গল্পকার জীবনানন্দ দাশ ও জামরুলতলা গল্প বিশ্লেষন । আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
গল্পকার জীবনানন্দ দাশের সাথে সাহিত্য ঘরানার সিরিয়াস পাঠক ব্যতিত তেমন অনেকেরই বিশেষ পরিচয় নেই , বললে অন্যায় বলা হবে না । যেমনটি কবিবর শ্রদ্ধেয় নজরুল ইসলামের সঙ্গে ঘটেছে । পাঠক তাঁদের কাব্যময় শরীরকে মাথায় তুলে রাখলেও গল্প উপন্যাসকে তেমন অমল দেননি , বিষয়টি আক্ষেপের । একটু নিবিড়ভাবে পাঠ করলে খুব সহজেই উপলব্ধি হয় , কাব্যকলার মতনই সাহিত্যের কথনকলায়ও কবি জীবনানন্দ দাশ ভীষণরকম সফল হয়েছেন । তাঁর গল্প জীবনের কথা বলে , সময়ের প্রসব যন্ত্রণাকে রুপ দেন বিবর্ণ বর্ণমালায় । মেকি কৃত্তিমতা তাঁর কাছে অচ্ছুৎ , কল্লোলীয় দর্শন প্রিয় নয় তাঁর । জীবনের রক্তঘাম , ব্যর্থতার বর্মই তাঁকে লিখিয়ে নেয় পৃষ্টার পর পৃষ্টা । সাধারণ মধ্যবিত্তের জীবন যন্ত্রণার আকর হয়ে উঠতে ভীষণরকম সক্ষম কবি জীবনানন্দের প্রায় সব গল্পই । সমকালীন সময় , ইতিহাস ইতিবৃত্তের সাথে স্বজীবনের গল্প মিশিয়ে দেন অবলীলায় , যা যুগযন্ত্রণার দলিল হওয়ার সাথেই গল্পসৌন্দর্যের অভিজ্ঞানময় আস্বাদ খুঁজে পায় পাঠককুল ।
জীবনানন্দ দাশের অন্যতম একটি ছোটগল্প ' জামরুলতলা ' ।গল্পের মূল সুর মূলত ট্রেজিক ।
গল্পের চরিত্ররা সবাই শহরমুখী । বিশাল বাড়িতে একটা সময় প্রবল জনসমাগমের দৃশ্যময় দৃষ্টান্ত থাকলেও , এখন তা জনশূন্য হয়ে পড়েছে । শহর গ্রামকে গ্রাস করতে শুরু করেছে ততদিনে । তাই স্বচ্ছল জীবনের প্রলোভনে কথকের বাড়ির প্রায় সব সদস্যই পাড়ি দিয়েছেন শহর কলকাতার বুকে ।
' কলকাতা তাদের দিনরাত্রীর জৈব দেহে চর্বির মত এসে জমেছে । '
এই কলকাতা গমনের দৃশ্যের মধ্য দিয়ে গল্পের যাত্রা শুরু হয় । গল্পের শুরুতেই গ্রাম শহরে উঠে আসার এই চিত্রকল্প পাঠককে দুঃখময় এক হিমশীতলতা প্রদান করে । বিষয়টি গল্পকথককেও ব্যথিত করে । গ্রামীণ জনপদের এই বিশাল বাড়িতে পড়ে আছেন তিনজন , অবিবাহিত বয়স্ক মেজকাকা , বিধবা পিসিমা এবং কথক নিজে । এতদিন মা এবং স্ত্রী শোভনা থাকায় একাকিত্বের বহর তেমন লম্বা হয়নি , তবে তাঁদের গমনের সাথে পুরো বাড়িময় খাঁ খাঁ রব উঠল ।
' পশ্চিম ভিটার মস্ত বড় টিনের ঘরটা খাঁ খাঁ করছে । শান বাধাঁনো মেঝে , করগেট , টিনের বেড়া , ঘরের ভিতর আট দশটা বড় বড় কোঠা , প্রায় সাত আটটা পড়ে আছে । টেবিল চেয়ার , আলনা আরশি সমস্ত আছে কিন্তু মানুষ মোটে দুটি , মেজ কাকা এবং পিসিমা । '
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় , যাঁরা এখনও এই গ্রামীণ জনপদে রয়েছেন , তাঁরা একপ্রকার অসহায় । মেজকাকার বয়স হয়েছে , তিনি অবিবাহিত , পিসিমাও বৃদ্ধাপ্রায় ও সংসারহীন । গল্পকথক বিবাহিত , বয়স ত্রিশউর্দ্ধ , তবে চাকরি নেই । গল্পকথকের সাথে আমরা জীবনানন্দকে মিলিয়ে পড়তে পারি । রবীন্দ্রউত্তর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কণ্ঠ তিনি , অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস , জীবনের একটা বড় অংশই তিনি কর্মহীন থেকেছেন । সহোদর ভাইদের মুখাপেক্ষী হয়েছেন , অভাবের তাড়নায় স্ত্রীর সাথে চূড়ান্ত অবিনিবনা হয়েছে । গল্পেও কথক দাদার দয়ায় বেঁচে আছেন , স্ত্রী বাবার বাড়ি গিয়েও ফিরে আসেন না , এ যেন ব্যক্তি জীবনানন্দ নিজের জীবনের গল্প । প্রসঙ্গত , ' কুয়াশার ভিতর মৃত্যুর সময় ' গল্পের ঠুকরো একটি চরণ হৃদয়ে জাগর কাটছে ।
' বিনোদ নিজের জীবনের একটা গল্প লিখছে । '
জীবনানন্দ দাশের সাহিত্য ঘরানার এক অনন্য দিক , তিনি স্বজীবনের গল্পগুলোই মিশিয়ে দেন তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের রক্তে । ' বাসর রাত ' গল্পের চরিত্র প্রেমনীহারের স্ত্রী মনিকা স্বামীকে জিজ্ঞাসা করেছিল ।
' নিজেরা কায়ক্লেশে যে সংসার চালাতে পারে না , সেখানে একজন পরের মেয়েকে এনে কষ্ট দেয় তারা কি সৎ ? '
আসলে , জীবনানন্দ দাশ তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে নিজেকে আরশির সম্মুখে দাঁড় করান , এক প্রকার আত্মধিক্কার এবং ব্যর্থতার গ্লানি পুষিয়ে নিতে চান ।
যায়হোক , আলোচনার বহরকে গতি দেওয়া যাক , এই একাকী জীবনে কথককে সঙ্গ দেয় কয়েকটা অবলা প্রাণী । পিসিমার করা শাকসবজির লোভে তাদের আগমন । কথক তাদের জীবনের মৈথুন রহস্য উপলব্ধি করেন ।
' নিস্তব্ধ দুপুর বেলা ছায়া - উদাস ছাতিম কৃষ্ণচূড়ার নীচে এদের এই নিরিবিলি জীবন ধারণা , পরস্পরের নিকট সংসর্গ , বিচ্ছেদহীন নীলাভদিন মৃগনাভি ? গন্ধময় রাত তৃপ্তি , শান্তি , দেখতে দেখতে আমার নিঃসঙ্গ জীবনের একটা কিনারা পাই । '
আসলে কর্মহীন মানুষ , অন্যের দয়ায় বেঁচে থাকা মানুষ দুঃখী এবং একাকী হবেন , সেটায় নিয়ম । কেননা সংসার বড় কঠিন , সবটুকু সুখ এখানে কিনতে হয় অর্থ দিয়ে । তাই গল্পের মাঝেই তাঁকে বিমর্ষ লাগে , কণ্ঠ ধরে আসে , হতাশা জমে হৃদয়কোনে ।
' আমার চেয়ে ঢের অক্ষম আত্মভ্রষ্ট লোকগুলোও যখন নির্বিচারে জীবনের কাছ থেকে আড়ম্বরে পুরস্কার পাচ্ছে আর আমি পাচ্ছি ....'
(...)এই ডট ডটের ভিতর জমে আছে অনেক যন্ত্রণা আর ব্যর্থতার একাকী দ্বিপ্রহর ।
কিছুটা কষ্ট ভুলতে কথক গল্প লিখতে প্রয়াসী হন । কিছু কাগজও কেনেন । গল্প লিখবার জন্য শুধু খাতা কলম তো যথেষ্ট নয় ।
' গল্প লিখবার ঘন্টা মুহূর্তগুলো মানুষের জীবনের খুব একটা সুন্দর উৎসজনের জিনিস বলে মনে হয় । .......পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ আবিষ্কার করতে পারে । অদৃশ্য সমুদ্রের শব্দ শুনতে পারে , ভোরের রাঙা সূর্য অর্ধ নারীশ্বরের ভয়াবহ সুন্দর রুপ দেখতে পারে । চাই উপলব্ধি ও কল্পনার গভীরতা ও সাহস । '
এই কল্পনার করবার অভিপথে বিঘ্নতার সঞ্চার করে কথকের কাছে আসে নির্মল । নির্মল মধ্যবিত্তের টাইপ চরিত্র , সাইকেল চুরির ভয়ে সন্ত্রস্ত । এর আবির্ভাবে গল্পকথকের গল্পলিখবার ভাবনাকে ধাক্কা দেয় ।
নির্মল কথককে একটি হৃদয় বিদারক ঘটনার শোনায় । এই গল্পটি অবনী আর হারানী । দুইজনকেই চিনত কথক । অবনী সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিল , হারানীই তাঁকে সংসারমুখী করেছিল । হারানী কথকের প্রতিবেশী আট দশ বছর আগে । কথক জামরুলতলায় বসে লিখতেন , হারানী কিছুটা আড়ষ্টতা সাথেই নোনা ছিঁড়ে নিয়ে যেত । দুজনের কথা বিশেষ হয়নি । তবুও কথক তাঁকে মনে রেখেছে । হারানী এবং অবনীর প্রেম হয়েছিল , কিন্তু মরণরোগে পড়ে মৃত্যুমুখে পতিত হল অবনী । হারানীর সেবা তাঁকে বাঁচাতে পারল না । গল্পটি শুনে কথক বিমর্ষ হয়েই নির্মলের স্ত্রী কথা জানতে চান । নির্মল জানায় তাঁর স্ত্রী মারা গেছে , সে যাবে না তাঁকে দাহ করতে । মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনের এই ঘৃণ্যদিক দেখে শিহরিত হন কথক ।
' কলম রেখে দেই । কী লিখব । গোধূলির বিষন্ন সুন্দর মাঠের পথে হাঁটতে হাঁটতে ভাঙা শামুকের বিষম কামড় খেয়ে থমকে যেতে হয় যেন । কী লিখব । জীবনের বিপুলব্যঙ্গ এসে আমার সমস্ত গল্পের পরিকল্পনাকে আঘাত দিয়ে যায় । '
অবনী ও হারানী ট্রেজিক প্রেমকথন এবং বন্ধু নির্মলের স্ত্রী বিয়োগ গল্প কথকের স্ত্রী শোভনার সাথে বিচ্ছেদ মুহূর্তর কথা স্মরণ করিয়ে দেয় ।
' শোভনার সঙ্গে সেই আমার শেষ রাত । সেদিনই ভোর রাত সাড়ে পাঁচটার সময় সে বাপের বাড়ি যাবার জন্য স্টীমার ধরল । '
এই বেদনাময় আবেশের ভিতর দিয়েই গল্পের সমাপ্তি দেন জীবনানন্দ দাশ সমীপেষু ।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন