প্রেম ও প্রত্যাখ্যান - মধুবনি
শর্মিলা বিকাল থেকে বিছানায় পড়ে আছে,এখন রাত ৯টা, না এখন আর সহ্য করা যাচ্ছে না এই অসহ্য যন্ত্রনা;ঘন অন্ধকার রাত, আলো জ্বালানো যাবে না, আলোতে আরো অসহ্য হয়ে ওঠে যন্ত্রণা,এই ব্যথা আর পিছন ছাড়লো না শর্মিলার। জানালাটা খুলে দিলো, একটু বাতাস আসুক, জল কি খাবে একটু,জল খেয়েই ছুটে পালালো কলতলায়, সব বমি হয়ে গেল, শরীর ঝিমিয়ে পড়েছে,আর শক্তি নেই কল পাম্প করার, বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো, ঠান্ডা হওয়া আসছে জানালা থেকে। শর্মিলা ভাবছে কি করে এরকম একা হয়ে গেল, একদম একা, অন্ধকার ঘরে থেকেও জীবন অন্ধকারময়।ব্যথা আর ঘুমে আচ্ছন্ন অবস্থায় চিন্তা পাক খেতে থাকে-
পিনাক- তুই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা, যা বলছি।
শর্মিলা- কেন করছিস এরম বল।
পিনাক-বুঝিসনি বল, এইযে সকাল থেকে বোঝাচ্ছি আর এখন বলছিস কেন এরকম করছি।
শর্মিলা-দেখ, শান্ত হ, এরকম করিসনা।
পিনাক-থাম মাগি, নাটক করিস?
শর্মিলা- প্লিজ তুই থাম, জানিস আমি কাঁদলে খুব মাথা আর চোখ যন্ত্রনা করে…
না আবার কেন, এসব কথা ভাবছি আমি, "ওহ, ভগবান কেন আমাকে এসব মনে করাও বার বার, আমার স্মৃতি শক্তি নিয়ে নাও তুমি, আমি ভাবতে চাই না।"
দীর্ঘশ্বাস ফেললো শর্মিলা। "কাল স্কুল যাওয়ার আগে ব্যথাটা যেন কমে যায় ঠাকুর।"
অন্তর্যামী জানে, শর্মিলা এক থাকতে চেয়েছিল, সব ছেড়ে,রোজ রোজ এক জিনিস সহ্য করতে পারছিল না সে। আজ সেই একাকীত্বই বিষময় হয়ে উঠছে।
শর্মিলা স্কুলে এসে পৌঁছালো ১০:৩৫ এ, জীবন যেন গান গেয়ে উঠলো, জীবন কত স্নিগ্ধ,সুন্দর,এখানে কোনো বারন নেই, শাসন নেই শোষণ নেই।
সন্ধে আর রাতে যে তার জীবন প্রেতছায়া হয়ে স্মৃতির অলি গলি ঘোরে।
বিকেলে যখন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলো, তখন ব্যথাটা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়র মতো এক কোণে রয়ে গেল।
"না, আজ আর রাঁধবো না, আচ্ছা আজ আমার যদি একটা সন্তান থাকতো", ভাবতেই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো।
সঞ্চয়িতা হাতে নিয়ে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়লো।
" অপমান করিসনা আর আমাকে, সইতে পারছি না, এবার মরেই যাবো, দম আটকে আসছে। মা বাবা আমাকে আমাকে নিয়ে যাও,উদ্ধার করো আমাকে"।
ঘেমে নেয়ে ধরফড়িয়ে উঠলো শর্মিলা। স্বপ্ন!স্বপ্ন!
স্বপ্নেও কষ্ট তাড়া করে বেড়ায়, পিনাককে ছাড়ার পর মা বাবার কাছেও যায়নি শর্মিলা। যেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে শর্মিলা, বলে এসেছিল-" তোমাদের অমতে যাচ্ছি তো, ভালো থাকি আর খারাপ থাকি এই দরজায় এসে আর দাঁড়াবো না।"। মা হয়তো আশ্রয় দিতো, কিন্তু শর্মিলা নিজের কথা রেখেছে,যেমন তার বাবা মা নিজেদের জেদ থেকে সরে যায়নি। মনে মনে বলছে, ভালো থাকুক সবাই।
আজ রবিবার, একসময় এই দিনটা ছিল খুব আনন্দের দিন, উৎসবের দিন,প্রেমের দিন। এখন শুধুই বিষন্নতার রবিবার।
শর্মিলা আর পিনাকের প্রেম কলেজ থেকেই।দীর্ঘ অপেক্ষার পর শর্মিলার যেন প্রেমের ক্ষরা কাটলো। পিনাক যেনো মনের মতো প্রেমিক তার। পিনাকের সব কথাতেই শর্মিলা যেন প্রেম খুঁজে পায়। পিনাকের ভাসা ভাসা চোখ যেন প্রেমের ছোঁয়া দিয়ে যায়। যেন এক আনন্দের মুরসুম। যখন খুশি দেখা করা, গল্প করা চলতেই থাকে।বাড়িতে মা বাবা দাদা দিদির কাছে অফুরন্ত ভালোবাসা।কলেজ শেষ করার পরেই একটা চাকরি জুটে যায় শর্মিলার।উচ্চ মাধ্যমিকের পরেই সে ওই পরীক্ষা দিয়েছিল।পিনাক বেকার,তবু দুজনের মনে খুশির জোয়ার। যাহোক একজনের তবু তো কিছু হলো। হয়ে যাবে ঠিক দিন গুজরান। সম্বন্ধ আসতে শুরু করে শর্মিলার বাড়িতে। দিদির কাছে শর্মিলা সব বলে আর বাড়ির লোক সব জেনে যায়।পিনাকের কথায় তারা রাজি নয়, শর্মিলাও জেদ ধরে বসে, বিয়ে যদি হয় তবে পিনাককেই করবে।
এরকম টানাপোড়েন চলতেই থাকে দিন দিন, পিনাককে সব কথা জানায় শর্মিলা। পিনাক বলে "তোকে ছাড়া আমার জীবন মরুভূমির মতো; তুই চলে যাওয়া মানে আমার প্রাণ চলে যাওয়া,তবু বলবো বাড়ির অমতে বিয়ে করাটা ঠিক হবে না, কয়েকটা বছর অপেক্ষা কর, আমি ঠিক চাকরি পেয়ে গেলে দেখিস ওরা মেনে নেবে।
দুজনেই আসস্থ হয়।
শর্মিলা স্কুলেও জয়েন করেছে।আগের থেকে একটু ব্যস্ত সে।পিনাকের সাথে আর দেখা হয়না,কথাও খুব কম হয়, শর্মিলা ক্লান্ত হয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। রবিবার শুধু ওদের দুজনের।এদিন ওরা দুজনের অভাব অভিযোগ মিটিয়ে নেয়।স্কুলের সব গল্প করে পিনাকের সাথে।হয়তো একটু বেশিই করে ফেলে।
শর্মিলা লক্ষ্য করে পিনাক কেমন যেন বিষণ্ন হয়ে পড়ছে দিন দিন।
কারণ জানতে চাইলে পিনাক জানায়
"চাকরি টা তুই ছেড়ে দে"
শর্মিলা অবাক হয়ে-"কেন?"
পিনাক-"অন্তত তাহলে তোর সম্বন্ধ আসাটা শেষ হবে।তাছাড়া তুই বাড়িতে থাকবি। তোর খুব কষ্ট হচ্ছে। সবাই যেভাবে তোকে দেখে আমার একদম ভালো লাগে না।"
শর্মিলা হেসে ফেলে বললো-"আমার পাগল একটা।"
পিনাক-বলনা ছাড়বি।
শর্মিলা-চাকরি টা তো আমাদের জন্যই করছি।দুজনে বেকার থাকলে,সংসার চলবে কি করে"?
পিনাক বিষণ্ন চোখে তাকিয়ে থাকে।
শর্মিলা-অতো ভাবিসনাতো।তোর একটা কিছু হোক ঠিক হয়ে যাবে সব।
কিন্তু পিনাকের বেকারত্ব কাটতেই চায়না।
আরো একদিন চাকরি ছাড়ার কথা পিনাক বললে শর্মিলা বলে "দেখ পিনাক,তুই আমাকে চাকরি ছাড়ার কথা আর কোনো দিনই বলবি না।কারণ আমি ছাড়বো না।
এই কথা বলে শর্মিলা চলে এসেছিল বাড়িতে।
পিনাক তারপর কষ্ট করে মানিয়েছিলো শর্মিলাকে।
এইভাবে দুই বছর চলার পর শর্মিলা পিনাকের হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। বিয়ের একবছরের মাথায় পিনাকও চাকরি পেয়ে যায়। পিনাকের চাকরিটা একটু দূরে, সপ্তাহে একবার বাড়ি আসে।
পিনাক একদিন আবদারের সুরে জানায়-"তোর চাকরিটা এবার ছেড়ে দে, আমি যা পাই এতে ভালোভাবে চলে যাবে, আর তুইও আমার কাছে এসে থাকবি।"
শর্মিলা আপত্তি জানালে পিনাক যেন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।
সেই রাত মৃদু মনোমালিন্যে কেটে যায়।
পরের দিন কিছুই ভালো লাগে না শর্মিলার, কেমন যেন একা একা লাগে, বাড়ির কথা মনে পড়ে।
পিনাক সেই সপ্তাহে বাড়ি ফেরেনি, শর্মিলা চিন্তায় চিন্তায় কাঠ হয়ে যায়।পিনাককে ফোন করলে সে বেশিক্ষণ কথা বলে না।শর্মিলা তাকে বাড়ি আসতে বললে, পিনাক বলে-" সপ্তাহে একদিন বাড়ি যাই, তোর ক্লান্ত শরীরটা দেখতে ভালো লাগে না,তাই বাড়ি যাবো না।
বলেই ফোনটা কেটে দেয় পিনাক।শর্মিলার কেমন যেনো মাথা ব্যথা করে ওঠে।
পিনাক বাড়ি ফেরে এক মাস পর।শর্মিলার চেহারায় বিষণ্ণতার ছাপ, পিনাকও ভালো নেই।
সেই রাতে পিনাক আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় শর্মিলাকে।
শর্মিলা পিনাককে বলে-"কি চাকরি ছাড়ার ভুত নেমেছে মাথা থেকে?"
পিনাক দৃঢ় ভাবে বলে,"চাকরিটা তোকে ছাড়তেই হবে,এভাবে আমি থাকতেই পারবোনা।"
শর্মিলা-"তুই কি পাগল হয়ে গেলি?"
পিনাক-"কেন রে তোর এত লোভ কেন?"
শর্মিলা- "লোভ মানে!"
পিনাক-"মানে টাকার লোভে।"
শর্মিলা-কার টাকার লোভ!!
পিনাক-কেন, বুঝতে পারছিস না।
শর্মিলা-দেখ,তোকে আমি আগেও বলেছি,চাকরি আমি ছাড়বো না।
পিনাক-কেন রে? ওখানে কি আমার থেকেও বেশি ভালোবাসা পাস।
শর্মিলা-হাঁ! পাই।
পিনাক- তাই বলে, এই রহস্য,আমি যা অনুমান করেছি ঠিক তাই।
শর্মিলা-মানে, কি অনুমান করেছিস তুই?
পিনাক-তুই ছাড়বি কিনা বল?
শর্মিলা- না।
পিনাক-"তাহলে তোকে আমাকে ছাড়তে হবে।"
শর্মিলা-পিনাক।
পিনাক- ভয় দেখাচ্ছিস কাকে তুই?
শর্মিলা-ভয় পাচ্ছিস নাকি তুই?
পিনাক-তোর কত লোভ হয়েছে,তোকে কিভাবে শিক্ষা দিতে হয় তা আমার ভালোভাবেই জানি।
অবাক হয়ে যায় শর্মিলা,পিনাক সকালেই কিছু না খেয়ে বেরিয়ে যায়।ঘৃণায় শর্মিলাও ফোনে করে না পিনাককে,পিনাকও করেনা।
না আর ভাবতে পারছে না শর্মিলা, এই জীবন আর পিনাকের সঙ্গে কাটানো জীবন কোনটাই সুস্থ নয়, শুধু প্রেমের জীবনটাই ছিল মধুময়।চাকরি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে শর্মিলা। পিনাকের সাথে বিচ্ছেদও হয়েছে অনেকদিন,পিনাকও আর বিয়ে করেনি, হয়তো করতেও পারে। "করুক যা খুশি, ভালো থাক।"
যাই রান্নাটা বসাতে হবে, খেতে তো হবে।
দুপুরে একটু বিশ্রাম নিতে বসলে স্মৃতি যেনো টাটকা হয়ে ওঠে।
পিনাক মেসেজে জানতে চেয়েছিল কাকে ছাড়বে শর্মিলা,-চাকরি নাকি পিনাককে।
শর্মিলা বলেছিল-"যাই হয়ে যাক,চাকরি ছাড়তে পারবো না।"
"তুই আমার মেরুদন্ড ভেঙে দিতে চাইছিস।"
পিনাক-"মেরুদন্ড ভাঙা কাকে বলে তুই তো জানিস না, চাকরির থেকেও বেশি কিছু পাস তুই ওখানে।"
শর্মিলা আর কোনো উত্তর দেয়নি।
পরের দিনই বাড়ি আসে পিনাক। শর্মিলা খুশি ও আতঙ্কিত দুইই হয়।
শর্মিলা-চলে যাবো সত্যিই।
পিনাক- যাচ্ছিস না কেন, আমার বাড়িতে কেন রয়েছিস?চাকরি করিস তবুও লোকের বাড়িতে থাকিস কেন?
শর্মিলা-আর অপমান করার সুযোগ তোকে দেবোনা।
তারপরেই নিজের জিনিস গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসে শর্মিলা,চাকরিটাই একমাত্র সম্বল।পিনাক ও বাধা দেয়না। স্কুলের একটু কাছেই ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে সে।
"মিস ও মিস,কাঁদছো কেন,আজ পড়াবেনা"
আছন্ন অন্ধকার থেকে জেগে ওঠে শর্মিলা, তাকে যে আলোর পথেই ফিরতেই হবে।
___________________
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন