিত হয় । বিশেষ করে গ্রামপ্রধান মুসলিম জনপদ সমূহের অবস্থা খুব খারাপ । এই সমস্ত জায়গাতে পুরুষ শিক্ষার রুগ্নদশা আগামী দিনে মুসলমান সমাজকে হয়তো আরও বেশি শঙ্কিত করবে , এমন আশঙ্কা অমূলক নয় । মুসলমান নারীদের শিক্ষার যথেষ্ট উন্নয়ন লক্ষ্য করা গেছে , এ বিষয়টি অস্বীকার করবার মত নয় । তবে , শুধুমাত্র নারী শিক্ষার উন্নয়নের মধ্য দিয়ে একটি জাতি সম্মৃদ্ধ কখনই হতে পারে না । নারী শিক্ষার পাশাপাশি পুরুষ শিক্ষার প্রবাহের উন্নয়ন সম্ভব না হলে মুসলমান সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয় , এই বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠা দিতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে তো মনে হয় না । 

মুসলমান গণসমাজ যেহেতু স্বশিক্ষায় নিজেদেরকে প্রজ্জ্বলিত করতে পারেনি , এই অভাব মুসলমান সমাজকে বিজ্ঞানমনস্ক হতে বাধা দিয়েছে । দেশ ও সমাজগত অভিজ্ঞান কোন পথে বাঁক নিচে এ বিষয়ে তাঁদের একপ্রকার কোন ধারণায় তৈরি হতে দেখা যায় না । আসলে এরা ওতটা ভাবিত নয় , সব ভাবনা কর্তার ভূতের মত তথাকথিত কিছু মৌলবির উপর দিয়েই তাঁরা শান্তিযাপনে ব্যস্ত । দুঃখের বিষয় , কিছু ধর্মীয় নেতা সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটি ঠিকঠাক করেননি , এখনও করেন না । সকলেই এমন এরকম কথার প্রতিষ্ঠা দিলে অন্যায় হবে । অনেক ধর্মপ্রবণ মহাপ্রাণ জাতির উন্নয়নের নিমিত্তে কাজ করছেন , তবে সম্মিলিতভাবে কখনই সম্ভব হয়নি । এর নেপথ্যে কিছু কারণ রয়েছে , প্রথমত ঐক্যমতের অভাব রয়েছে নেতৃত্ববর্গের মধ্যে । সকলেই প্রধানতম ধর্মীয় নেতা হওয়ার ইচ্ছা রাখেন । ফলে মুসলমান নেতারা কখনও এক টেবিলে আজও পর্যন্ত সমবেত হতে পারলেন না । সমাজকে সঠিক পথ দেখাবার বিষয়ে তাঁরা অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছেন , এমন কথা বলা খুব একটা বেঠিক হবে বলে মনে হয়নি । ইসলাম ধর্মপন্থী সেসকল ধর্মীয় নেতাগণ আছেন , অর্থাৎ যাঁদের অঙ্গুলি হেলনে পরিচালিত হয় মুসলমান কৌম , তাঁদের উচিৎ শিক্ষার উপর জোর দেওয়া । কেননা , শিক্ষা ব্যতীত জাতির উন্নয়ন সম্ভব নয় , এই বিষয়টি ভুললে চলবে না । 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।