' বিদ্রোহী ' প্রকাশের পর নিন্দুকদের প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়েন কাজী নজরুল ইসলাম। আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
কাজী নজরুল ইসলামের অমর কালজয়ী কবিতা ' বিদ্রোহী ' । ১৯২১ - এর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে কলকাতার তালতলা লেনের বাসাবাড়িতে একদিন একটি নিঃশব্দ বিস্ফোরণ ঘটল । কবি লিখলেন ,
' বল বীর
বল উন্নত মামা শির !
শির নেহারি আমার নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির ' ।
কলকাতার তালতলা লেনের ৩ /৪ সি বাড়িটি বিদ্রোহী কবিতার জন্মস্থল । দ্বিতল বাড়িটির নীচতলার দক্ষিণ পূর্ব ঘরটিতে ভাড়ায় থাকতেন কবি নজরুল ইসলাম এবং কবিবন্ধু বিশিষ্ট সমাজকর্মী কমরেড মুজাফ্ফর আহমেদ ।
' বিদ্রোহী ' কবিতার প্রথম শ্রোতা ছিলেন কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ ।' বিদ্রোহী ' কবিতা সম্পর্কে আলাপচারিতাই মুজাফ্ফর আহমেদ লিখেছেন , ' কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর বিদ্রোহী কবিতাটি লিখেছিল রাত্রীতে । রাত্রীর কোন সময়ে তা আমি জানি না । রাত ১০ টার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে আমি বসেছি এমন সময় নজরুল বলল , সে একটি কবিতা লিখেছে । পুরো কবিতাটি সে তখন পড়ে শোনাল । ' বিদ্রোহী ' কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা । ' কবিতাটি কখন লেখা হয়েছিল , সে প্রসঙ্গে মুজাফ্ফর আহমেদ লিখেছেন , ' আমার মনে হয় নজরুল ইসলাম শেষ রাতে উঠে কবিতাটি লিখেছিল । তা না হলে এত সকালে আমায় কবিতা পড়ে শোনাতে পারত না । তাঁর ঘুম সাধারণত দেরিতেই ভাঙত , আমার মত তাড়াতাড়ি তার ঘুম ভাঙত না । ' [ কাজি নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা - মুজাফ্ফর আহমেদ ]
কবিতাটি প্রথম কোন পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল , এই বিষয়ে বিতর্ক আছে । কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ,' বিজলি'তে ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি , বাংলা ২১ পৌষ ১৩২৮ -এ । কবি প্রকাশের জন্য কবিতাটি প্রথম দিয়েছিলেন ' মোসলেম ভারত ' পত্রিকার আফজলউল হক সাহেবকে । ' মোসলেম ভারত ' এর কথিত সংখ্যাটি বার হতে দেরি হওয়ায় কবি ' বিদ্রোহী ' কবিতাটি' বিজলী 'তে প্রেরণ করেন এবং সেটি আগেই প্রকাশিত হয় । সেইদিক থেকে দেখলে ' বিজলী 'তেই কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ।' মোসলেম ভারত ' - এ কবিতাটি প্রকাশিত হয় ১৩২৮ -এর কার্তিক সংখ্যায় । ' প্রবাসী' তে প্রকাশিত হয় ১৩২৮ -এর মাঘ সংখ্যায় আর ' সাধনা'য় ১৩২৯ -এর বৈশাখ সংখ্যায় এবং ' ধূমকেতু'তে ২২ আগষ্ট ১৯২২সালে ' বিদ্রোহী ' কবিতাটি প্রকাশিত হয় ।
কবিতাটি সেই সময় সারা দেশকে আন্দোলিত করেছিল (এখনও ...)। একাধিক পত্র পত্রিকাই সহস্রবার মুদ্রিত হয়েছে কবিতাটি । রাতারাতি কাজী সাহেবের কাব্যখ্যাতির নেপথ্যেও এই কবিতাটির অবদান সসীম । কবিতাটি যেমন নজরুল ইসলামকে খ্যাতির চূড়ায় উপনীত হতে সাহায্য করেছিল , তেমনি কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত বিতর্কের জন্মও দিয়েছিল কবিতাটি । নজরুল অনুগামী মোহিতলাল মজুমদারের মনে হয়েছিল , ' বিদ্রোহী ' কবিতার আত্মবাচক ' আমি' শব্দটি কাজী তাঁর রচিত ' আমি ' নামক প্রবন্ধ থেকে বিদ্রোহী কবিতায় উপস্থাপন করেছেন । মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় মোহিতলালের এই অভিযোগ খণ্ডন করে ' মোসলেম ভারত ' সম্পাদককে একটি চিঠিও লেখেন । এই বিষয়টি সেই সময় কবিকে বিড়ম্বনায় ফেলেছিল । সাহিত্য মোহিতলালের সঙ্গে কবির সম্পর্কও তলানিতে পৌঁছে গিয়েছিল । যদিও , সমালোচক মোহিতলালের এহেন ভাবনা অহেতুক এবং অমূলক । কেননা , মোহিতলাল মজুমদার যে প্রবন্ধটির ভাববস্ত্ত আত্মস্থ করবার অভিযোগ নজরুলের উপর এনেছিলেন , সেটি তাঁর মৌলিক কোন রচনা নয় । ক্ষেত্রমোহন বন্দোপাধ্যায় রচিত ' অভয়ের কথা ' প্রবন্ধের ভাববস্তু ধারণ করে তিনি লিখেছিলেন ' আমি' নামক প্রবন্ধখানি । সাহিত্যে কোন বিষয় ভাবনা থেকে অনুপ্রাণিত হওয়া দোষের কিছু নয় ।
কবিতাটির প্রকাশ নজরুলকে বহুল আলোচিত করে তোলে । কবিকে হিসাবে প্রতিষ্ঠা পান নজরুল । ' বিদ্রোহী ' তখন জনমানবের গণসঙ্গীত হিসাবেই গীত হতে থাকে । কবি পেলেন বিদ্রোহী কবির তকমা । কাব্যজগতে হঠাৎ করেই কবির এই গৌরবময় অবস্থান ও প্রতিপত্তি মেনে নিতে অনেক সাহিত্যমানসের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াল । এঁদের মধ্যে নেতৃত্বস্থানীয় ছিলেন ' শনিবারের চিঠি ' সাহিত্যপত্রের সম্পাদক সজনীকান্ত সেন ।সজনীকান্ত প্যরোডি (ব্যঙ্গাত্মক কবিতা ) লেখায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন । তিনি প্রায় সকল সমসাময়িক কবিবর্গের বিরুপ সমালোচক ছিলেন (মাইকেল মধুসূদন দত্তকেও ছাড়েননি সজনীবাবু)। ' বিদ্রোহী ' কবিতাটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সজনীকান্তের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠেন কাজী নজরুল ইসলাম ।' বিদ্রোহী ' কবিতার ভাঁড়সদৃশ একটি প্যরোডি লিখলেন সজনীকান্ত -
' আমি ব্যাঙ
লম্বা লম্বা ঠ্যাং
ভৈরব রসে বরষা আসিলে ,
ডাকি যে ঘ্যাঙর ঘ্যাঁং
আমি ব্যাঙ । '
শুধু ' বিদ্রোহী ' কবিতা নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেই ক্ষান্ত হননি সজনীকান্ত । সরাসরি কবি নজরুল ইসলামকে ব্যক্তি আক্রমণ করতেও পিছপা হননি তিনি । সজনী লেখেন -
' গাজী আব্বাস বিটকেল
কল্লি মহাখিটকেল !
লিখে ফেললি কাববি
তাও আবার ছাপবি ?
ছাপলেও কাটবে না
কেউ তা চাটবে না । '
শুধু সজনীকান্ত নন , তাঁকে দেখাদেখি অন্যান্য সজনী অনুসারী কবিবর্গও নজরুল ইসলামকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করে তুললেন । অশোক চট্টোপাধ্যায় লিখলেন -
' ভাবি শ্বশুরের হিসাব খতিয়া
তরুণ বাঙ্গালি সাগর মাথিয়া
উঠেছি যে আমি নিছক শুদ্ধক্ষীর
আমি বীর ! '
শুধু প্যরোডিই নয় , বিদ্রোহী প্রকাশের পর পরই একাধিক পত্র পত্রিকায় কবি এবং' বিদ্রোহী ' কবিতা বিরোধী নিন্দায় মুখর হয়ে উঠলেন সমকালীন কবি নামের অকবিগণ । তেমনই একজন ' ইসলাম দর্শন ' পত্রিকার সম্পাদক আব্দুল হাকিম ১৩২৯ এর কার্তিক সংখ্যায় লিখলেন ' বিদ্রোহ দমন ' । কয়েকটি চরণ -
' ওগো বীর
অসংযত বিদ্রোহী অধীর ।
সংযত হয়ে নমিত কর তব গর্বিত উন্নত শির । '
একই পত্রিকার একই বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ সংখ্যায় গোলাম হোসেন নামক জৈনক কবি লিখলেন -
' তুমি অহংকার মত্ত ইবলিস
তুমি রুদ্র পিশাচ শয়তান খাবিস ! '
তুলনায় উন্নত সাহিত্য মানস কবি গোলাম মোস্তফাও নাম লিখিয়ে ফেলেন নজরুল বিরোধীদের দলে । সওগাত পত্রিকায় ' নিয়ন্ত্রিত ' শিরোনামে কবি লিখলেন -
' ওগো বীর
সংযত কর , সংহত কর ' ' উন্নত ' ' তব শির ।
বিদ্রোহী ? শুনে হাসি পায় !
বাঁধন - কারার কাঁদন কাদিয়া বিদ্রোহী হতে সাধ যায় ?
সেকি সাজে রে পাগল সাজে তোর ?
' বিদ্রোহী ' কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের শ্রেষ্ঠতম এবং বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠত্বের দিক থেকে বিরলতম কবিতাগুলির একটি এ বিষয়ে দ্বিমত নেই । নজরুল কাব্যসাহিত্যের সুউচ্চ পর্বতে ' বিদ্রোহী ' কবিতা হল এভারেষ্ট সদৃশ সর্বোচ্চ শৃঙ্গ । কবিতাটি কবিকে দিয়েছিল কাব্য খ্যাতি , জনপ্রিয়তা । বাংলা কাব্যের পাঠকগণ কবিকে আপন করে নিয়েছিলেন । হিতকরী সাহিত্য সমালোচকগণ প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন কবিকে । তবে , শুধু জনপ্রিয়তা কাব্যখ্যাতিই নয় , কবিতাটি প্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একদল কবি নামের অকবিদের প্রবল বিরুধীতার মুখোমুখি হতে হয় কবিকে । হিংসুটে এই সকল কবিবর্গ কবিকে নিয়ম করে আক্রমণ করতে থাকেন । ক্ষতবিক্ষত করতে সচেষ্ট হন তাঁর কাব্যমানসকে । কয়লা যেমন শত সহস্র প্রচেষ্টা করেও হীরার উপস্থিতি গোপন করতে পারে না , তেমনি নিন্দুকগণ কবি কাজীর সাহিত্য প্রতিভার গতিকে তো রুদ্ধ করতে পারলেন না , বরং নিজেরাই হারিয়ে গেলেন কালের গর্ভে । বেঁচে থাকলেন কবি নজরুল ইসলাম -
' মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহতারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যূলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন আরশ ছেদিয়া ....'
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন