ওপার বাংলার কাব্য কবিতার শরীরী বিনির্মাণ । আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।



প্রাবন্ধিক অধ্যাপক অনিরুদ্ধ আলি আকতার সম্পাদিত ' বাংলাদেশের কবি ও কাব্য ' নামক একটি অনন্য স্বাদের প্রবন্ধ গ্রন্থ পাঠ করলাম । গ্রন্থটির আধার হিসাবে নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশের কাব্যময় স্বর্ণাজ্বল আখ্যান । গ্রন্থটি বিষয় নির্বাচনের দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে , কেননা এপার বাংলা থেকে কাঁটাতারের ওপ্রান্তের সাহিত্যমানস গণের দিকবলয় সম্পর্কিত অভিজ্ঞান সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিবহাল হওয়া এপার বাংলার সাধারণ গণ পাঠকের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠে না । সেইদিক থেকে সম্পাদক মহাশয়ের প্রচেষ্টাকে কুর্নিশ করতেই হয় ।

গ্রন্থটি কমবেশি পাঁচশত পাতায় বিন্যস্ত । দুই বাংলার উনচল্লিশ জন স্বনামধন্য কবি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান সহ অধ্যাপক মন্ডলীর কলমের আঁচড়ে বিধৃত এ গ্রন্থখানি । গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে পূর্ববঙ্গের জাতীয় কবি  কাজী নজরুল ইসলাম এবং  বরিষ্ঠ কবি মাননীয় শঙ্খঘোষ মহাশয়কে ।  প্রখ্যাত কবি ও অধ্যাপিকা ড.কৃষ্ণা বসু , কবি ও রবীন্দ্রগবেষক আহমদ রফিক , প্রখ্যাত অধ্যাপক সমালোচক মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং পূর্ববঙ্গের ভারতে নিযুক্ত উপ হাইকমিশন মো. মোফাকখরুল ইকবাল প্রমুখ তাঁদের শুভেচ্ছা বার্তায় যারপরনাই উচ্ছ্বাস এবং গ্রন্থটি উভয় বাংলার সাহিত্য প্রেমীদের কাছে অসম্ভব আদরনীয় হবে বলেও আশা ব্যক্ত করেছেন । 
এছাড়াও গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা দুই ব্যক্তিত্ব রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক সফিকুন্নবী সামাদী এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ইসমাইল সাদী । 

গ্রন্থটি পাঠ করবার মানসে পুস্তকটি খুললেই পাঠক প্রথমেই মুখোমুখি হবেন একালের শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক  অধ্যাপক পবিত্র সরকারের  ' হক ভাই ' নামের লেখাটির । প্রবন্ধের যে ধাঁচ সেই আবর্তের বাইরে উপস্থিতি এই লেখাটির । ওপার বাংলার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য ব্যক্তিত্ব  শামসুল হকের সঙ্গে ব্যক্তি পবিত্র সরকারের মধ্যে যে অন্তরাত্মাময় পরিআবহ ছিল সেই গল্প পাঠক শুনতে পাবেন এই প্রবন্ধে । অতঃপর সম্পাদকীয় ভাবনাটিও পাঠককে পড়া উচিৎ । এত সহস্র বিষয় থাকতে হঠাৎ করেই কেন বাংলাদেশের কবি ও কবিতা নিয়ে কাজ করতে গেলেন সম্পাদক তার কৈফিয়ত দিয়েছেন এই অংশে , সম্পাদক লিখলেন , ' একই ভাষা - সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে বিকশিত হওয়া বাংলা কবিতার বলয়ে ১৯৪৭ পরবর্তী বিভাজিত ভূখন্ডের ওপারের কবি ও কবিতার যে পথরেখা নির্মিত হয়েছে , তা এপারের অনেকের কাছেই ধোঁয়াশায় ঢাকা । ঘ্রাণে অর্ধ ভোজনের মতো কয়েকটা পত্র - পত্রিকা বা সংকলিত গ্রন্থ অথবা হাতেগোনা কয়েকটা আলোকপাতই এপারের কবিতাপ্রেমী বা রসিক পাঠকের মূলধন । এপার থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের কবিতার দু - একটা সংকলন হয়তো নির্বাচিত কবিতাগুচ্ছের নান্দনিক বা দার্শনিক চিন্তনকে আংশিক বুঝতে সাহায্য করেছে কিন্তু কবি ও কবিতা সম্পর্কে সামগ্রিক ছবি তুলে ধরার ক্ষেত্রে এই ধরনের প্রয়াস যথেষ্ট নয় । এসব ভাবনা মাথায় রেখেই ' বাংলাদেশের কবি ও কাব্য ' গ্রন্থটির পরিকল্পনা । ' 

একালের প্রখ্যাত কবি মৃদুল দাশগুপ্তের ' শিখরে , সুউচ্চস্থানে ' নামের প্রবন্ধটিও পাঠককে ভীষণরকম ভাবে মুগ্ধ করবে । কবি দাশগুপ্ত ওপার বাংলার শ্রেষ্ঠতম কবি আল মাহমুদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করেছেন । অনেকগুলো প্রশ্নও তিনি তুলেছেন , যেমন বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠতম কবি হওয়া সত্ত্বেও একটা সময় বাংলাদেশের কবিকুল আল মাহমুদকে প্রায় একঘরে করে দিয়েছিলেন , কোন সভাসমিতিতে তাঁর ডাক পড়তো না , মূলধারার প্রকাশনাও কবির কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করা এক প্রকার বন্ধ করে দিয়েছিল। কবি মৃদুল নেপথ্যের কারণ হিসাবে বলেছেন আল মাহমুদ এরশাদ ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত হওয়া এবং স্বজীবনের শেষপর্বে তিনি ইসলামী আধ্যাত্মিকতায় মগ্ন হয়ে ওঠা  । কেউ ধর্মবিশ্বাসী হলেই তাঁকে বয়কট করতে হবে , এটা মানতে পারেন না কবি দাশগুপ্ত , তিনি লিখলেন , ' আমি নাস্তিক , তাবলে শিখরে , সুউচ্চ স্থানে বিরাজমান ওই মহাকবিকে দেখতে পাব না , তেমন তো নয় । ' 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট কবি বায়তুল্লাহ কাদেরীর ' শামসুর রাহমানের কবিতা : নাগরিক কবির দস্তখত ' শিরোনামের লেখাটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ । বাংলাভাষা শ্রেষ্ঠ কবি ব্যক্তি  শামসুর রাহমান এবং তাঁর কবিতা বিশ্বকে জানতে প্রবন্ধখানি পাঠকের বেশ সহায়কই মনে হবে । রবীন্দ্র পুরষ্কার প্রাপক প্রাবন্ধিক অধ্যাপিকা বেগম আকতার কামালের ' একুশ শতকে কবিতার হালচাল ' নামের প্রবন্ধখানি একুশ শতকের বাংলাদেশের কাব্যময় জগৎকে দেখবার এক অনন্য উপলব্ধি সঞ্চার করে । প্রাবন্ধিক অত্যন্ত দক্ষভাবে পাঠকের হাতে তুলে দিতে সক্ষম হয়েছেন ভাবনার আরশি । বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অধ্যাপক শিমুল মাহমুদের ' কাকচক্ষু কবিতার খোঁজে ' শিরোনামের প্রবন্ধটির মধ্যে বাংলাভাষী পাঠক এক অনন্য কাব্যআস্বাদ পাবেন । কবিতা বিষয়ে প্রাবন্ধিকের গবেষণালব্ধ মানসগঠন পাঠককে ভীষণরকম সমৃদ্ধ করবে । 

খ্যাতনামা প্রাবন্ধিক ইসমাইল সাদীর ' একটি কবিতা -জন্মের আত্মকাহিনী ও আহসান হাবীব ' শিরোনামের প্রবন্ধটি পাঠে পাঠক বিমুগ্ধ হবেন । অনিরুদ্ধ আলি আকতারের ' মুর্তজা বশীর : কবিতার বসন্ত কোকিল ' নামক প্রবন্ধটি গ্রন্থটির উজ্জ্বলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে । প্রসঙ্গত বলা দরকার মুর্তজা বশীর হলেন মহান ভাষাবিদ ড . মুহম্মদ শহীদুল্লাহের পুত্র । পিতার যোগ্য উত্তরাধিকার হিসাবেই পেয়েছেন একুশে পদক এবং স্বাধীনতা পদক । মূলত তিনি চিত্রশিল্পী , কবিতাও লিখেছেন নিয়ম করে । তবে চিত্রশিল্পী হিসাবে খ্যাতনামা হওয়ায় তাঁর সাহিত্য প্রবাহের আলোচনা খুব একটা গতি পায়নি । অধ্যাপক আকতার সেই কাজটিই করেছেন । এছাড়াও মীম মিজানের '  শব্দশিল্পের ব্যঞ্জনা : মূর্ত হয়েছে শেখড় , দেশ ও কাল ' শিরোনামের লেখাটি মারাত্মক আলোকদ্যুতি সম্পূর্ণ । প্রবন্ধটি পাঠের মধ্যে পাঠক ওপার বাংলার কাব্যজগৎ সম্পর্কে একটা হিমেল বাতাস পেতে পারেন । প্রাবন্ধিক আবু তাহেরের ' প্রেম ও রোমান্টিকতার কবি মহাদেব সাহা বাস্তবকে উপেক্ষা করেননি ' শিরোনামের প্রবন্ধটিও বেশ উজ্জ্বল । 

বৃহৎ বিস্তৃত এই প্রবন্ধ গ্রন্থটির সবচেয়ে বড়ো সম্পদ হল সাহিত্যক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর রকম প্রতিষ্টিত উনচল্লিশ জন বিদগ্ধ সমালোচকের ভিন্ন মনন ও আঙ্গিকের লেখা সমূহ । প্রাবন্ধিকগণ এসময়ের অন্যতম কবি - লেখক , কিম্বা কলিকাতা - বর্ধমান - গৌড়বঙ্গ - ঢাকা - জাহাঙ্গীর নগর - রাজশাহী - বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ অধ্যাপক , বিভাগীয় প্রধান । ফলত গ্রন্থটির আলোচনার পরিঅববাহিকাও রৌদ্রজ্জ্বল হয়েছে । প্রান্তভাগে উপনীত হয়ে এটুকুই বলা যায় , গ্রন্থটি দুই বাংলার সংস্কৃতিক মেলবন্ধনের শিকড়কে আরও গভীরজাত করতে সক্ষম হবে । 



লেখক 
আরিফুল ইসলাম সাহাজি 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

নুন - জয় গোস্বামী । Online Mock Test