গল্পকার জীবনানন্দ দাশ ও জামরুলতলা গল্প বিশ্লেষন । আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।



জীবনানন্দ দাশ মূলত রবীন্দ্রউত্তর কাব্যধারার শ্রেষ্ঠতম সরস্বত প্রতিভূ । তবে , এটিই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয় । প্রধানত তিনি কবি , তাঁর খ্যাতির মূলদণ্ড কবিতাই  , বিষয়টি  অস্বীকার করা যায় না  । জীবদ্দশায় ১৪ টি উপন্যাস এবং ১০৮ টি ছোটগল্প তিনি রচনা করেন । দুঃখের বিষয় , এই বিপুল সৃষ্টিসম্ভার জীবিত থাকাকালীন সময় প্রিয় শ্রদ্ধেয় জীবনানন্দ দাশ সমীপেষু লোকচক্ষুর সম্মুখগোচর করেননি ।  তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির পথকে রুদ্ধ করতে বিরুদ্ধ এক একাধিক সাহিত্য গোষ্টির নিরন্তর সমালোচনা তাঁকে ব্যথিত করে তুলেছিল । স্বজীবনের সব অধ্যায়েই এক প্রকার ব্যর্থতা তাঁকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল , অসফলতা তাঁর জীবনের মূল গল্প হয়ে উঠেছিল ।  এই ব্যর্থতার রেশ আরও একটু শ্লেষে পরিণত হোক এমন হয়তো চাননি প্রচারবিমুখ এই মহান সাহিত্য সাধক । 

গল্পকার জীবনানন্দ দাশের সাথে সাহিত্য ঘরানার সিরিয়াস পাঠক ব্যতিত তেমন অনেকেরই বিশেষ পরিচয় নেই , বললে অন্যায় বলা হবে না । যেমনটি কবিবর শ্রদ্ধেয়  নজরুল ইসলামের সঙ্গে ঘটেছে । পাঠক তাঁদের কাব্যময় শরীরকে মাথায় তুলে রাখলেও গল্প উপন্যাসকে তেমন অমল দেননি , বিষয়টি আক্ষেপের । একটু নিবিড়ভাবে পাঠ করলে খুব সহজেই উপলব্ধি হয় , কাব্যকলার মতনই সাহিত্যের কথনকলায়ও কবি জীবনানন্দ দাশ ভীষণরকম সফল হয়েছেন । তাঁর গল্প জীবনের কথা বলে , সময়ের প্রসব যন্ত্রণাকে রুপ দেন বিবর্ণ বর্ণমালায় । মেকি কৃত্তিমতা তাঁর কাছে অচ্ছুৎ , কল্লোলীয় দর্শন প্রিয় নয় তাঁর । জীবনের রক্তঘাম , ব্যর্থতার বর্মই তাঁকে লিখিয়ে নেয় পৃষ্টার পর পৃষ্টা । সাধারণ মধ্যবিত্তের জীবন যন্ত্রণার  আকর হয়ে উঠতে ভীষণরকম সক্ষম কবি জীবনানন্দের প্রায় সব গল্পই । সমকালীন সময় , ইতিহাস ইতিবৃত্তের সাথে স্বজীবনের গল্প মিশিয়ে দেন অবলীলায় , যা যুগযন্ত্রণার দলিল হওয়ার সাথেই গল্পসৌন্দর্যের অভিজ্ঞানময় আস্বাদ খুঁজে পায় পাঠককুল । 

জীবনানন্দ দাশের অন্যতম একটি ছোটগল্প ' জামরুলতলা ' ।গল্পের মূল সুর মূলত ট্রেজিক । 
গল্পের চরিত্ররা সবাই শহরমুখী । বিশাল বাড়িতে একটা সময় প্রবল জনসমাগমের দৃশ্যময় দৃষ্টান্ত থাকলেও , এখন তা জনশূন্য হয়ে পড়েছে । শহর গ্রামকে গ্রাস করতে শুরু করেছে ততদিনে । তাই স্বচ্ছল জীবনের প্রলোভনে কথকের বাড়ির প্রায় সব সদস্যই পাড়ি দিয়েছেন শহর কলকাতার বুকে । 
' কলকাতা তাদের দিনরাত্রীর জৈব দেহে চর্বির মত এসে জমেছে । ' 
এই কলকাতা গমনের দৃশ্যের মধ্য দিয়ে গল্পের যাত্রা শুরু হয় । গল্পের শুরুতেই গ্রাম শহরে উঠে আসার এই চিত্রকল্প পাঠককে দুঃখময় এক হিমশীতলতা প্রদান করে । বিষয়টি গল্পকথককেও ব্যথিত করে । গ্রামীণ জনপদের এই বিশাল বাড়িতে পড়ে আছেন তিনজন , অবিবাহিত বয়স্ক মেজকাকা , বিধবা পিসিমা এবং কথক নিজে । এতদিন মা এবং স্ত্রী শোভনা থাকায় একাকিত্বের বহর তেমন লম্বা হয়নি , তবে তাঁদের গমনের সাথে পুরো বাড়িময় খাঁ খাঁ রব উঠল । 
' পশ্চিম ভিটার মস্ত বড় টিনের ঘরটা খাঁ খাঁ করছে । শান বাধাঁনো মেঝে , করগেট , টিনের বেড়া , ঘরের ভিতর আট দশটা বড় বড় কোঠা , প্রায় সাত আটটা পড়ে আছে । টেবিল চেয়ার , আলনা আরশি সমস্ত আছে কিন্তু মানুষ মোটে দুটি , মেজ কাকা এবং পিসিমা । ' 

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় , যাঁরা এখনও এই গ্রামীণ জনপদে রয়েছেন , তাঁরা একপ্রকার অসহায় । মেজকাকার বয়স হয়েছে ,  তিনি অবিবাহিত , পিসিমাও বৃদ্ধাপ্রায় ও সংসারহীন । গল্পকথক বিবাহিত , বয়স ত্রিশউর্দ্ধ , তবে চাকরি নেই । গল্পকথকের সাথে আমরা জীবনানন্দকে মিলিয়ে পড়তে পারি । রবীন্দ্রউত্তর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কণ্ঠ তিনি , অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস , জীবনের একটা বড় অংশই তিনি কর্মহীন থেকেছেন । সহোদর ভাইদের মুখাপেক্ষী হয়েছেন , অভাবের তাড়নায় স্ত্রীর সাথে চূড়ান্ত অবিনিবনা হয়েছে । গল্পেও কথক দাদার দয়ায় বেঁচে আছেন , স্ত্রী বাবার বাড়ি গিয়েও ফিরে আসেন না , এ যেন ব্যক্তি জীবনানন্দ নিজের জীবনের গল্প । প্রসঙ্গত , ' কুয়াশার ভিতর মৃত্যুর সময় ' গল্পের ঠুকরো একটি চরণ হৃদয়ে জাগর কাটছে । 
' বিনোদ নিজের জীবনের একটা গল্প লিখছে । ' 
জীবনানন্দ দাশের সাহিত্য ঘরানার এক অনন্য দিক , তিনি স্বজীবনের গল্পগুলোই মিশিয়ে দেন তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের রক্তে । ' বাসর রাত ' গল্পের চরিত্র প্রেমনীহারের স্ত্রী মনিকা স্বামীকে জিজ্ঞাসা করেছিল । 
' নিজেরা কায়ক্লেশে যে সংসার চালাতে পারে না , সেখানে একজন পরের মেয়েকে এনে কষ্ট দেয় তারা কি সৎ ? ' 
আসলে , জীবনানন্দ দাশ তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে নিজেকে আরশির সম্মুখে দাঁড় করান , এক প্রকার আত্মধিক্কার এবং ব্যর্থতার গ্লানি পুষিয়ে নিতে চান । 

যায়হোক , আলোচনার বহরকে গতি দেওয়া যাক , এই একাকী জীবনে কথককে সঙ্গ দেয় কয়েকটা অবলা প্রাণী । পিসিমার করা শাকসবজির লোভে তাদের আগমন । কথক তাদের জীবনের মৈথুন রহস্য উপলব্ধি করেন । 
' নিস্তব্ধ দুপুর বেলা ছায়া - উদাস ছাতিম কৃষ্ণচূড়ার নীচে এদের এই নিরিবিলি জীবন ধারণা , পরস্পরের নিকট সংসর্গ , বিচ্ছেদহীন নীলাভদিন মৃগনাভি ? গন্ধময় রাত তৃপ্তি , শান্তি , দেখতে দেখতে আমার নিঃসঙ্গ জীবনের একটা কিনারা পাই । ' 
আসলে কর্মহীন মানুষ , অন্যের দয়ায় বেঁচে থাকা মানুষ দুঃখী এবং একাকী হবেন , সেটায় নিয়ম । কেননা সংসার বড় কঠিন , সবটুকু সুখ এখানে কিনতে হয় অর্থ দিয়ে । তাই গল্পের মাঝেই তাঁকে বিমর্ষ লাগে , কণ্ঠ ধরে আসে , হতাশা জমে হৃদয়কোনে । 
' আমার চেয়ে ঢের অক্ষম আত্মভ্রষ্ট লোকগুলোও যখন নির্বিচারে জীবনের কাছ থেকে আড়ম্বরে পুরস্কার পাচ্ছে আর আমি পাচ্ছি ....' 
(...)এই ডট ডটের ভিতর জমে আছে অনেক যন্ত্রণা আর ব্যর্থতার একাকী দ্বিপ্রহর । 

কিছুটা কষ্ট ভুলতে কথক গল্প লিখতে প্রয়াসী হন । কিছু কাগজও কেনেন । গল্প লিখবার জন্য শুধু খাতা কলম তো যথেষ্ট নয় । 
' গল্প লিখবার ঘন্টা মুহূর্তগুলো মানুষের জীবনের খুব একটা সুন্দর উৎসজনের জিনিস বলে মনে হয় । .......পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ আবিষ্কার করতে পারে । অদৃশ্য সমুদ্রের শব্দ শুনতে পারে , ভোরের রাঙা সূর্য অর্ধ নারীশ্বরের ভয়াবহ সুন্দর রুপ দেখতে পারে । চাই উপলব্ধি ও কল্পনার গভীরতা ও সাহস । ' 
এই কল্পনার করবার অভিপথে বিঘ্নতার সঞ্চার করে কথকের কাছে আসে নির্মল । নির্মল  মধ্যবিত্তের টাইপ চরিত্র , সাইকেল চুরির ভয়ে সন্ত্রস্ত । এর আবির্ভাবে গল্পকথকের গল্পলিখবার ভাবনাকে  ধাক্কা দেয় । 

নির্মল কথককে একটি হৃদয় বিদারক ঘটনার শোনায় । এই গল্পটি অবনী আর হারানী । দুইজনকেই চিনত কথক । অবনী সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিল , হারানীই তাঁকে সংসারমুখী করেছিল । হারানী কথকের প্রতিবেশী আট দশ বছর আগে । কথক জামরুলতলায় বসে লিখতেন , হারানী কিছুটা আড়ষ্টতা সাথেই নোনা ছিঁড়ে নিয়ে যেত । দুজনের কথা বিশেষ হয়নি । তবুও কথক তাঁকে মনে রেখেছে । হারানী এবং অবনীর প্রেম হয়েছিল , কিন্তু মরণরোগে পড়ে মৃত্যুমুখে পতিত হল অবনী । হারানীর সেবা তাঁকে বাঁচাতে পারল না । গল্পটি শুনে কথক বিমর্ষ হয়েই নির্মলের স্ত্রী কথা জানতে চান । নির্মল জানায় তাঁর স্ত্রী মারা গেছে , সে যাবে না তাঁকে দাহ করতে । মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনের এই ঘৃণ্যদিক দেখে শিহরিত হন কথক । 
' কলম রেখে দেই । কী লিখব । গোধূলির বিষন্ন সুন্দর মাঠের পথে হাঁটতে হাঁটতে ভাঙা শামুকের বিষম কামড় খেয়ে থমকে যেতে হয় যেন । কী লিখব । জীবনের বিপুলব্যঙ্গ এসে আমার সমস্ত গল্পের পরিকল্পনাকে আঘাত দিয়ে যায় । ' 
অবনী ও হারানী ট্রেজিক প্রেমকথন এবং বন্ধু নির্মলের স্ত্রী বিয়োগ গল্প কথকের স্ত্রী শোভনার সাথে বিচ্ছেদ মুহূর্তর কথা স্মরণ করিয়ে দেয় । 
' শোভনার সঙ্গে সেই আমার শেষ রাত । সেদিনই ভোর রাত সাড়ে পাঁচটার সময় সে বাপের বাড়ি যাবার জন্য স্টীমার ধরল । ' 
এই বেদনাময় আবেশের ভিতর দিয়েই গল্পের সমাপ্তি দেন জীবনানন্দ দাশ সমীপেষু । 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধীবর বৃত্তান্ত নাটকের প্রধান কুশীলব ধীবরের চরিত্র বিশ্লষণ করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।

পথের দাবি গল্পে গিরিশ মহাপাত্রের পোশাক পরিচ্ছেদ ও অদ্ভুত দর্শন বিষয়ক আলোচনা ।

দাম গল্পটি ছাত্র শিক্ষক পবিত্র সম্পর্কের উপর গভীর ছায়াপাত করেছে । মাস্টারমশায় শাসন করতেন , ভালবাসতেন না । এটা ঠিক নয় ' , আলোচনা করছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আরিফুল ইসলাম সাহাজি ।